(পূর্বের অংশের পর)
দ্বিতীয় পর্ব –
( এটা হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিশোধ … যখন বিজয়গর্বে মাথা তুলে দাঁড়ালেম —- তখন দেখলেম যে , আমার কিছু নেই । এতদিনের — একটা জীবনের এই যে ব্যর্থতা —- এর চেয়ে বুঝি কারও চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি । —- প্রফুল্ল দাশগুপ্তকে প্রমথেশের চিঠি থেকে )
প্রমথেশ ও অমলা বালা
প্রমথেশের জীবনে যখন বিপর্যয় ঘনিয়ে এসেছে তখনই প্রমথেশের সঙ্গে অমলাবালা দেবী বা ক্ষিতি’র প্রেম। ক্ষিতিদের সঙ্গে প্রমথেশের পারিবারিক পরিচয় ছিলো । ক্ষিতিদের বাড়িতে শিলং এ । সঙ্গত কারণেই প্রমথেশ — ক্ষিতির এই পরকীয়া প্রেম প্রভাতচন্দ্রের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলোনা । তিনি প্রমথেশের মাসোহারা বন্ধ করলেন । অভিমানী প্রমথেশ এরপর গৌরীপুর এস্টেট থেকে আর কোনদিন এক পয়সা নেননি । এরপর প্রমথেশ ক্ষিতিকে নিয়ে কলকাতা চলে এলেন । কলকাতায় প্রমথেশ ক্ষিতিকে নিয়ে প্রবল অর্থকষ্টে পড়লেন । যে কোন একটা চাকরি প্রমথেশ পেতেই পারতেন , কিন্তু নিজের ‘গৌরীপুরের রাজকুমার’ পরিচয় ব্যবহার করে তিনি কোন চাকরি পেতে চাননি । এইসময় দীর্ঘদিন প্রায় অনাহারে কেটেছে তাঁদের । গাড়ির মেকানিক , রেডিওতে খুচরো কাজ করে প্রমথেশ এই সময়ে নিজের পায়ের তলায় এক টুকরো মাটি পাওয়ার চেষ্টা করছেন । এইসময়ে ক্ষিতি একটি সন্তানের জন্ম দেন । এর অনতিকাল পরে ক্ষিতি ছেলেকে নিয়ে প্রমথেশের গৃহত্যাগ করেন । ক্ষিতি যখন প্রমথেশের ঘর ছাড়েন তখন ক্ষিতির টিউবারক্যুলোসিস হয়েছে । ক্ষিতি হয়তো চাননি প্রমথেশ সংক্রমিত হন । এছাড়া অন্যান্য মহিলাকে জড়িয়ে প্রমথেশ ক্ষিতিকে সন্দেহ করতেন । প্রমথেশ এই সময়ে নিজের প্রথম স্ত্রী মাধুরীলতাকে একটি চিঠিতে লিখছেন —-
“মাধুরী,
সুন্দর ছোট্ট লাল গোলাপটির মতো ছেলে —- কেমন পুটপুট করে তাকায় — হাসে…আজ আমার এ দুঃখের ভার কেমন করে সইব কি করে ? — বুক যে ভেঙে যায় ।
তোমায় বলছি কারণ তোমার ছেলে আছে । আমার এ কষ্ট বুঝবে …জানি সবই মায়া — সংসারই মায়া — কিন্তু এই মায়াতেই যা কিছু মধু — যা কিছু মিষ্টি ,রচনা করে । তাইতো আমার মন প্রবোধ মানতে চায়না ।
আমার তো সবই ফুরিয়ে এসেছে । শেষে আবার তোমারই কাছে ফিরে যাব । আজ আমার মান — অভিমানের পালা শেষ হয়েছে । মান – অভিমান করবো কার কাছে — কি নিয়ে ?
বলবার কিছু নেই । ক্ষিতি বোধহয় এতদিনে তার নিজের পথ নিজেই দেখলো । সঙ্গে আমার ছেলেটাকে দৈন্যে টেনে নিয়ে গেল । আমারই ছেলে — আমারই সে — তবু তার ভালো করবার — তাকে সুখে মানুষ করবার অধিকারটুকুও দিলে না আমায় । এত স্বার্থপর —
কিন্তু এ অনুযোগ করব কার কাছে আজ ? এ শুনবে কে ? তাই নিজের ব্যথায় নিজেই গুমরে মরি ।
প্রমথেশ বন্ধু প্রফুল্লকে লেখা চিঠি আরও মর্মান্তিক —-
প্রফুল্ল ,
আমায় এমনি করে ফেলে দিয়ে সে চলে গেল কেন ? আমার এ কষ্ট আর যে সইতে পারি না । বাড়িতে ছেলেটার ঠেলাগাড়ি কাপড়চোপড় সবই যে রেখে গেছে —- চারদিকে আনাচেকানাচে কত যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে । … আমি শুধু এ—ঘর , ও—ঘর ঘুরে বেড়াই — মনটা তাকে খোঁজে … কিন্তু সবই যে ফাঁকা …
ভয় হয় পাগল না হয়ে যাই… মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি —- কিন্তু কি করে সব ভুলে থাকি বলতো ?
আমার যে কিছুই রইল না । মনকে বোঝাতে চেষ্টা করি —- দূর্বলতা — মোহ — কত কি !
ছেলে —- আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে !
প্রমথেশ দুঃখ ভুলতে যাতায়াত শুরু করলেন নিষিদ্ধ পল্লীতে। তবে তার জন্যে লুকোছাপা কিছু নেই । বোন নীহার বড়ুয়াকে সেই কথাই জানিয়েছেন চিঠিতে —-
‘ সংসারের ওপর বিতৃষ্ণায় মন ভরে উঠেছে । এখন তাই এখানে কারও সঙ্গে মিশি না । সংসার আজ যাদের ‘আবর্জনা’ বলে দূরে সরিয়ে রেখেছে তেমনই একটি ‘অপবিত্র’ মেয়ের কাছেই আনাগোনা করি । তার কাছে শুধু সত্যিকারের ব্যবহার একটু পাই —- তাও তো ভালো । হতে পারে অপবিত্র কিন্তু ভণ্ডামির লেশমাত্র নেই ।’
আর একটা চিঠিতে লিখছেন,
‘ একটা গোপন কথা শুনবে ? একটা মেয়েমানুষ বাঁধা রেখেছি । তাকে খুব ভালোবাসি — যতটা একটা ওই ধরনের মেয়েকে ভালোবাসা সম্ভব । ও আমার জন্য সত্যি পাগল হয়ে গেছে । হাসি পায় —- যখন ভাবি — কি রাজত্বই না জয় করলাম । — যা হোক , রোজ সেখানে যাই । আমার ওপর তার এই অদ্ভুত ভালোবাসার খেলা দেখি । বলে আমি চলে গেলে সে পাগল হয়ে যাবে । ( নতুন কিনা তাই) । যাবার সময় গলির মোড় ঘুরেই দেখি সে আলসের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । ছুটে আসে — ছোট্ট ঘরে যত্ন আদরের সীমা নেই । মাঝেমাঝে আমার মুখে বুক লুকিয়ে কাঁদে — আমিও কখনও কাঁদি । —- আবার চোখে জল নিয়েও সে হাসে আর মুখ চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় । …তখন প্রাণপণ চেষ্টায় তার শত আবর্জনার মাঝখান থেকে নিজের যা কিছু পবিত্র , তাই সে বুকের মধ্যে বিলিয়ে দিতে চেষ্টা করে ।
আবার বিভূতি মুখার্জিকে লেখা চিঠিতে বলছেন ।
‘ ভেবে দেখেছি আমার সমাজে আর সান্ত্বনা নেই । যাকে নিয়ে আমার সমাজ , আমার সংসার গড়ে তুলেছিলাম , যাকে আমার সবই দিয়েছিলাম সেই চাইলে না আমাকে , আমার মতো করে । তাই সমাজের ‘আবর্জনায়’ আশ্রয় নিলাম । তাছাড়া আমার যাবার তো আর আশ্রয় নেই । মাঝেমাঝে সেখানকার কদর্যতায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে । সংস্কার বল , শিক্ষা বল , রুচি বল , —– তারা বিদ্রোহ করে উঠতে চায় । তাদের মুখ চেপে ধরি । আবার তারা ঘুমিয়ে পড়ে । এখন আমার এই ঘুমপাড়ানোর খেলা চলছে ।
ইচ্ছে করে সিতারাকে ছেড়ে চলে আসি । কিন্তু পারিনা । আমার জন্য পরে যদি একটু আনন্দ পায় —- এখনও — তাই আমার আজ দাঁড়িয়েছে একমাত্র ছল । ক্ষিতির ওপর অভিমানে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলাম — মদ খেতে আরম্ভ করেছিলাম তা তো জানই । কেউ তোমরা আটকাতে পারতে না । আটকালে গিয়ে সিতারা । যখন ওর কাছে যেতে আরম্ভ করলুম , ও প্রথম ছাড়ালে মদ । বন্ধুরা করলে ঠাট্টা — বুঝলে না যে মদের চেয়ে আরও একটা বড় নেশার জন্য মদের নেশাটা কাটালুম … আজ তাকে ছাড়ি কেন ? আর আমি ছাড়লেই বা সে ছাড়বে কেন ?ভালোবাসার মর্ম হয়তোবা ওরাই বুঝবে…
তীব্র আত্মগ্লানিতে ভুগে নিজের বাবাকে লিখছেন,
‘ গৌরীপুরে যাব না , এ কথা বলতে পারিনা । লজ্জা করে । তাছাড়া অনেক কিছু লজ্জাইতো পেয়েছি — হয়তো বা এটাও পেতে হতে পারে । সে যখন যেতে বাধ্য হব তখন দেখা যাবে । এখন আমার কথা কিছু বলি ।
কিছুদিন আগে নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সব কিছু আশা বিসর্জন দিয়েছিলাম । সম্মুখে শুধু একটা ব্যর্থ ইতিহাস নিয়ে বুক ফুলিয়ে চলা যায় না । তাই মাথা বোধহয় সংসারের কাছে চিরকালের জন্যই নীচু করে নিয়েছি । ভাবলে কিছু কুলকিনারা পাওয়া যায় না — তাই ভাবিনা । ফলে নৈতিক অধঃপতন । তারই মধ্যে নিজেকে যতটা হীনতা থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করি — যাকে বলে meanness । এখন একমাত্র সম্বল হচ্ছে তাই ।…
এক অদ্ভুত আত্মধ্বংসী প্রবণতা তাঁর । নিজের বাবাকে ওই চিঠিতেই লিখছেন —-
ছেলে হবার আগে বিয়ে না করে — যে বিশ্বাসটা হারিয়েছি তার ফলে এই অধঃপতন । প্রতিজ্ঞা করেছি যে এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব নিজের সর্বনাশ করে । তাই ডেলিবারেটলি নিজেকে ডিজেনারেট করছি এবং করব । বিয়েটা করতে চাই যে তাহলে মনকে একটুও তো প্রবোধ দিতে পারব । যে জিনিসটা আমি সবচেয়ে ঘৃণিত ও মিন —- নীচ ভাবতাম সারকামস্টেনশিয়ালি আমি তারই জন্য রেসপনসিবল । আমা দ্বারা তা কৃত হয়েছে । এটার কোন এক্সকিউজই মনকে দিতে পারিনা । আর যদি বিয়ে করতে না পারি তাহলে আত্মহত্যা করব — এটাও ডেফিনিট । আর এতে আমার লাভ নেই — শুধু একটা ট্রায়াম্ফ ওভার অ্যাডভার্স সারকামস্ট্যান্সেস — ইনক্লুডিং অ্যাডভার্স ইমোশনস — শুধু এই । নিজের মনের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে এটা প্রায় কর্তব্য বলেই দাঁড় করিয়েছি । এটা যদি আমার প্রিন্সিপাল ইনকন্সিসট্যান্ট — তবুও ভেবে দেখলে হয়তো বা কারণটা বুঝতে পারা যাবে ।
প্রমথেশের আশ্রয় ছেড়ে ক্ষিতি আশ্রয় নেন গৌরীপুরের প্রাসাদে । তখনও নিজের প্রথম স্ত্রী মাধুরীকেই তিনি ক্ষিতিকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য লিখছেন ।
মাধুরী ,
তোমার চিঠি পেয়েছি । গৌরীপুরের ঠিকানায় এ চিঠির জবাব দিচ্ছি কারণ তোমরা হয়তো এতদিনে বাড়ি ফিরবে ।
ক্ষিতি গৌরীপুরে গিয়েছে — রাজবাড়ির বাইরে স্টাডিতে আছে । অনন্ত কলঙ্কের পসরা ওর মাথায় তুলে দিয়েছি । একটা নারীর যত দূর দুর্গতি একটা পুরুষের করা সম্ভব তা আমার দ্বারা হয়েছে ।
( এই সময়ে একটা অত্যন্ত রূঢ় কথা বলব যদি পারো তো ক্ষমা কোরো । )
সমাজের চোখে দশজনের চোখে ক্ষিতি আজ পতিতা — কিন্তু ভগবানের চোখে, আমার চোখে সে আমার স্ত্রী । যেমন তুমি । কষ্ট পেয়োনা লক্ষ্মীটি । এটা সত্য কথা । আমি ওকে অন্য চোখে কোনদিন দেখিনি বা ক্ষিতিও আমাকে অন্যভাবে দেখেনি । সে কথা যাক — তোমার অপমান হলে আমি যেমন কষ্ট পেতাম — আজ ক্ষিতির এই অপমানে তেমনই কষ্ট পাচ্ছি ।
গৌরীপুরকেও জানি — সেখানকার মেয়েদের দলকেও চিনি । ক্ষিতির মতো মেয়েকে নিয়ে আজ গৌরীপুর কী আন্দোলনেই না মেতেছে তাও বুঝতে পারি । তারই আড়ালে যদি সে লুকোবার চেষ্টা করে তুমি তবে সাহায্য করিও ।
ক্ষিতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সমীকরণ আন্দাজ করা খুবই শক্ত । কখনও তিনি তীব্র আত্মগ্লানি আর অনুশোচনায় ভুগছেন আবার কখনও যাবতীয় কিছুর দায় ক্ষিতির উপরে চাপিয়ে দিয়ে তাঁকে ধিক্কার দিচ্ছেন । ৩০ /০৪/ ১৯৩৩ এ লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলছেন —-
জীবনে মানুষ ভুল করে — করে তার ফলভোগ করে । ভুলটা কোথায় যে হয় সেইটা বুঝতে পারাই শক্ত । তুই কষ্ট পাচ্ছিস — সেটা ঠিক । কাজেই ভুল একটা হয়েছিল । সেই ভুলটা আমার সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে না এসে আমার কথা না শুনে চলে — এর কোনটা তা হয়তো এখনও বুঝতে পারিনি । তার উপর আমার কথায় অবিশ্বাস — কাজে অবিশ্বাস । যাকে সত্যিকারের ভালোবাসা যায় তাকে কখনও কি অবিশ্বাস করা যায়না সেইটা করা উচিত ! আমার সবচেয়ে কষ্ট হয়েছিল যখন বেরিল সম্বন্ধে একটা সন্দেহ করেছিলি । এই সামান্য বিষয়ের থেকে আজ কোথায় এসে দাঁড়াল ।
ফাঁকা ফাঁকা ঘরগুলোতে একা ঘুরে বেড়াই — আর ভাবি —- । কি ছিল আর কি হল । কত আশাই না করেছিলাম — সবই কিন্তু ভেঙ্গে গেল ।
আবার ওই বছরের ২রা মে’র চিঠিতে লিখছেন —
এখনও কী বুঝতে বাকি আছে যে আমি ছাড়া তোর গতি নেই ? নিজের একটা শক্তি আছে ভেবেতো নিজের সর্বনাশের চূড়ান্ত করেছিস । এখনও কী নিজের শক্তি পরীক্ষা করবার — নিজের পায়ের ওপর নিজে দাঁড়াবার শখ আছে ? … চরিত্র সম্বন্ধে অহংকার করার তোরও কিছু নেই ,আমারও কিছু নেই । তুইও অন্য পুরুষ খুঁজেছিলি , আমিও তাই অন্য নারী খুঁজেছি । তুই হয়তো পাসনি ( বা পেয়েছিস আমি তা জানিনা ) কিন্তু আমি পেয়েছি । পাপ যা হওয়ার তা তোরও হয়েছে আমারও হয়েছে । এইটে বুঝে আমারই ব্যবস্থা মতো চলবার ইচ্ছে যদি থাকে তাহলে চলতে পার। …
দেওয়ানজি কে তোর ব্যবস্থার কথা বলে দিলাম । ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করে যাস । ক্ষিতিকে ভুলতে যখন তিনি সিতারার কাছে আশ্রয় খুঁজছেন তখন আবার বন্ধু বিভূতি চক্রবর্তীকে লিখছেন —
ফিরে যাওয়া ? ক্ষিতিকে আবার পেতে ইচ্ছে করে । কিন্তু সে পাওয়া যে আর হবেনা । তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে সিতারা । একেই বলে অদৃষ্ট।
অভিশাপ কুড়িয়েছি ক্ষিতির । কিন্তু সে পাওয়া আর হবে না । তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে সিতারা। একেই বলে অদৃষ্ট ।
অভিশাপ কুড়িয়েছি ক্ষিতির । যখন অভিশাপ দিয়েছিল তখন হয়েছিল অপমান,অভিমান । কারণ তখনও অন্যায় করিনি যাতে অভিশাপ পেতে পারি ।… আজ সে অন্যায় করেছি তাই ওপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করি সে অভিশাপ লাগুক ।
একই সময় ক্ষিতিকে লিখছেন —
তোর নিজের কোন চিঠি কদিন থেকে পাইনি । আশা করি ভালোই আছিস ।
আমার নিজের তো ভালো মন্দের কোন বালাই নেই । বেঁচে আছি । দিনের পর দিনগুলো আসে — যায় । হেসে কেঁদে কেটে তো যায় ।
খালি ভাবি — তুই একি করলি ?
একই দিনে পাপবোধে তাড়িত হয়ে স্ত্রীকে লিখছেন ।
‘ বাপ , ছেলে , স্ত্রী — বন্ধু সংসার — সবারই বাইরে আমি । সংসারের সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ — এক মেয়েকে বার করে আনা — ঘটনাচক্রে সেটাই আমার দ্বারা হয়েছে । এর প্রায়শ্চিত্ত করছি — আমার নিজের সর্বনাশ করে । আজ আমার মতো নীচ আর কেউ নেই । সংসারের আবর্জনার মধ্যে দিনরাত বাস করছি ।
এই সময়েই প্রমথেশের যক্ষা ধরা পড়ে । চিকিৎসার জন্য বিদেশযাত্রা করেন তিনি । একই সময় ক্ষিতিও আক্রান্ত হন যক্ষায় । বিদেশ থেকে লেখা তাঁর বিভিন্ন চিঠিপত্রে আমরা দেখি ক্ষিতি’র প্রতি তিনি অনেক সহানুভূতিশীল । একটি চিঠিতে দেখি ক্ষিতিকে তিনি লিখছেন —-
কতদিন পরে আমি ছুটিতে যাচ্ছি — নিজের শরীরের অবস্থাতো দেখছিস — ওখানে থাকলে খাটতে খাটতে মরতে হয় — তাই শরীরটাকে ভালো করার চেষ্টা করব । তোর তো নিজেই জোর করে পাঠানো উচিত ।
ছেলেমানুষী করিসনা । তুই ,আমি আর বাচ্চা নিয়েইতো আমাদের সংসার । এই তিনটেকেই বাঁচিয়ে রাখতেই দেবে । বুঝলি ?
বিদেশে বসেও বারবার মনে পড়ছে তাঁর নিজের সন্তানের কথা । স্ত্রী মাধুরীকে লিখছেন —
‘ বুড়ো সিঁড়িতে আমায় ধরে বলেছিল –’ বাবা — মাকে ফেলে যাস না ।’ ভাবলাম , বলি — ‘ওরে সেকথা কি আমায় তোর কাছ থেকে শিখতে হবে ।’ কোথায় ছিলো বুড়ো যেদিন শিলং থেকে ফেরবার পথে সেই ট্রেনে ঝড়জলের ভেতর তুই এসে আমার বুকে পড়েছিলি । তুই সব হয়তো ভুলে যেতে পারিস —- কিন্তু আমি পারিনা ।
অবশেষে বিলেতে বসেই পেলেন সেই দুঃসংবাদ যে ক্ষিতি আর নেই। নিজের একমাত্র সুহৃদ বিভূতি চক্রবর্তীকে চিঠি দিয়ে জানালেন —-
Dear Bibhutida,
I am posting this letter by ordinary mail and I am travelling by air mail this Sunday . This will be required in case there is any mishap to the aeroplane and I die .
Yes death seems to be so possible . Never before did I realise this truth more than I do today .However to come to the point —
My main worry is Buro — Arup . Whatever she is , my wife is his stepmother and I do not know how things will go . I have appointed Phani as his guardian in my will and I also request you to have an eye on him . I have got very few friend — You come from Gauripur and know me from my boyhood . If you have any affection towards me then show it by transferring it to Buro .
If Jamuna requires any help or advice , please give to her . Don’t hate her . She was born bad but she is good .
এখানে উল্লেখিত যমুনা হলেন যমুনা বড়ুয়া ,সে যুগের প্রখ্যাত অভিনেত্রী । যমুনাদেবীকে প্রমথেশ পরে বিয়ে করেছিলেন , সে কথায় পরে আসবো । বুড়ো , প্রমথেশ — ক্ষিতির একমাত্র ছেলের দায়িত্ব মাধুরী দেবীই নিয়েছিলেন । এই অধ্যায় শেষ করব নিজের অকালমৃতা স্ত্রীকে লেখা প্রমথেশের একটি চিঠি দিয়ে ।
‘ You have left me , — You went away on the 11 th Sept . and I arrived back on 24 th . You died with my name on your lips — yours husband’s name — and if there is God , He will look after you and give you peace and happiness which you so rightly deserve…
You have left me alone with Buro’s responsibility on my shoulders . I have found him quite happy with Madhuri . So I left him there . Do you remember — once you said you would rather kill Buro than to let Madhuri have him . But if you can see , you will correct yourself . He is better off and God knows , I believe you would have changed your opinion if you would have seen him now . Anyway , don’t worry . I will look after Buro .
উদ্ধৃতি দিয়ে আর দীর্ঘায়িত করব না । এবারে আমরা প্রমথেশের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করব ।
ছবি: বিখ্যাত বাংলা ছায়াছবি দেবদাস (১৯৩৫) প্রমথেশ ( দেবদাস ) , অমর মল্লিক ( চুনীলাল ) এবং চন্দ্রাবতী দেবী ( চন্দ্রমুখী)
(ক্রমশঃ)
অনিন্দ্য গৌতম পেশায় পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনিক কৃত্যকের একজন আধিকারিক। বর্তমানে পুরুলিয়া জেলায় উপশাসক এবং উপসমাহর্তা পদে কর্মরত। মূলত অন্তর্জালে লেখালেখি করেন।
Comment here