প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা।তখন কবিপক্ষে রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে মুক্তমঞ্চে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসর বসতো।নবীন প্রবীণ বহু শিল্পীই উপস্থিত থাকতেন।একএকদিন এক এক পর্যায়ের গান পরিবেশিত হতো। মঞ্চের পেছন দিকে একটি ঘেরা মতো জায়গায় দেখতাম দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়,প্রসাদ সেন,বাণী ঠাকুর প্রমুখ শিল্পীরা বসে গান শুনছেন।শুনেছিলাম কোন শিল্পী কেমন গান করেন সেই বিচার করবার জন্যই তাঁরা সেখানে বসেন।ওখানেই দেখেছিলাম মায়া সেনকে।অবশ্য তার আগে মায়া সেনের গানের সঙ্গে পরিচয় ছিলো।দেখেওছিলাম দু একটি অনুষ্ঠানে।আকাশবাণীতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠানে’ গানের ভেলায় বেলা অবেলায়’ ‘এ কি করুণা’, ‘না সজনী না,’ ইত্যাদি গান শুনেছি।ভরাট কন্ঠ,বেশ অভিজাত চেহারা,দেখলেই সম্ভ্রম জাগে – মায়া সেন সম্পর্কে আমার প্রাথমিক ধারনা এইটুকুই।সেই অনুষ্ঠানেই দেখেছিলাম নবীন প্রবীণ বেশ দিকপাল সব শিল্পী মায়া সেনের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করছেন যে তাঁরা ঠিকমতো গেয়েছেন কিনা।জিজ্ঞেস করবেন নাই বা কেন যিনি স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডিং এর ট্রেনার,যাঁর তত্ত্বাবধানে দিকপাল সব শিল্পীরা গান রেকর্ড করেছেন তিনি যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিবেশনের ক্ষেত্রে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন এ তো বলাই বাহুল্য।
মায়া সেন গান গেয়েছেন,বারংবার প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রেকর্ড,কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা এই যে তিনি সারাজীবন রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশুদ্ধতা বজায় রাখবার জন্য ব্যস্ত ছিলেন।শিল্পী মায়া সেন অপেক্ষা শিক্ষয়িত্রী মায়া সেন যেন আরও বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক,বিভাগীয় প্রধান – এসবের পাশাপাশি নিজস্ব সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান আনন্দধ্বনির কর্ণধার হিসেবেও মায়া সেন ছিলেন ভাস্বর।
১৯২৮ সালের ২০ নভেম্বর আসামের কাছাড় জেলার বদরপুরে মায়া সেন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। তাঁর সঙ্গে শিশুকাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন মায়া।
মায়া সেনের কাকা ছিলেন দীনেশ গুপ্ত।দীনেশ গুপ্ত চাইতেন যে মায়া যেন শান্তিনিকেতনে পড়তে যান।সেইজন্য শান্তিনিকেতনে শিক্ষালাভের জন্য তাঁকে পাঠানো হয়।১৯৪৯ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে গান, এস্রাজ,সেতার শিক্ষা শুরু হয়।শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, ভি. ভি. ওয়াঝেলওয়ায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত,অশেষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এস্রাজ ও সেতার শিখতেন।শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবন থেকে তিনি স্নাতক হন।মায়া সেন যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী তখন শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।তৎকালীন উপাচার্য ড. প্রবোধ বাগচীর অনুমতিক্রমে তিনি এম. এ পড়া শুরু করেন।বাংলা সাহিত্যে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন এবং সঙ্গীতভবন থেকে আরও উচ্চপর্যায়ের ফল লাভ করেন।১৯৫৫ সালে শ্রী ত্রিদিবকুমার সেনের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন তিনি।শুরু হলো এই দম্পতির জীবনযাপন।রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে তিনি ছিলেন নিরন্তর প্রয়াসী।১৯৫৫ সালে কলকাতা সঙ্গীত নাটক একাডেমিতে সঙ্গীতশিক্ষিকা হিসেবে মায়া সেন যুক্ত হন।তখন থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কলকাতায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদবোধন করলেন।সেসময় মায়া সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নিযুক্ত হন।
কলকাতায় বালীগঞ্জ প্লেসের কাছে তাঁর বাড়িতে প্রতিষ্ঠা হলো আনন্দধ্বনি সংস্থা।তিনি ও তাঁর স্বামী শ্রী ত্রিদিবকুমার সেন দুজনেই রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রসারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।একদিকে গান রেকর্ড করা এবং অন্যদিকে গান শেখানো – এই দুইএর সমন্বয়ে ধীরে ধীরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে মায়া সেন নিজেই এক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন।তাঁর কন্ঠে যেসব গান রেকর্ডে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘সন্ধ্যা হলো গো ও মা’,’ অন্ধজনে দেহ আলো’,’ দাঁড়াও মন অনন্ত ব্রহ্মান্ডমাঝে’, ‘আজি মম জীবনে’,’ বড়ো বিস্ময় লাগে’, ‘আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার’,’ হে মহাজীবন হে মহামরণ’,’ কেন রে চাস ফিরে ফিরে’,ইত্যাদি।
শুধু কলকাতায় নয় কলকাতার বাইরে বিদেশে বারংবার মায়া সেন আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছেন।পরিবেশন করেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত।ওয়ার্ল্ড ইউথ ফেস্টিভ্যালে ১৯৭৭ সালে পূর্ব বার্লিনে এবং১৯৭৬ সালে লন্ডনে যান তিনি।সুইডেন,নরওয়ে, ইত্যাদি দেশেও মায়া সেন সঙ্গীত পরিবেশন করেন।১৯৭৮ ও ২০০০ সালে তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মায়া সেন সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য গিয়েছিলেন।
ছাত্রছাত্রীরা ছিলেন মায়া সেনের সন্তান। অপালা বসু,শমিতা মুখোপাধ্যায়,বিভা সেনগুপ্ত,জয়তী ঘোষ,ভাস্বতী দত্ত,স্বাগতালক্ষ্মী দাসগুপ্ত,রচয়িতা রায় প্রমুখ শিল্পী ছিলেন তাঁর ছাত্রী।
আনন্দধ্বনির অনুষ্ঠানে বেশ কবার দেখবার সুযোগ হয়েছে আমার।মঞ্চে সমবেত সঙ্গীত পরিচালনা বা অন্যান্য শিল্পীদের একক সঙ্গীত পরিবেশনের সময় হারমোনিয়ামে সঙ্গত করতে দেখেছি মায়া সেনকে।অশীতিপর বয়সেও তিনি ছিলেন সমান কর্মনিষ্ঠ। অজস্র সম্মানে ভূষিত হয়েছেন মায়া সেন।২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ অসুস্থতার পর চিরতরে চলে যান এই অনন্যা শিল্পী ও শিক্ষিকা।আজ তিনি সশরীরে নেই কিন্তু তাঁর শেখানো ধারাকে অনুসরণ করে পথ চলছেন অগণিত ছাত্রছাত্রী।এভাবেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের আকাশে চিরভাস্বর হয়ে রয়েছেন মায়া সেন।
– পেশাগতভাবে সরকারী কর্মী, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েই বাঁচেন, লেখলেখির মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত।
Comment here