(পূর্বের অংশের পর)
তৃতীয় পর্ব –
( I fall upon the thorns of life I bleed .— P. B Shelly )
প্রমথেশ ও নিউ থিয়েটার্স
বড়ুয়া ফিল্মস উঠে যাওয়ার পর নিঃস্ব রিক্ত প্রমথেশের কাছে বি এন সরকারের নিউ থিয়েটার্সে যোগদান করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না । প্রমথেশ বড়ুয়া ফিল্মসে তাঁর অর্ধসমাপ্ত চিত্রনাট্য অনাথ নিয়ে নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে তাঁর প্রথম ছবি করলেন । ছবির নাম রূপলেখা । অভিনয় করলেন অহীন্দ্র চৌধুরী , মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং ছবিসুন্দরী । রাইচাঁদ বড়াল ছবির নেপথ্য সঙ্গীতের দায়িত্ব নিলেন । রূপলেখা চিত্রা টকিজে ১৯৩৪ সালের ১১ ই এপ্রিল মুক্তি পায় । বাংলা ছবির দর্শক এই ছবিতেই দেখল বাস্তবধর্মী সংলাপ , থিয়েটারের অতিরেক বর্জিত বাস্তবানুগ অভিনয় । যদিও রূপলেখা বক্স অফিসে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয় , নিউ থিয়েটার্সের কর্ণধার বি এন সরকার কিন্তু প্রমথেশের উপর বিশ্বাস হারালেন না , বরং ছবির খরচের বিষয়ে প্রমথেশকে দিলেন অবাধ স্বাধীনতা । নিউ থিয়েটার্সে প্রমথেশের পরিচালনায় বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের সূচনা হয় । অধিকার , দেবদাস, গৃহদাহ, মুক্তি , রজত জয়ন্তী —- একের পর এক হিট ছবি প্রমথেশের হাত দিয়ে তখন বেরিয়েছে । এর মধ্যে গৃহদাহ ছবিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এই ছবিতে অচলার জুতো পরা পায়ের পরেই আলতা পরা পা দেখিয়ে শহুরে ব্রাহ্ম মেয়ে থেকে গ্রাম্য গৃহবধূতে অচলার পরিবর্তনটি তিনি চমৎকার ভাবে চিত্রায়িত করেন । গৃহদাহের হিন্দি ভার্সনে প্রমথেশের মহিমের বিপরীতে সুরেশের ভূমিকায় অভিনয় করেন পৃথ্বীরাজ কাপুর । এর পরের ছবি মায়া বক্স অফিসে তেমন সাফল্য পায়নি ।
প্রমথেশ বড়ুয়াকে নিয়ে আলোচনা করলে দুটি ছবির আলোচনা আলাদা ভাবে করতেই হবে । একটি ছবি ‘দেবদাস’ এবং অপর ছবিটি হল ‘মুক্তি’ । দেবদাস ১৯৩৫ সালে রিলিজ হয় । প্রমথেশের সঙ্গে এই ছবিতে অভিনয় করেন অমর মল্লিক , মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য , কৃষ্ণচন্দ্র দে । পার্বতীর ভূমিকায় প্রথমে কানন দেবীকে নির্বাচন করা হলেও রাধা ফিল্মসের সঙ্গে চুক্তি ভেঙ্গে কানন দেবী এই ছবিতে অভিনয় করতে পারলেন না । পার্বতীর ভূমিকায় অভিনয় করেন যমুনা । পরবর্তীকালে এঁকে প্রমথেশ বিবাহ করেন । প্রমথেশ কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন । হিন্দি বলায় নিজের অপারগতার কথা মাথায় রেখে প্রমথেশ দেবদাসের হিন্দি ভার্সনে নিজে অভিনয় করেননি । হিন্দি ভার্সনে দেবদাসের চরিত্রে অভিনয় করেন কে এল সায়গল । শরৎচন্দ্রের কাছে ছবির চিত্রসত্ত্ব নিতে গেলে শরৎচন্দ্র প্রমথেশকে বলেন ‘ আমার এত উপন্যাসের মধ্যে আপনি দেবদাসের মতো কাঁচা লেখাকে বাছলেন কেন ?’ উত্তরে প্রমথেশ বলেন ‘ আপনার দেবদাসের সঙ্গে যে আমার ভারি মিল !’ নিজের আত্মধ্বংসী , ডিপ্রেসিভ স্বভাবের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেছিলেন বলেই হয়ত দেবদাস তাঁর অভিনয়ে এমন মূর্ত হয়ে উঠেছিল । দেবদাসের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় এমনই কাল্ট হয়ে গেছে যে পরে উত্তমকুমারকে দেবদাসের চরিত্র অফার করা হলে উত্তমকুমার অভিনয় করতে অস্বীকার করেন ।
এরপরে প্রমথেশের জীবনের অন্য যে ছবিটি বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবী রাখে তা হলো ‘মুক্তি’ । প্রমথেশ যখন ছবির সঙ্গীতপরিচালক পঙ্কজ মল্লিককে চিত্রনাট্য পড়ে শোনাচ্ছেন , পঙ্কজ মল্লিক তখন গুণগুণ করে গাইলেন রবীন্দ্রনাথের ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি নিজের সুরে । গানটি শুনেই বড়ুয়াসাহেব চাইলেন গানটিকে ছবিতে রাখতে । রবীন্দ্রনাথকে চিত্রনাট্য শোনান হল । স্ক্রিপ্টের শুরুতেই ছিল যে নায়কের ঘরে যেতে একটার পর একটা দরজা খুলে যাচ্ছে । রবীন্দ্রনাথ শুনে বললেন ‘লোকটি যেন কিছুর থেকে মুক্তি পেতে চাইছে ।’ সেই থেকেই প্রমথেশ ছবির নাম পেয়ে গেলেন । রবীন্দ্রনাথের কথাতেই ‘ সবার রঙ্গে রঙ মেশাতে হবে’ গানটি ছবিতে অন্তর্ভুক্ত করা হল । এবং সর্বপ্রথম নিজের গানে তালবাদ্য ব্যবহারের অনুমতি দিলেন কবি । ‘মুক্তি’ ছবিতে প্রমথেশ , কানন দেবী ছাড়াও অভিনয় করলেন পঙ্কজ মল্লিক , অমর মল্লিক , ইন্দু মুখার্জি , শৈলেন চৌধুরী এবং মেনকা দেবী । ছবির কাস্টিং এর ব্যাপারে বীরেন্দ্রনাথ সরকার একটু ইতস্তত করলে প্রমথেশ তাঁকে আশ্বস্ত করেন । মুক্তির অনেকটা শুটিং হয়েছিল গৌরীপুরে । ছবির প্রথম দৃশ্যে যেখানে প্রশান্ত একের পর এক দরজা খুলে চলেছে ওটা মাটিয়াবাগ প্যালেসে নেওয়া । বন এবং পাহাড়ী নদীর দৃশ্য পানবাড়ি অঞ্চলে তোলা । প্রমথেশের প্রিয় হাতি জংবাহাদুর এই ছবিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় ছিল । সজনীকান্ত দাসের চিত্রনাট্য , পঙ্কজ মল্লিকের সুর , প্রমথেশ — কাননবালার অভিনয় —- ১৯৩৭ সালের ১৮ ই সেপ্টেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মুক্তি’ আজও বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটা ল্যান্ডমার্ক ।
মুক্তির পর প্রমথেশের পরবর্তী ছবি — অধিকার । অধিকারের গল্প অনেকটা ছকভাঙ্গা । গরীব হলেই ভালো আর ধনী হলেই মন্দ — ভারতীয় ছবির এই চিরাচরিত মিথটিকে প্রমথেশ এই ছবিতে ভেঙেছেন । ছবিতে আমরা দেখি বড়লোক বাপের অবৈধ কন্যা রাধা যখন নিজের পিতৃপরিচয় জানতে পারে সে নিজের জন্মদাতার বৈধ সন্তান ইন্দিরার উপর প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর । এই ছবিতে রাধাকে কিন্তু প্রমথেশ খলচরিত্র হিসাবে দেখাননি , তখনকার নিরিখে যা যথেষ্ট অন্যরকম । ১৯৩৯ সালের ১২ ই জানুয়ারি চিত্রা হলে অধিকার মুক্তি পায় । প্রমথেশ ছাড়াও এই ছবিতে অভিনয় করেন যমুনা দেবী , মেনকা দেবী ,পাহাড়ী সান্যাল , রাজলক্ষ্মী দেবী প্রমুখেরা । ছবিটি বি এফ জে এ পুরষ্কার পায় ।
এরপরের ছবি ‘রজত জয়ন্তী’ কমেডি ছবি । ১৯৩৯ সালে নির্মিত এই ছবিতে প্রমথেশের কমেডিতে অভিনয় দক্ষতা প্রশ্নাতীত ভাবে প্রকাশিত হয়েছে । এই ছবিতে রজত জয়ন্তীকে গভীরভাবে ভালোবাসে ; সে তার ভালোবাসার কথা মাসতুতো ভাইকে জানাচ্ছে হোমিওপ্যাথি ওষুধ ফোঁটা ফোঁটা ফেলতে ফেলতে – ‘ আমি জয়ন্তীকে একফোঁটা দুফোঁটা ভালোবাসি ।’ কিংবা যখন মিথ্যা বর্মার জমিদারের ধাপ্পাবাজ মেয়ে ভালোবাসার অভিনয় বলছে —- ‘রজতবাবু আমার যে মরণও হয় না ।’ ( মলিনা দেবীর অবিশ্বাস্য রকমের ভালো অভিনয় ) আর তার উত্তরে রজতের নির্লিপ্তির সঙ্গে সরলভাবে বলা – ‘কেন ? না , মানে বলছিলাম — কেন মরবেন !’ — কমেডিতে তাঁর অভিনয় দক্ষতা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে । নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে তাঁর যে কেন বিচ্ছেদ হয়েছিল তার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ এখন অনুমান করা শক্ত । কিন্তু নিউ থিয়েটার্সের প্রতি তাঁর ভালোবাসা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল , কারণ তাঁর ইচ্ছানুসারেই তাঁর মরদেহ নিউ থিয়েটার্সের কর্ণধার বি এন সরকারের বাসগৃহের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ।
১৯৪০ সালে কিষাণ মুভিটোনের ব্যানারে তাঁর পরবর্তী ছবি ছিল ‘শাপমুক্তি” । এই ছবির প্রযোজক ছিলেন কে এল দয়ানি । এই ছবিদুই ভাই এক বোনের গল্প । প্রমথেশ বড় ভাইয়ের ভূমিকায় , বদ্রী নারায়ণ ছোট ভাইয়ের ভূমিকায়( ইনি পরে বম্বে চলে যান ) , আর পদ্মা দেবী ছোট বোনের চরিত্রে অভিনয় করেন । ছবির শেষ দৃশ্যে তিনটি চিতা জ্বলতে দেখে দর্শকাসন থেকে সাধারণ দর্শক ‘ বড়ুয়া তুমি একি করলে’ হাহাকার শোনা যেত । এই ছবিটি বাংলার ছবির জগতে অন্য একটি কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে । এই ছবিতেই আত্মপ্রকাশ করেন রবীন মজুমদার এবং সুরকার অনুপম ঘটক ।
রবীন মজুমদার উত্তরজীবনে ‘শাপমুক্তি’-র প্রিমিয়ারের কথা স্মরণ করে লিখছেন —
‘ নিজের টেবিলে এসে যখন বসলাম সামনের টেবিল থেকে জীবেন বসু মুচকি মুচকি হাসছেন আমার দিকে তাকিয়ে । উনিও এই ছবির শিল্পী । ওঁর হাসি দেখে নার্ভাসনেসটা আরও বেড়ে গেল । অস্বস্তি কাটাবার জন্যে টেবিলে রাখা পানীয় ভরা গ্লাসটা তুলে নিয়ে লম্বা করে একটা চুমুক দিয়ে ফেললাম । একরাশ আগুনের হলকা যেন কন্ঠনালী বেয়ে নেমে গেল । সঙ্গে সঙ্গে কাঁধের উপর একটি হাতের স্পর্শ পেলাম । পাশে দাঁড়িয়ে মিস্টার বড়ুয়া । একটু ঝুঁকে পড়ে চাপা কন্ঠে বললেন ঃ নো নো রবীন , নট সো কুইক , আস্তে আস্তে সিপ কর । আই থিঙ্ক দিস ইজ ফার্স্ট টাইম ইন ইওর লাইফ !’
সশ্রদ্ধচিত্তে অগ্রজকে স্মরণ করে লিখছেন —- ‘পরে , অনেক পরে , আমার চিত্রজীবনে যখন মধ্যাহ্ন সূর্যের দীপ্তি , তখন একটা সময়ে আমি ভেসে গিয়েছিলাম ওই তরল পানীয়ের স্রোতে । তখন এক – একটা মুহূর্তে আমার পড়ত মিস্টার বড়ুয়ার কথা , মনে পড়ত তাঁর সতর্কবাণী , কিন্তু তখন তো আর তিনি বেঁচে নেই , পরলোকের সেই প্রান্ত থেকে তাঁর হাত তো আমার কাঁধ স্পর্শ করতে পারত না । তা যদি পারত তবে আমার জীবন অন্যভাবে নিয়ন্ত্রিত হত , আমার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত ।’
অনুপম ঘটকও সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছেন যে তাঁর সুরারোপিত অনেক গানের মুখড়া তিনি বড়ুয়া সাহেবের কাছ থেকে পেয়েছিলেন ।
১৯৪০ সালেই তিনি মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে স্থাপন করেন এম পি প্রোডাকশনস । এম পি নামকরণের পিছনে দুটি কারণ আছে বলে মনে করা হয় । প্রমথেশ এবং মুরলীধরের নামের আদ্যাক্ষরদুটি নিয়ে প্রোডাকশন হাউজের নাম হয় । দ্বিতীয় মতটি হল এই হাউজের প্রথম ছবি মায়ের প্রাণের থেকে এম পি প্রোডাকশনস নামটি দেওয়া হয় । তবে এক্ষেত্রে প্রথম মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয় । ‘মায়ের প্রাণ’ ছবিটি চলেনি । এর পরের ছবি ‘উত্তরায়ণ’ । অনুরূপা দেবীর কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত এই ছবির নায়ক ছিলেন প্রমথেশ , নায়িকা যমুনা । ১৯৪১ সালে নির্মিত এই ছবিও বাণিজ্যসফল হয়নি । প্রমথেশের পরবর্তী হিন্দি ছবি ‘রাণী’ দর্শকানুকূল্য পেতে ব্যর্থ হলে তিনি তীব্রভাবে সমালোচিত হন । সবাই মোটামুটি ধরেই নিয়েছিলেন যে প্রমথেশের চলচ্চিত্রজীবন শেষ হয়ে গেছে । কিন্তু প্রমথেশ পরের ছবিতে দেখিয়ে দিলেন যে তিনি ফিনিক্স পাখির মতো প্রত্যাবর্তনে সক্ষম ।
কানন দেবীও তখন নিউ থিয়েটার্স ছেড়েছেন । প্রমথেশ মুক্তি’র পর আবার কানন দেবীর সঙ্গে কাজ করতে চাইলেন । কানন শর্ত দিলে প্রযোজনার অংশীদার হবেন । রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি শেষ করার জন্য টাকার প্রয়োজন তাঁর । মুরলীধর — প্রমথেশ অরাজী হননি । এরই ফলশ্রুতি হল ‘শেষ উত্তর’ , যার হিন্দি নাম ছিল ‘জবাব ।’শেষ উত্তর’ বক্স অফিসে অসাধারণ জনপ্রিয়তা পায় । এর হিন্দি ভার্সনটিও অনুরূপ জনপ্রিয় হয় । কমল দাশগুপ্তের সুরারোপিত গানগুলি অসম্ভব জনপ্রিয় হয় । ‘অ্যায় চাঁদ ছুপ না জানা’ , ‘তুফান মেল’ ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে । এই ছবির ‘আমি বনফুল গো’ গানটি কমল দাশগুপ্ত বেসিক গান হিসাবে ভেবেছিলেন । গাইবার কথা ছিল আর এক কিংবদন্তি শিল্পী যূথিকা রায়ের । কিন্তু গানটি প্রমথেশের পছন্দ হওয়ায় প্রমথেশ নিজের ছবিতে ব্যবহার করার জন্য গীতিকার প্রণব রায়ের কাছ থেকে চেয়ে নেন । ছবির ভাবনাতেও প্রমথেশ অনেক পরিণত । এই ছবিতে দুই নায়িকার একজন উগ্র আধুনিকা (রেবা ) , অন্যজন ঘরোয়া মিষ্টি মেয়ে ( মীনা ) । একটি দৃশ্যে বক্তৃতা দিতে গিয়ে রেবা বলছে ‘ বনানীর ঘন অন্ধকারে আমরা বনফুল হয়ে থাকতে চাই না ।’ — ঠিক তার পরবর্তী দৃশ্যে মীনা গাইছে ‘আমি বনফুল গো ।’ এখানে একটি গানের সংস্থাপনের মাধ্যমে দুটি চরিত্রের বৈপরীত্য চমৎকার ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে , যা অজস্র সংলাপের মাধ্যমে বোঝানো যেত না । চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের ব্যবহার তখনই শৈল্পিক যখন তা চিত্রনাট্যের অনিবার্য অংশ হয়ে ওঠে । দূর্ভাগ্যের বিষয় অধিকাংশ ভারতীয় চলচ্চিত্রে সঙ্গীত এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে না , তখন সঙ্গীত চিত্রনাট্যের অপরিহার্য অংশ নয় , তা নয়নশোভন এবং শ্রবণসুভগ হলেও প্রক্ষিপ্ত অতিরেক । প্রমথেশ কিন্তু সঙ্গীতকে চিত্রনাট্যের অপরিহার্য অংশ করে তুলতে পেরেছেন ।
‘শেষ উত্তর’ প্রমথেশের শেষ সফল ছবি , বাণিজ্যিক ভাবে এবং শিল্পসম্মতভাবে । এরপরের ছবি ১৯৪৪ এ রিলিজ হওয়া ‘চাঁদের কলঙ্ক’ ( হিন্দিতে ‘সুবহ শ্যাম’ ) । এই ছবির থেকেই প্রমথেশের ছবির ক্রমাবনতির সূত্রপাত । এরপরে তিনি কতগুলি অকিঞ্চিৎকর হিন্দি ছবি করেন — ‘পেহচান’ , ‘ইরান কি এক রাত’ , এবং সর্বশেষ ছবি ‘আমিরি’ । তাঁর অর্ধসমাপ্ত বাংলা ছবি ‘মায়াকানন’ তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তি পায় । ছবিতে প্রমথেশের অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করেন বিভূতি মুখার্জি ।
শেষ জীবনে প্রমথেশ অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন । এতদিন ধরে স্ব-আরোপিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর রুগ্ন শরীর বিদ্রোহ করে উঠেছিল । ১৯৪৮ সালের ১৫ ই মে প্রমথেশ বিলেতে পৌঁছলেন চিকিৎসার জন্য । ইংল্যান্ডে ভারতীয় হাই কমিশনার ভি কে কৃষ্ণ মেনন তাঁকে সংবর্ধিত করেন । সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হার্বার্ট মার্শাল , জেমস রবার্টের মতো ব্যক্তিত্বরা । কৃষ্ণ মেননের উদ্যোগে ইন্ডিয়া ফিল্ম সোসাইটি পত্তনের পিছনেও প্রমথেশের উদ্যোগ ছিল । ব্রিটিশ কিনেমাটোগ্রাফিক সোসাইটির তিনি প্রথম ভারতীয় ও অইউরোপীয় সদস্য ছিলেন । একটু সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে প্রমথেশ দেখলেন তিনি দেনার দায়ে জর্জরিত । এস কে ঘোষের করা মামলার ফলশ্রুতি স্বরূপ একবার তাঁর বাড়িতে পুলিশি তল্লাশি হয় । প্রমথেশের ভগ্নস্বাস্থ্য আর নিতে পারছিল না । ১৯৫১ সালের ২৯ শে নভেম্বর প্রমথেশ মারা যান । তাঁর অন্তিম যাত্রায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোক তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন ।
শিকারী প্রমথেশ —- প্রমথেশ নিজে খুব ভালো শিকারী ছিলেন । এগারো বছর বয়স থেকে প্রমথেশ শিকার করতে আরম্ভ করেন । মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি বাঘ শিকার করেছিলেন । আমৃত্যু তাঁর শিকার করা বাঘের সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছিল । অল্প বয়সে পাঁচশো টাকা জরিমানা দিয়েছিলেন গন্ডার শিকার করেছিলেন বলে । গৌরীপুরে তাঁর পোষা দুটি হাতি ছিল — জং বাহাদুর আর বিজয়লাল । প্রমথেশের ভাই প্রকৃতিশচন্দ্র ( লালজী) হাতি বিশেষজ্ঞ ছিলেন , কিন্তু বিজয়লালকে তিনি পোষ মানাতে পারতেন না । এত শিকার করলেও তিনি কখনও ঘুমন্ত বা বিশ্রামরত বা অসতর্ক শিকারকে হত্যা করেননি । তিনি শিকার করার সময় পকেটে নুড়ি নিয়ে যেতেন । নুড়ি ছুঁড়ে শিকারকে সতর্ক করার পর তারপর তাকে ধাওয়া করে তিনি হত্যা করতেন । এত সাহসী শিকারী মানুষ কিন্তু অন্যসময় আরশোলা দেখলে সাংঘাতিক ভয় পেয়ে যেতেন । তিনি খাদ্যাভ্যাসেও ছিলেন নিরামিষাশী । মাছ বা মাংস তাঁর পছন্দের খাবারের তালিকায় ছিল না।
প্রমথেশ ও রাজনীতি —- ১৯২৬ সালে প্রমথেশ আসাম লেজিস্লেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন । তদানীন্তন ভাইসরয় , যিনি প্রমথেশের পিতা প্রভাতচন্দ্রের বন্ধু ছিলেন , তিনি ভেবেছিলেন যে গৌরীপুরের রাজকুমার ইংরাজদের প্রতি অনুগত হবেন । কিন্তু তা হয়নি । তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের দাসের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং এরই ফলস্বরূপ ১৯৩০ সালে তিনি মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন । ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত স্বরাজ্য পার্টির প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল , যদিও চলচ্চিত্রই তাঁর ধ্যানজ্ঞান হওয়ায় তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন । স্বাধীনতার পর ভারতের অন্যান্য রাজবংশের প্রতিনিধিদের যে ডেলিগেশন দিল্লির কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে দেখা করতে যায় প্রমথেশ তাঁর সদস্য ছিলেন । এই ডেলিগেশনের যাবতীয় দাবী তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার মেনে নেয় । এর অনতিকাল পরেই প্রমথেশ সুইজারল্যান্ড চলে যান চিকিৎসার জন্য ।
(ক্রমশঃ)
অনিন্দ্য গৌতম পেশায় পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনিক কৃত্যকের একজন আধিকারিক। বর্তমানে পুরুলিয়া জেলায় উপশাসক এবং উপসমাহর্তা পদে কর্মরত। মূলত অন্তর্জালে লেখালেখি করেন।
Comment here