পরিবেশ

প্রশাসনিক মদতে অব্যাহত প্রকৃতি নিধন –

জলাশয় বোজানো লভ্যাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে –

 

কলকাতা মহানাগরিকের প্রতিশ্রুতি, পুরকমিশনার কর্তৃক জারি করা ইনল্যান্ড ফিশারিজ অ্যাক্ট-এর বিজ্ঞপ্তি নস্যাৎ করে কোলকাতা পুরসভা জলাশয় বুজিয়ে বহুতল নির্মাণের মিউটেশন দিল! ১০৪নং ও ৯২ নং ওয়ার্ডের ব্যাঙ্কপ্লট-সুইটল্যান্ড-শহিদনগরের মধ্যে অবস্থিত জলাশয়টির বেহাল অবস্থা!

দক্ষিণ কলকাতা ও পূর্ব-কলকাতা জলাশয়গুলির ওপর জমি হাঙ্গর ও অসাধু বহুতল ইমারতি কারবারিদের নজর বিগত দুই দশক ধরেই শহর কলকাতায় নিত্য নৈমিক ঘটনা। এর সাথে অবশ্য ইহাতে-হাত এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং প্রশাসনের নক্কারজনক আইনভঙ্গের প্রতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও শহর কলকাতার জন্য চলমান অর্থনীতির একমাত্র সোপান বহুতল ইমারতি ব্যবসা। জমির সঙ্কট অথচ বাসস্থানে রচাহিদার উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই দক্ষিণ কলকাতা ও পূর্ব-কলকাতার’র জলাশয়গুলি বুজিয়ে বহুতল ইমারত নির্মাণের ‘বিপ্লব’ বিগত ৫-৬ দশকে ধরেই চলেছে। কিন্তু এসবের মধ্যেই ১৯৮৪ সালের পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক ইনল্যান্ড ফিশারিজ অ্যাক্ট (সংশোধিত ১৯৯৩) জলাশয় ভরাট করেই মার তি নির্মাণের বিরুদ্ধে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করা হলেও বিগত তিন দশকের বাস্তব অভিজ্ঞতা কিন্তু এক চুড়ান্ত অরাজক ও প্রকাশ্য আইনভঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই মান্যতা পাচ্ছে।

 ২০১০-১১ সাল থেকে দক্ষিণ-কলকাতার ১০৪ নং ও ৯২ নং ওয়ার্ডের ব্যাঙ্ক প্লট, শহিদনগর ও সুইটল্যান্ডের মধ্যে অবস্থিত একটি প্রায় ৩বিঘার অধিক জলাশয়কে (Water body- East-Bank plot, west-Sweat Land, South-Bank plot North-Sahidnagar / Touzi no-OBI, Sub Reg Office at Ali pore, J L no-18, Mouza- Dhakuria under C S Dag no-1715,C S Khatian no-827) ভরাট করে বহুতল নির্মাণ কার্য আটকানোর লড়াই শুরু হয় স্থানীয়দের একাংশের হস্তক্ষেপে। প্রাথমিক পর্যায়ে‘ জনস্বার্থ-স্বার্থরক্ষা, জলাশয় সংরক্ষণ–সংস্কার মঞ্চ’ –নামে এক সংগঠনের মাধ্যমে এলাকাবাসী ১০৪নং ওয়ার্ডের পৌরপিতা এবং  ৯২ নং ওয়ার্ডের পৌরমাতা এবং কলকাতা পুরসভা, স্থানীয় গরফা থানা, পরিবেশ দপ্তর, পুরসভার ব্যুরো অফিস, মুখ্যমন্ত্রী অফিসে জলাশয়টি ভরাট বন্ধ করে বেহাল অবস্থা থেকে তার সংস্কার ও সংরক্ষণের আবেদন জানানো হয়। স্থানীয়দের এই পরিবেশ বাঁচানোর লড়াইয়ে সবচেয়ে প্রেরণার ছিলেন অশীতিপর শ্রী অমল ভট্টাচার্য্ ও ডঃ নির্মলকান্তি চৌধুরি। এছাড়াও প্রথম সারিতেই ছিলেন শঙ্কর বসু, বাবলু মুখুটি, অধ্যাপক মিহির চক্রবর্তী, দেবপ্রিয়াদি, শুচিশ্রী রায়, জয়ন্ত চক্রবর্তী, সুব্রত মুখুটি, অমলেন্দু সরকার, খোকন পাল, স্বরাজ ব্যানার্জী, শ্যামল সেনগুপ্ত ও বহু পরিবেশ সচেতন সাধারণ নাগরিক।

                উল্লেখিত জলাশয়টি সংরক্ষণ ও সংস্কারের উদ্যোগ ও স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাস নিম্নরুপ —

             ২০১২ সালে ১লা ডিসেম্বর কলকাতা দক্ষিণের পাতায় আনন্দবাজার পত্রিকায় দেবাশিস দাস-এর কলামে জলাশয়টিকে সংস্কারের জন্য স্থানীয়দের আবেদনের বিষয়টি প্রকাশ পায়।

             ০২/০৯/২০১৩ সালের কলকাতা পুরসভার কর্তৃপক্ষ ও মিউনিসিপ্যাল কমিশনার বিজ্ঞপ্তি জারি করে জলাশয়টি সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য ২৫ বছরের লিজ হিসাবে অধিগ্রহন করে Section 17A of West Bengal Inland Fisheries Act (Amended).।

             ২০১৪ সালের তৎকালীন কলকাতা মহানাগরিকে অঞ্চলবাসীদের আবেদনে সম্মতি প্রকাশ করে রাজ্যসভার সাংসদ ও প্রখ্যাত চিত্রকর শ্রী যোগেন চৌধুরী মহাশয়ও আবেদন করেন ০৭/০৬/২০১৪তারিখে। 

             ২০১৫ সালে রাজ্যসভার সাংসদ শ্রী যোগেন চৌধুরী মহাশয় তাঁর এমপিলাডস (MPLADS) [The Members of Parliament Local Area Development Scheme] থেকে উন্নয়নমূলক কাজের অংশ হিসাবে উল্লেখিত জলাশয়টির জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন এবং সেইমত পুরসভার তরফে টেন্ডারও ডাকা হয়। ৪  কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে সেই বরাদ্দ অর্থএবং ই-টেন্ডার প্রক্রিয়া বাতিল করা হয় এই যুক্তিতে যে এই কাজের কিছু টেকনিক্যাল অসুবিধা আছে। এ বিষয়ে আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই এই ৯২ নং ওয়ার্ডেই ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে আনোয়ার শাহ কানেকটর সংলগ্ন গাঙ্গুলি পুকুর জলাশয়টি সংস্কার করা হয়েছিল মাননীয় রাজ্যসভার সাংসদ শ্রী মনোজ ভট্টাচার্যের অর্থানুকুল্যে। একই পুরসভার একই ওয়ার্ডের জন্য ভিন্ন নীতি অত্যেন্ত দুরভিসন্ধিমূলক বলেই আমরা অঞ্চলবাসী মনে করেছি। 

             ০৭/১১/১৬ তারিখে স্থানীয় গরফা থানায় “জনস্বাস্থ্য-জনস্বার্থ, জলাশয়সংরক্ষণ-সংস্কার মঞ্চের পক্ষে রাতের অন্ধকারে লড়ি ভর্তি রাবিশ এই জলাশয়ের পশ্চিমদিকে ব্যাঙ্কপ্লটের দিক থেকে ভরাটের প্রচেষ্টা বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং লড়িগুলি আটকে স্থানীয় গরফা থানায় জিডি করা হয়। ৬ প্রসঙ্গত রাজনৈতিক মদতেই এই ভরাট প্রক্রিয়া নূতন করে শুরু হয় এবং জলাশয়ের মাঝ বরাবর একটি রাস্তা নির্মাণ করে ব্যাঙ্ক প্লট ও সুইটল্যান্ডের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের কথা বলে রীতিমত ইনল্যান্ড ফিশারিজ অ্যাক্ট লঙ্ঘনের কথা বলা হয়।৭

             অঞ্চলের পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা রাজনৈতিক মদতে জলাশয়টি ভরাটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ধারাবাহিক প্রচার আন্দোলন করে জলাশয়টিকে ভরাট প্রক্রিয়ার থেকে রক্ষা করে। কিন্তু কোনভাবেই জলাশয়টি সংস্কারের কাজ বাস্তবায়িত হয় না। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা মুখ্যমন্ত্রীর শরণাপন্ন হই কিন্তু কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। 

             ৯২নং পৌরমাতা শ্রীমতি মধুছন্দা দেব-এর ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু আবর্জনা ও কচুরু পানা তুলে সাময়িকভাবে জলাশয়টির আংশিক পরিস্কার করা হয়।এর পরবর্তী পর্যায়ে কলকাতা পুরকর্তৃপক্ষের তরফে সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয়তাই বজায় থাকে। এবং ২০১৯ সাল থেকে জলাশয়ের পূর্ব ও দক্ষিণ থেকে নানাভাবে ভরাটের কাজ অব্যাহত থাকা। স্থানীয়দের সহযোগীতায় জলাশয়ের পূর্ব ও উত্তরদিকে জলাশয়ের সীমানা নির্ধারণের জন্য কিছু সুপাড়ি গাছও রোপন করা হয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে লোভী প্রমোটার ও দুস্কৃতিদের মদতে বহু গাছ নষ্ট করা হয় এবং ময়লা আবর্জনা ফেলে সেখানে গাড়ি পার্কিং ,৯ইমারতির কাজে লাগা বাঁশের গোলা রাখার জায়গা বানিয়ে জলাশয় ভরাটের চেষ্টা অব্যাহত থাকে যার বিরুদ্ধে স্থানীয় গরফা থানায় ১০ এবং মেয়র-ইন-কাউন্সিল শ্রী স্বপন সমাদ্দার মহাশয়ের কাছে অভিযোগও জানানো হয়।.

             ইতিমধ্যে কোবিদ মহামারি ও তার সামাজিক দুরত্বনীতির সুযোগে জলাশয়টিকে বোজানোর চেষ্টা অব্যাহত থাকে অত্যেন্ত ধীরে কিন্তু প্রতিদিন প্রতি মহূর্তে জলাশয়টিকে চারদিকে ছোট করা এবং তার জলস্তর কমিয়ে আনার জন্য নানা পন্থা ১০৪ নং পৌরপিতা নিস্ক্রিয়তার সুযোগে চলতে থাকে।

স্থানীয় ঢাকুরিয়া যুবতীর্থ ক্লাবের উদ্যোগে কলকাতা পুরসভার অন্তর্গত পরিবেশ এবং হেরিটেজ বিভাগের কাছেও আমরা পুনরায় আর্জি জানাই এই জলাশয়টির সংস্কারের কাজ দ্রুত সম্পাদনের জন্য। 

             ১৩/০৯/২০২২ তারিখে কলকাতা পুরুসভার মহানাগরিকের কাছে  ২০১৫ সালের টেন্ডারের উল্লেখ করে জলাশয়টির সংস্কারের কাজ বন্ধ হওয়া সম্পর্কে অবহিত করা হয় এবংব্যরো X এর- ৯২-নং ওয়ার্ডএবংব্যরো  XI ১০৪ নংওয়ার্ডেরব্যাঙ্কপ্লট-সুইটল্যান্ড-শহিদনগর-এর মধ্যে অবস্থিত জলাশয়টিকে আবর্জনা মুক্ত করার অনুমতি চেয়ে মহানাগরিকের কাছে আবেদন জানানো হয় স্থানীয় ঢাকুরিয়া যুবতীর্থ ক্লাবের পক্ষ থেকে। ‘টক টু মেয়র’-এ অনুষ্ঠানে জলাশয়টির সম্পর্কে জানানো হলে মহানাগরিক Environment and Heritage Dept. -এর- ডেপুটি মহাশয়কে বিষয়টি দেখতে বলেন এবং আমাদের জানানো হয় জলাশয়টি সংস্কার ও সংরক্ষণের প্রকল্প Atal Mission for Rejuvenation and Urban Transformation (AMRUT)র জন্য পাঠানো হয়েছে। 

             গত ২২ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে পুনরায় সমীর মুখুটি মহাশয়ের প্রচেষ্টায় ‘টক টু মেয়র’-এ সরাসরি সাক্ষাতে অঞ্চলের ১০৫, ১০৬, ১০৪, ৯২ নং ওয়ার্ড-এ (গড়ফা-ঢাকুরিয়া-ঝিলরোড-হালতু-কালিকাপুর-সাঁপুইপাড়া) অবস্থিত জলাশয়গুলি সম্পর্কে মাননীয় মেয়র জানিয়েছেন—এই অঞ্চলের জলাশয়গুলির ওপর নতুন করে সমীক্ষা করাহচ্ছে নতুন প্রেমিসেস নম্বর এবং GPS ব্যবহার করে। এর সঙ্গে সঙ্গে যেসব জলাশয়গুলিতে বা জলাশয়ের পাড়ে আবর্জনা বা নোংরা ফেলা হচ্ছে, সেই সব নিক্ষিপ্ত আবর্জনার স্তুপের পার্শবর্তী প্রেমিসেস নং সহ প্রাসঙ্গিক তথ্য কর্তৃপক্ষের কাছে প্রদান করা, যাতে আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়। মেয়র এও জানিয়েছেন যে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের নথিভুক্ত জলাশয়গুলির ওপর কোনো নির্মাণকার্যে পৌরসভার অনুমোদন থাকবে না। স্থানীয়  থানা কর্তৃপক্ষেও এই জলাশয়গুলিকে দূষিত করবার বিরুদ্ধে আইনানুগ সাহায্যের কথা জানিয়েছেন এবং  প্রয়োজনেজলাশয়গুলির চারপাশে এবং সেগুলির মধ্যে কোনো আবর্জনাএবংগৃহস্থালি আবর্জনা ফেলে জলাশয়টি দূষিত ও ভরাট করবার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ১৯৮৪ ইনল্যান্ড ফিশারিজ অ্যাক্টের (সংশোধিত ১৯৯৩) অধীনে ফৌজদারি মামলা রজু করার কথা জানিয়েছেন। 

                ওপরের ঘটনাক্রম সম্পর্কে কলকাতা পুরসভা এবং তার অধীনস্থ ১০ এবং ১১ নং ব্যরো কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় পৌরপিতা (শ্রী তারকেশ্বর চক্রবর্তী) ও পৌরমাতা( শ্রীমতীমধুছন্দা দেব) এবং মহানাগরিকের দপ্তর এবং পুরসভার Environment and Heritage Dept.অবহিত হওয়া সত্ত্বেও গত ১২/০২/২০২৪ তারিখে জলাশয়টির উত্তরাংশে কোবিদ পর্বে ভরাট করা একফালি জমিতে বহুতল নির্মাণের ছাড়পত্র প্রদান করে। এই ঘটনা গভীর উদ্বেগের। মহানাগরিকের বারংবার আশ্বাস সত্ত্বেও এই জলাশয়টি ভরাট করে নির্মাণের ছাড়পত্র প্রদানের অর্থ কর্তৃপক্ষ নিজেই নিজের তৈরি করা আইন লঙ্ঘন করছেন। এই পরিস্থিতি আমরা যারা দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে গণতান্ত্রিকভাবে অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষার লড়াইকে দুরমুশ করার এই রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দু’মুখো নিস্ক্রিয়তা ও সক্রিয়তার নীতি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। নগর কলকাতার উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ দূষণ রোধে জলাশয়গুলিকে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করলেও, বর্তমান পৌর কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে দু’মুখো নীতি আমাদের হতাশ করেছে।

এতদ্সত্ত্বেও আমরা জলাশয়টির রক্ষার্থে বৃহত্তর আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

Comment here