‘কাঞ্জিক’- র প্রকাশের আরম্ভ হতেই প্রায় শ্ৰীমতী ইমারুন নাহার রয়েছেন তাঁর প্রবাদ, প্রবচনের বিপুল সম্ভার নিয়ে। লোক সংস্কৃতি, অভিজ্ঞতার গর্ভ হতে উঠে আসা এই সকল বাক্য প্রবাদপ্রতিম; বহু শ্রমের মাধ্যমে তা একত্র করেছেন ইমারুনদি, তার আবেদন শাশ্বত। আমরা কৃতজ্ঞ তাঁর প্রতি।
আজ রইলো শ্রদ্ধেয়া ইমারুনদির নিজস্ব কিছু বক্তব্য।
নিজের কথা – “গত শতকের সত্তরের দশকে গ্রাম বাংলার আর পাঁচটা মেয়ের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা ইমারুন নাহারের। পুরুষ-প্রধান সমাজে মেয়েরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, তাদের যে অধিকার বলে কিছু আছে সে বোধটাই তাদের ছিল না। রাঁধার পরে খাওয়া, খাওয়ার পরে রাঁধা এমনি করেই কেটে যেত তাদের বেলা। স্বাধীনতা, নিজস্ব চিন্তা নিজস্ব ভাবনা বলে তাদের কিছু ছিল না। তারা যেন পরগাছা, পরের অধীনে তাদের জীবন। ..নিজে মেয়ে হয়ে এই সব দেখতে দেখতে মনটা যেন কখন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
প্রবাদ –
১) হাবায় গোবায় বিধান দেবে
বাঁদরেতে দেখবে পাঁজি,
মানীর থাকবে না মান,
পাশ পাবে ন্যায়ের মাঝি।
(কলিকালে যে কিছু জানে না, সে বিচারক হবে, বোধ বুদ্ধিহীন লোক ভালো মন্দ ঠিক করবে, মানী লোকের ম্যান সম্মান থাকবে না, অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হবে, তবুও শেষ পর্যন্ত ন্যায়েরই জয় হবে।)
২) নারীর বল
চোখের জল
(নারীরা পুরুষের কাছে চোখের জলে সবকিছু জয় করে।)
৩) হাল যদি ধরে ঠেসে
যায় কি তরী তুফানে ভেসে
(কর্তা যদি ঠিক থাকে, তাহলে কার্য বিফল হয় না)
৪) হাতীর কাঁধে আসেন যায়
হাম্বা রবে মূর্ছা যায়
(বড় কাজ নির্ভয়ে করে, ক্ষুদ্র কাজে ভয়)
৫) সহিলে সম্পত্তি
না সহিলে বিপত্তি
(দুঃখ কষ্ট সহ্য করে থাকতে পারলে উন্নতি লাভ হয়, আর দুঃখে অধীর হয়ে পড়লে বিপত্তি)
৬) লোভে লোহা বয়
(লাভের আশা থাকলে, লোহাও বহন করা যায়। লাভ পেলে লোকে দুরূহ কার্যও সম্পাদন করে)
পুনরায় –
“গ্রাম বাংলার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত প্রবাদ প্রবচন খুব ছোটবেলা থেকেই আমাকে ভাবায়। ছেলেবেলা থেকে এইসব প্রবাদ বাক্য শুনে শুনে আমার বেড়ে ওঠা। মানুষ কথা বলতে বলতে, গল্প করতে করতে সুখে দুঃখে আনন্দে বেদনায় এইসব প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করে। আমার পরিচিত চেনা জানা বয়স্ক মানুষ আমার পরিবার পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় পরিজনদের কাছে এইসব প্রবাদ আমার শোনা। লেখাপড়া না জানা গ্রাম্য মানুষ গ্রাম্য ভাষায় কথা বলতে বলতে সুন্দর সুন্দর প্রবাদ ব্যবহার করে। যা বাংলা ভাষার বিপুল ঐশ্বর্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ঐশ্বর্য থাকলেই হয় না, তাকে রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব, এই বোধ থেকেই প্রবাদ সংগ্রহ করতে থাকি না যা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রাম বাংলার হাটে মাঠে বাটে যারা ঘুরে বেড়ায়, তাদের কাছ থেকেই এইসব প্রবাদ বাক্য আমার বেশী সংগ্রহ করা। খেটে খাওয়া মানুষ, দিন মজুর, ভবঘুরে, ফকির, দরবেশ, মুসাফির গল্প উপন্যাস, রূপকথা, ছড়া যখন যেখান থেকে পেরেছি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছি” – ইমারুনদি।
গৃহবধূ। কৃষিভিত্তিক জীবনে লেখালেখি তাঁর দিনযাপনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী।
গ্রামবাংলার হারিয়ে যেতে বসা সহস্রাধিক প্রবাদের সযতন সংগ্রাহক।
Comment here