আঙিনা

দেশ – ১০

– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়

 

এবার পুরোনো দিনের কয়েকজন শিল্পীদের একটি বা দুটি গানের একটি বা দুটি লাইন মনে করাবো। ইলা বসু – কতো রাজপথ জনপথ ঘুরেছি, ছোট্ট করে বলতে গেলে গল্প শেষ। উৎপলা সেন – এই মনটাই করে যত গোলমাল, প্রান্তরের গান আমার। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় – একটি গান লিখো আমার জন্য, বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই। সুমন কল্যানপুর – মনে কর আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে। মাধুরী চট্টোপাধ্যায় – ওই যে সবুজ বন বিথীকা, দূর দিগন্তের। আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায় – ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা। অমল মুখোপাধ্যায় চুপ চুপ লক্ষ্মীটি শুনবে যদি গল্পটি। জগন্ময় মিত্র – চিঠি। তালাত মামুদ। আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়, রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে কি হবে তোমার। সুবীর সেন – এতো সুর আর এতো গান।

রেডিওতে একটি ‌অনুষ্ঠান ফিবছর হত, তবে বছরে এক দিনই। মহিষাসুরমর্দিনী শুনতে মহালয়ার আগের দিন সুনিশ্চিত ভাবে নতুন ব্যাটারি কেনা হত।এটি বেতারে প্রচারিত জনপ্রিয়তম অনুষ্ঠান । এর ব্যাপ্তি বাংলা ছাড়িয়ে, ভারত ছাড়িয়ে বিদেশ পর্যন্ত। প্রণাম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

সেই সময় যাঁরা সংবাদ পরিবেশন করতেন তাঁদের মধ্যে বিজন বসু , বিভূতি দাস ও নীলিমা সান্যালের নাম এখনো মনে আছে। তখন দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে খবরের কাগজ পৌঁছত না, সেই সব মানুষ জন দের কাছে রেডিওর সংবাদ দেশ বিদেশের খবর পৌঁছে দিত। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্যান্যরা অনেক পরে এসেছেন। তখন শুধু গ্রামে নয় শহর, টাউনে সবার বাড়িতে রেডিও সেট থাকতো না। খবর বা অন্য কোনো ‌অনুস্ঠান শোনার জন্য লোক জন কোনো বাড়ির দালানে জড়ো হতেন। দুপুরে মহিলা মহল পরিচালনা করতেন বেলা দে। শুক্রবার রাত ৮ টায় শুরু হত নাটক। আর একটি আকর্ষনীয় অনুষ্টান। পাড়া পড়শীদের ভীড় লেগে থাকত। সবাই মিলে না শুনলে মন খারাপ হত।

নাটক বেতারের একটি সম্পদ। ছোটবেলায় শোনা কয়েকটি নাটকের নাম আজও মনে আছে। রবীন্দ্রনাথের ডালিয়া, ডাকঘর। নদীর নামটি রঞ্জনা, শাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিরাজদৌল্লা ইত্যাদি ১৯৫৭ সালে ১ম এপ্রিল আকাশবাণী নাম টি রাখা হল অল ইন্ডিয়া রেডিও র পরিবর্তে।

কলকাতা বেতারে প্রথম বাংলা নাটক প্রচারিত হয় ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের লেখা ‘নরনারায়ণ’ ১৯২৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাত ৮টা ৪৫। নাটকটির নির্বাচিত অংশের ও কর্ণের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শিশির ভাদুড়ী। একবার রেডিওতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ নাটকটি অভিনীত হয়। সেখানে অভিনয় করেন বিভিন্ন লেখক। যেমন, প্রমথনাথ বিশী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু, সজনীকান্ত দাস, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও পরিমল গোস্বামী। গিরিশ ঘোষের ‘প্রফুল্ল’ নাটকে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় আরো অনেকে ছিলেন।

বেতার নাটকে কলাকুশলীদের কোনরূপ শারীরিক উপস্থিতি বা বড়ি ল্যাঙ্গোয়েজ প্রদর্শন করার উপায় নেই , শুধুমাত্র তাদের ভয়েস মডুলেশন করা সংলাপ শুনেই তাদের বয়স, পারিবারিক , সামাজিক পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, নাটকীয় দ্বন্দ্ব সংঘাত, ইত্যাদির ধারণা মনে গেঁথে নিতে হত। শিল্পীরা শুধুমাত্র বাচিক অভিনয়ের মাধ্যমেই স্ব স্ব চরিত্র রূপায়িত করেন। বেতার নাটকের বিস্তৃতি অনেক, কারণ তা একই সময়ে শহর বন্দর গ্রাম সর্বত্র অগণিত শ্রোতার কাছে পৌঁছে যায়।

বেতার নাটকের এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে বাংলা থিয়েটার বা চলচ্চিত্র উভয় জগতের রথী-মহারথীরা জড়িয়ে৷ একদিকে আকাশবাণীর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-শ্রীধর ভট্টাচার্য, অন্যদিকে থিয়েটারের শম্ভু-অজিতেশ-তৃপ্তি-রুদ্রপ্রসাদ, চলচ্চিত্রের বিকাশ রায়, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি স্যান্যাল, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ছায়া দেবী— এঁদের নাটক শোনার আগ্রহ আজও বিন্দুমাত্র কমেনি৷

একজন বেতার অভিনেত্রীর নাম এখনো মনে আছে। শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেক পুরোনো নাটক হারিয়ে গেছে বা রেকর্ডিং নস্ট হয়ে গেছে। পুরোনো নাটকগুলো ডিজিটাইজেশন করা শুরু হয়েছে। আশা করা যায় অনেক অমূল্য সম্পদ সংরক্ষিত হবে। এই নাটকগুলোর বিরাট চাহিদা আছে। শুনেছিলাম ‌অজিতেশ বাবুর কিছু নিকটজন ওনার নাটকগুলো উদ্ধারের চেষ্টায় আছেন। পরবর্তি প্রজন্ম তো জানলোই না কন্ঠস্বর ক্ষেপন কাকে বলে।

খেলার ধারাবিবরণী শোনার জন্যে যাদের বাড়িতে রেডিও আছে সবাই সেখানে এসে ভিড় করত। রেডিওতে ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী শোনা ছিল বাঙালীদের একটা বিরাট আকর্ষণ। প্রথম দিকে ধারাবিবরণী হত শুধু ইংরেজিতে। ১৯৩০ সাল থেকে সেটা শুরু হয়েছিল। পঞ্চাশ-ষাট দশকে ইংরেজিতে ক্রিকেট খেলার ধারাবিবরণী দিতেন বেরি সর্বাধিকারী আর পিয়ার্সন সুরিটা – পরে শরদিন্দু সান্যাল, বিজয় মার্চেন্ট, প্রমুখ যোগ দেন।

বাংলা ধারাবিবরণী নিয়মিত শুরু হয় ফুটবল খেলা দিয়ে। ১৯৫৭ সালে মোহনবাগান আর রাজস্থানের খেলার ধারাবিবরণী দেন অজয় বসু এবং পুষ্পেন সরকার। এই জুটির জনপ্রিয়তা একসময়ে তুঙ্গে ওঠে। পরে এঁরাই কমল ভট্টাচার্যের সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটের ধারাবিবরণী দেওয়া আরম্ভ করেন। ‘বল আস্তে করে ঝুলিয়ে দেওয়া, ‘ব্যাটে বলে না হওয়া’, ‘মাটি কামড়ে সোজা চার’, খেলার এই সব চমৎকার বর্ণনাগুলো বাংলাতে এঁদেরই আমদানি। এখন কথাগুলো শুনলেই চোখের সামনে পুরো ব্যাপারটা ভেসে ওঠে।

কলকাতা ক এ বাংলা তে আর খ এ ইংরেজীতে খেলার ধারাবিবরণী হত। কলকাতা গ তে বিবিধ ভারতী, হিন্দি গান। শিক্ষা প্রচারে রেডিওর অবদান অনস্বীকার্য। ক্রিকেটের সুবাদে আমরা অস্ট্রেলিয়ার শহর গুলোর নাম জানি। সিডনি, ব্রিসবেন, পার্থ, মেলবোর্ন, এ্যাডিলেড, ক্যানবেরা। ম্যাপে দেখবেন এগুলো সব উপকূলে অবস্থিত। ভারতের থেকে আয়তনে বড়। কিন্তু দেশের মাঝখানে Grassland. জনবসতি খুব কম। তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল খোলা সম্ভব ছিলনা। রেডিওর মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হত।

কদিন আগে কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন গেল। অনেকে অনেক কিছু লিখলেন। আমি ওনার লেখা ‘ক্যাম্পে’ কবিতার দুটো লাইন উল্লেখ করছি, ‘..সারা রাত শিকারিরা আগুন জ্বেলেছিল, এখন ভোরের আলোয়, আগুনের রং মোরগ ফুলের মত লাল নেই আর হয়ে গেছে রোগা শালিখের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছের মত।’ সুনীল গাঙ্গুলি বলেছিলেন এই লাইনগুলো ওনার আগে পৃথিবীর কোনো কবি ( সবাই কে মনে রেখে বলছি) লিখতে পারেন নি। চিন্তা করুন , একটি খুব গরীব ঘরের মেয়ের হৃদয়ের ইচ্ছে কখনো রঙিন হয়না, হয় বর্ণহীন।

একটা প্রশ্ন বিখ্যাত সাহিত্যিক সন্তোষ কুমার ঘোষের লেখা উপন্যাস ‘কিনু গোয়ালার গলি’ কি জীবনানন্দের জীবনের ছায়া অবলম্বনে লেখা?

(ক্রমশঃ)

 

 

(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে পেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)

Comment here