অতীত যা লেখেনিসংস্কৃতি

চোল রাজবংশ ও তার বাঙ্গালী উৎস –

– শ্রী স্নেহাংশু মজুমদার

 

সম্প্রতি চোল সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে মণি রত্নম নির্দেশিত কল্কি কৃষ্ণমূর্তির উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে ‘পোন্নিয়িন সেলভান -১’ নামক একটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে যা ইতিহাসপ্রেমিকদের কাছে বেশ সমাদৃত । দক্ষিণ ভারতীয় ইতিহাসের মধ্যে চোল সাম্রাজ্য অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে । দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে সাম্রাজ্য বিস্তার থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভারতের একাধিক গগনচুম্বী মন্দিরশৈলী যেমন বৃহদেশ্বর মন্দির, ধরাসুরম মন্দির, আরুলমিগু পেরুভুদাইয়ার মন্দির চোল রাজাদের অমূল্য কীর্তি । তার সাথে যদি চোল বংশের বাঙ্গালী জাতির থেকে উৎস হওয়ার কোনো সূত্র পাওয়া যায়, সেটা আমাদের কাছে অত্যন্ত আশ্চর্যের এবং গৌরবের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ।

যদিও ঐতিহাসিকভাবে অপরিনামদর্শী চোল রাজা রাজেন্দ্র চোল একবার বাঙ্গালা আক্রমন করার ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছিলেন ও পরবর্তীকালে বাঙ্গালার সম্রাট গৌড়েশ্বর মহীপালের নিকট যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হন। অতঃপর সম্রাট মহীপাল দক্ষিণে মলয় পর্বত পর্যন্ত অঞ্চল চোল অধিকার থেকে জয় করে নেন । কিন্তু বাস্তবে সত্য যে তামিল সঙ্গম সাহিত্য থেকে মন্দিরের নথি, তামিল ঐতিহাসিকদেরই লিখিত একাধিক গ্রন্থে কিছু তামিল গোষ্ঠীর সাথে চোলদের বাঙ্গালী উৎস উল্লিখিত রয়েছে, সেসম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা আমাদের আবশ্যিক কর্তব্য ।

চোলবংশের বাঙ্গালী উৎসের বিষয়টি নিয়ে প্রথম প্রসঙ্গ উত্থাপন হয় যখন গঙ্গারাদিত্যের পুত্র পরাকেশরী মাদুরান্তক উত্তমচোলের (৯৭১-৯৮৫ খ্রি) মুদ্রায় গৌড়ীয় লিপি বা বাঙ্গলা বর্ণমালার উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি এক অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় ছিল কারণ তামিল ভাষাকে অত্যন্ত প্রাচীন হিসেবে দাবি করা হয় যা সংষ্কৃতের সাথে তুল্য, তাদের সবথেকে বড় রাজবংশের মুদ্রায় তামিল লিপি না থেকে এত দূরের বাঙ্গালার গৌড়ীয় লিপি কেন? পরবর্তীকালে বিভিন্ন পৌরাণিক উৎস থেকে অনুমিত হয় তামিলদের উৎস বাঙ্গালার দক্ষিণ-পশ্চিম ক্ষেত্রের বৃহৎ তাম্রলিপ্ত বন্দরে এবং তামিল নামটি প্রাকৃত তামালিত্তি শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ । বায়ুপুরাণ ও বিষ্ণুপুরাণে উল্লিখিত তাম্রলিপ্তরা ছিল বাঙ্গালা ও তৎসংলগ্ন সমুদ্র উপকূলের বাসিন্দা যাঁরা তামলিট্টি (তাম্রলিপ্তি) থেকে দেশত্যাগ করে ও দক্ষিণ ভারতে গিয়ে নতুন তামিল জাতিস্বত্ত্বার নির্মাণ করেন।

[চিত্র : রাজা উত্তমচোলের রৌপ্যমুদ্রায় বঙ্গলিপিতে খোদিত নাম এবং বঙ্গ জনপদের রাজপ্রতীক মৎস্য-চিহ্ন]

তামিলদের আরেকটি উপজাতি ছিল ‘ভানাভার’ (বনবর) যাদের স্বর্গদূত মনে করা হতো । তারা স্পষ্টতই বাঙ্গালার উত্তরে একটি পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী ছিল এবং যখন তারা দক্ষিণ ভারতে বসতি স্থাপন করেছিল, তখন তারা তাদের বসবাসের জন্য বেছে নিয়েছিল পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কল্লি-পাহাড়ের মতো পাহাড়ি অঞ্চল। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে, বাঙ্গালার রাঢ়অঞ্চলের সিংহপুর রাজ্যের রাজপুত্র বিজয়সিংহ আর্যদের প্রথম উপনিবেশের নেতা হিসেবে লঙ্কায় অবতরণ করেন ও সিংহল রাজ্য স্থাপন করেন । বিজয় সিংহের সাতশো সৈন্যবাহিনী এই তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়েই লঙ্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন । তামিল নামটি তাই তামালিত্তি শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ বলে মনে হয়। তাম্রলিপ্তরা ছিল বাংলা ও তৎসংলগ্ন সমুদ্র উপকূলের বাসিন্দা। ভিলাভার এবং মিনাভার, নাগা উপজাতিসমূহ যেমন মারাভার, আইনার, ওলিয়ার, ওভিয়ার, অরুভালার, পারাথাভার ইত্যাদি বাংলার তাম্রলিপ্ত থেকে যাওয়া অভিবাসীদের তামিল বলা হয়।

● রাজা গৌড়মনু :

বিজয় সিংহের মতোই আরেক বাঙ্গালী রাজার উল্লেখ পাওয়া যায় যিনি বাঙ্গালা ছেড়ে গিয়ে বাইরে নতুন রাজ্য স্থাপন করেন। বিজয় সিংহ করেছিলেন শ্রীলঙ্কায়, আর এক্ষেত্রে তামিলনাড়ুতে গিয়ে রাজত্ব স্থাপন করেন আরেক বাঙ্গালী রাজা গৌড়মনু । প্রসিদ্ধ এপিগ্রাফিস্ট শ্রী রামচন্দ্রন সি উল্লিখিত নটরাজ মন্দিরে সংরক্ষিত কিংবদন্তি অনুসারে প্রাচীন গৌড়দেশ থেকে গৌড়মনু নামক একজন রাজা তামিলনাড়ু গিয়ে চিদাম্বরম ক্ষেত্রে শাসন স্থাপন করেন, তাঁরই বংশধর চোল বংশ যাঁরা পরবর্তীকালে চোল সাম্রাজ্য নির্মাণ করেন।

[চিত্র : চিদাম্বরমের বিখ্যাত নটরাজ মন্দির]

একইভাবে, নটরাজ মন্দিরের কিংবদন্তি থেকে খ্যাতনামা ঐতিহাসিক শ্রী সি জয়রামণ উল্লেখ করেছেন যে গৌড়দেশ (বাঙ্গালা) থেকে থিলাইতে আসা রাজা সিংহবর্মণ থিলাইয়ের জলস্তরে ডুবে গিয়ে হিরণ্যবর্মণ হয়েছিলেন । চোল রাজারা যাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে থিলাই মন্দিরের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা বাঙ্গালা থেকে থিলাইতে চলে আসেন এবং ‘কৌদেসা মনু’ (গৌড়েশ মনু) হিসেবে শাসন করতেন। চোল এবং গৌড় জাতির মধ্যে সংযোগও বেশ কিছু নথিতে লিপিবদ্ধ আছে।

[চিত্র : তালপত্রে লিখিত সঙ্গম সাহিত্যের একটি নিদর্শন]

 

প্রাচীন সঙ্গম সাহিত্য অনুসারে বাঙ্গালা থেকে গিয়ে তামিলনাড়ুতে বসতি স্থাপনকারী পাঁচটি নাগা উপজাতির কথা রয়েছে, এঁরা হলেন –

১) ভেলিয়ার – কৃষক; 

২) মাজহাওয়ার – পাহাড়ি মানুষ যাঁরা পাহাড়ি পণ্য সংগ্রহ করে তার ব্যবসা করেন; 

৩) নাগর- সীমান্ত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা, যারা শহরের প্রাচীর ও দূরবর্তী দুর্গগুলোকে পাহারা দিতেন; 

৪) কদম্বর – যাঁরা বনাঞ্চলে বসবাস করে সমৃদ্ধ হন;

৫) থিরাইয়ার – নাবিক। দক্ষিণে রাজত্ব করা আরেক রাজবংশ পল্লবদেরকে থিরাইয়ার সম্প্রদায়ভুক্ত বলা হয়। পরবর্তীতে উপ-সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একটি হল মারাভার (যোদ্ধা, বিজয়ী এবং শাসক; প্রধান তামিল রাজবংশের চের, চোল এবং পান্ড্য সহ।)

এরপর তামিলনাড়ুতে তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙ্গালা থেকে একাধিক নাগ-উপাসক উপজাতি অগ্রসর হন। এই উপজাতিগুলির মধ্যে মারান, চের এবং পাঙ্গালা-থিরাইয়ার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ । শ্রী অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ উল্লেখ করেছেন, চেরারা পাঙ্গালা বা বাঙ্গালার উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ ভারতে অগ্রসর হয়েছিল এবং ঐতিহাসিকভাবে উল্লেখযোগ্য সুবিখ্যাত “চের” রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, প্রাচীন ব্রাহ্মণ সাহিত্যে চেরাদের মগধ দেশের পূর্বাঞ্চল দখলকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তামিলনাড়ুর কৃষি-উৎসব পোঙ্গল’র ব্যুৎপত্তি বঙ্গাল থেকেই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে । [চিত্র : চের সাম্রাজ্যের মুদ্রা]

আরেকটি উল্লেখযোগ্য মারান উপজাতি, যাঁরা বাঙ্গালা থেকে অভিবাসিত চেরদের প্রতিবেশী ছিলেন বলে মনে করা হয়, এটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ যে পান্ড্য রাজারা নিজেদের মারান বংশোদ্ভূত বলে দাবি করেন। মারানরা, যাঁদেরকে মারাভারও বলা হত, তাঁরা খুবই হিংস্র এবং যুদ্ধবাজ লোক ছিলেন বলে জানা যায় এবং তাঁরা দেবী কালীর উপাসনা করতেন যাঁর চুলের উপরে একটি ক্রোধিত কোবরা সাপ ছিল। পাঙ্গালা-থিরাইয়ারদের সর্বশেষ অভিবাসী হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং তাঁদের সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তাঁরা নৌকায় করে বাঙ্গালার সমুদ্র উপকূল থেকে এগিয়ে গিয়ে কাঞ্চিতে চোল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেহেতু পাঙ্গালা বা বাঙ্গালা থিরাইয়ার শব্দগুচ্ছ (Thira-Vangala) এর সমতুল্য, তাই আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে এই জাতিসমূহ মাদ্রাজ উপকূলে রওনা হওয়ার আগে বাঙ্গালায় আর্য প্রভাব পেয়েছিল।

বাঙ্গালার পাল রাজবংশের মতোই তামিলের চোলরা বাঘকে তাদের রাজকীয় প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন, ব্যাঘ্রচিহ্নের ব্যবহার তাঁদের সুন্দরবনের বাংলার বাঘের সংযোগের সাথে তাৎপর্যপূর্ণ । মুদ্রায় মাছের প্রতীক আরেকটি বৃহৎ সাদৃশ্য তুলে ধরে কারণ সুপ্রাচীন বঙ্গ জনপদের মুদ্রাতেও মৎস্য-চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছিল । নৃত্যরত শিবমূর্তি যা বাঙ্গালার নর্ত্যেশ্বর বা নটেশ্বর এবং তামিলনাড়ুর নটরাজ উভয়ক্ষেত্রে শৈব সম্প্রদায়ের সংযোগ তুলে ধরে । তামিল দেশের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিকাশে বাঙ্গালী আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের যোগাযোগ ও অবদান লিথিক রেকর্ডে নথিভুক্ত পাওয়া যায়। এটি ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে বাঙ্গালা থেকে আগত নির্দিষ্ট সংখ্যক শৈবাচার্যকে চোল সম্রাটরা রাজগুরু হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। (আর. নাগাসওয়ে; ১৯৯৯)। যখন চিদাম্বরম এবং পরবর্তীতে চোল মন্দিরগুলি নির্মিত হয়েছিল, তখন এই রাজগুরুরা চোল রাজ্যের ধর্মীয় বিষয়গুলির দায়িত্বে ছিলেন।

[চিত্র: পালযুগীয় বাঙ্গালার নর্ত্যেশ্বর ও চোলযুগীয় তামিলনাড়ুর নটরাজ মুর্ত্তি]

 

● তথ্যসূত্র :

১) The Tamils – Eighteen Hundred Years Ago, by V Kankasabhai

২) Sakthi cult in Tamil Nadu: Reflections of Bengal Tradition, T. Satyamurthy

৩) Origin of Cholas- Tamil Myth, Controversies in History.

৪) শ্রী অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ রচনাবলী, সম্পাদক শ্রী যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ ।

 

 

(লেখক পরিচিতি – শ্রী স্নেহাংশু মজুমদার উদ্ভিদবিজ্ঞানের স্নাতক স্তরে, দ্বিতীয় বর্ষ। বঙ্গীয় সনাতনী ইতিহাস সন্ধানী ও প্রচারক।)

Comment here