সংস্কৃতি

‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী’ – দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়

১৯৬২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি যাত্রিক পরিচালিত ছবি ‘ কাঁচের স্বর্গ’ মুক্তি পেল।নায়কের চরিত্রে দিলীপ মুখোপাধ্যায়।ডাক্তারির ডিগ্রি না পেয়েও সেই নায়ক চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন দূর মফস্বলে এক হাসপাতালে। কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজের পুনর্মিলন উৎসবে উপস্থিত হন সেই নায়ক।কিন্তু সকলের সঙ্গে মিলিত হতে তার সঙ্কোচ,দ্বিধা,ভয়। এমনই এক সময় নেপথ্য থেকে ভেসে আসে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না’।ক্যামেরায় দেখানো হয় সংকুচিত দিলীপ মুখোপাধ্যায়কে আর পাশাপাশি মেডিক্যাল কলেজের সেই বিশাল চত্বরকে এই চিত্রভাষা দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গলাকে সঙ্গী করে জীবন্ত হয়ে ওঠে।

মহানায়ক উত্তমকুমার পরিচালিত শিল্পী সংসদের ব্যানারে রমাপদ চৌধুরীর কাহিনী নির্ভর ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবি মুক্তি পেল ১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি।এই ছবিতে বাংলার বেশ কজন বরেণ্য শিল্পী অভিনয় করেছিলেন।তেমনই একজন বিকাশ রায়।ছবির অন্যতম এক চরিত্র গিরিজাপ্রসাদের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি।এক রিটায়ার্ড হেডমাস্টার গিরিজা তাঁর পরিবার নিয়ে ফিরে আসেন সাধের জন্মস্থান বনপলাশীতে।তাঁর স্বপ্ন এই গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করা।কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্য তাঁর নেই।একা সবকিছু করাও যায় না।বিফল হয়ে গিরিজা খোঁজেন একাকীত্ব।সেইসময় নেপথ্য থেকে ভেসে আসে গান ‘ আমার এ পথ তোমার পথের থেকে অনেকদূরে’।এই কন্ঠ দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের।রেলস্টেশনে গিরিজা একা।ট্রেন আসছে।তার আলো পড়ে গিরিজার মুখে।অনবদ্য দরদ দিয়ে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন গানখানি।

অসিত সেন পরিচালিত ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্তর কাহিনী নির্ভর ‘উত্তরফাল্গুনী ‘ ছবিটি মুক্তি পায় ১১ অক্টোবর ১৯৬৩ তারিখে।প্রেমিক মনীশের ওপর মেয়ে সুপর্ণার দায়িত্ব দেয় পান্নাবাঈ ওরফে দেবযানী। মনীশ ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে দেবযানীর সন্তানকে মানুষ করবার অঙ্গীকার করে।ভর্তি করে কলকাতার নামী স্কুলে।এই সময় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে ‘ আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটির ব্যবহার ছবির এই অংশে অন্যমাত্রা যোগ করে।

১৯৮১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বিজয় বসু পরিচালিত ছবি ‘সাহেব ‘ মুক্তি পায়। এই ছবিতে তাপস পালের লিপে খুব জমাটি ভঙ্গীতে ‘ হারে রে রে রে রে আমায় ছেড়ে দেরে দেরে’ গানটি গেয়েছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।সঙ্গে অরুন্ধতী হোমচৌধুরী তরুণ নায়ক তাপস পালের লিপে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের এই গানটির প্রয়োগ সুরকার অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায় ভারী সুন্দর করে করেছিলেন।

বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্র সঙ্গীতের জগতের যেসব শিল্পী রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভুবনেও সমান জনপ্রিয় তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো হাতা গোটানো শার্ট,ধুতিপরা দীর্ঘদেহী ভরাট কন্ঠস্বরের অধিকারী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত আজও আমাদের বড়ো প্রিয়।রেকর্ডের পাশাপাশি অসংখ্য ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন দ্বিজেন।তৈরী করেছেন বহু ছাত্রছাত্রী। ৭০ বছরেরও বেশী সময় ধরে বাংলা গান ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়।অসংখ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত তিনি রেকর্ড করেছিলেন যা এখনও লোকে শোনেন।

১৯২৭ সালের ১২ নভেম্বর দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের জন্ম।১৯৪৫ সালে সর্বপ্রথম তাঁর আধুনিক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৪৬ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে তাঁর গান প্রথম প্রচারিত হয়।পঙ্কজকুমার মল্লিক,শান্তিদেব ঘোষ,সন্তোষ সেনগুপ্ত,অনাদি ঘোষ দস্তিদার,নীহারবিন্দু সেন,প্রমুখের কাছে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন।ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে যোগদানের পাশাপাশি বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড কর‍্যে শুরু করেন।

গত শতকের চারের দশক থেকে শুরু করে ২০১১ -২০১২ সাল অবধি দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় নিয়মিতভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করতে শুরু করেন।রবীন্দ্রসঙ্গীতে রসিক শ্রোতারা সেই রেকর্ড,ক্যাসেট বা সিডি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা সংগ্রহ কর‍তেন।একটি পরিবারের দুই – তিন প্রজন্ম দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গানে আবিষ্ট হয়ে থাকতেন।তাঁর কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গান প্রবল জনপ্রিয়তা পায়।

এইসব গানগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘ ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়’,’ ‘ তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী’, ‘ অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে’,’ তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে’,’ ও জোনাকী কি সুখে ওই ডানাদুটি মেলেছ’,’ গানের ঝরনাতলায়’,’এসো হে বৈশাখ’,’ চিত্ত পিপাসিত রে’,’ অনন্তের বাণী তুমি’, ‘ ভুলে যাই থেকে থেকে’,’ যতবার আলো জ্বালাতে চাই’,’ একটি নমস্কারে প্রভু’,’ আমি যখন ছিলেম অন্ধ’,’ আপনি অবশ হলি’,’ সফল কর হে প্রভু আজি সভা’,’ তুমি রবে নীরবে’,’ অমল কমল সহজে জলের কোলে’,’ মধুর তোমার শেষ যে না পাই’,’ ওরে চিত্ররেখাডোরে ‘,’ কি পাইনি তার হিসাব মিলাতে ‘,’ তুমি ঊষার সোনার বিন্দু’,’ ‘ যিনি সকল কাজের কাজী’ এবং অবশ্যই ‘ ওই জানালার কাছে বসে আছে’ যে গানটি বোধহয় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের জন্যই কবিগুরু লিখেছিলেন।

সারা জীবনে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বিশিষ্ট সব মানুষদের সব গান শুনিয়েছেন।তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান,পন্ডিত জওহরলাল নেহরু,লালবাহাদুর শাস্ত্রী,শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ।’ইন্ডিয়ান কালচারাল ডেলিগেশান’ এর সভ্য হয়ে তিনি সোভিয়েট ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপের নানা দেশ যেমন পোল্যান্ড, রোমানিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, যুগোশ্লাভিয়া ইত্যাদি দেশে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া,কানাডা,সিঙ্গাপুর,,বাংলাদেশে গান শোনাতে গিয়েছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতির বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।অল ইন্ডিয়া রেডিওর বিশেষজ্ঞ কমিটিরও তিনি ছিলেন সদস্য।বিশ্বভারতীর সঙ্গীতবিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তিনি অন্যতম পরীক্ষক ছিলেন।

সারাজীবন যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীত নিজে পরিবেশন করেছেন পাশাপাশি গান শিখিয়েছেন অগণিত ছাত্রছাত্রীকে উত্তরকলকাতায় তৈরী করেছেন উত্তরায়নী। এর সঙ্গে বাণীচক্র সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি ছিলেন যুক্ত।দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ছিলেন সেইসব শিল্পীদের অন্যতম যাঁরা রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ, জন্মের ১২৫ তম বর্ষ এবং ১৫০ তম বর্ষে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন।
দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় সঙ্গীতরসিক শ্রোতাদের যেমন তাঁর কন্ঠ দিয়ে মুগ্ধ করেছেন তেমনই তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেকবার।’ বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিতে গানের জন্য শ্রেষ্ঠ নেপথ্য সঙ্গীত শিল্পীর সম্মান পেয়েছেন ১৯৭৪ সালে।১৯৮২ সালে দেবব্রত বিশ্বাস স্মারক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৯৪ সালে তাঁর সঙ্গীতজীবনের ৫০ বছর উপলক্ষ্যে এইচ এম ভি তাঁকে গোল্ডেন ডিস্ক দিয়ে সম্মানিত করে। ২০০২ সালে পেলেন উত্তমকুমার পুরস্কার।২০০৩ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা তাঁকে সারাজীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ আনন্দ সঙ্গীত পুরস্কারে ভূষিত করে।২০১০ সালে বাংলাদেশ থেকে লাভ করেন বঙ্গবন্ধু সম্মান।ঐ বছরই কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। সঙ্গীতনাটক একাডেমি পুরস্কার ও ভারত সরকারের তরফে পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন ২০১০ এই।২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বঙ্গবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেন।এছাড়া আরও ছোটোবড়ো নানা পুরস্কারে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় সম্মানিত হয়েছিলেন।

৯১ বছর বয়সে ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর বড়দিনের প্রাক সন্ধ্যায় জীবনাবসান হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা বাংলা গানের এই সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিল্পীর।

এই লেখার শুরুতেই কিছু ছায়াছবির প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলাম যেখানে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গানের প্রসঙ্গ এসেছে। যে ছবিটির কথা না বললে এই প্রসঙ্গ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তা হল ‘ক্ষুধিত পাষাণ’। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের আগের বছর অর্থাৎ ১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তপন সিংহ পরিচালিত এই ছবির সঙ্গীত পরিচালক ওস্তাদ আলি আকবর খান ছবির এক বিশেষ দৃশ্যে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে ব্যবহার করেন রবীনদ্রসঙ্গীত ‘ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’। ছবির সেই মুহূর্তে এই গান এবং দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ভরাট গলা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

এইভাবেই শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গান আমাদের মনের মণিকোঠায় এক চিরস্থায়ী আসন লাভ করে রয়েছে।