রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্র সুবিস্তৃত। কত না শিল্পী,কতরকমেরই না তাঁদের গায়নশৈলী।কেউ কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন আবার কেউ কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে স্বরলিপি নিখুঁতভাবে অনুসরণ করেছেন।কিন্তু এমন কোনও কোনও শিল্পী ছিলেন যিনি শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনই নয় পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষণের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত মহতী ভূমিকা পালন করেছিলেন।শুদ্ধ স্বরপ্রয়োগের পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণীকেও যাতে সকলে ঠিকমতো আত্মস্থ করে চলেন তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে গিয়েছেন।তেমনই একজন শিল্পী এবং শিক্ষক হলেন শ্রী সুবিনয় রায়।রবীন্দ্রসঙ্গীতজগতের ক্ষেত্রে এক পরম শ্রদ্ধেয় নাম।
তাঁর যখন কিশোর বয়স তখন থেকেই তিনি সঙ্গীতচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। শ্রীমতী ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, শ্রী অনাদিকুমার দস্তিদার এবং শ্রী শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষা নেন সুবিনয়।এর সঙ্গে সঙ্গে ছিলো শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা।রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিজাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কঠোর অনুশীলন করেছিলেন।একদিকে এইসব শিক্ষকদের সান্নিধ্য এবং অন্যদিকে শান্তিনিকেতনের সাঙ্গীতিক পরিবেশ তাঁর মনের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা যেন আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৩৮ সালে শ্রী সুবিনয় রায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন।১৯৩৯ সাল।স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে বর্ষামঙ্গলের জন্য বেশ কয়েকটি গান শেখবার সুযোগ ঘটে সুবিনয়ের। পাঠ শেষ করবার পর ১৯৪৩ সালে সঙ্গীতভবনে অধ্যাপনার কাজে তিনি নিয়োজিত হন।দুবছরের জন্য তিনি বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করেন।এরপর বিদেশে লাইব্রেরিয়ানশিপ পড়তে যান ও শিক্ষার শেষে ফিরে এসে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে গ্রন্থাগারিক হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৯৪৩ সালে শ্রী সুবিনয় রায় আকাশবাণীতে সর্বপ্রথম গান গাওয়ার সুযোগ পান।এরপর তিনি বহুদিন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন।পাশাপাশি শুরু হলো রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশ।হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকে প্রকাশিত হলো ‘ এই করেছ ভাল নিঠুর হে’ এবং ‘ তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে’। এই গানদুটি শ্রোতাদের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়।
সুবিনয় রায় প্রধানতঃ ধ্রুপদাঙ্গ,টপ্পাঙ্গ বা খেয়াল অঙ্গের গানগুলি গাইতে পছন্দ করতেন।রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদাঙ্গের গানগুলি আর সুবিনয় রায় যেন সমার্থক হয়ে ওঠেন।বিশেষ করে আড়ঠেকা তালের রবীন্দ্রসঙ্গীতে তিনি ছিলেন পারদর্শী।পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি ‘ জাগো নাথ জোছনা রাতে’,’ কি রাগিণী বাজালে’,’ আমার আপন গান’,’ দেখা না দেখায় মেশা হে’ ইত্যাদি গানগুলি সুবিনয় রায়ের কন্ঠে বিশেষ জনপ্রিয় হয়।
খুব বেশী গান যে রেকর্ড করেছেন সুবিনয় রায় এমন বলা যায় না কিন্তু যে কটি গান রেকর্ড করেছেন তার প্রত্যেকটিতে তিনি যেন নিজেকে সমর্পণ করেছেন।তেমনই কয়েকটি গান হলো ‘ আমার নিখিল ভুবন হারালেম’,’ কোন সে ঝড়ের ভুল’,’ এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে’, ‘অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে’,’ সকালবেলার আলোয় বাজে’,’ এমনি করে ঘুরিব দূরে বাহিরে’,’ ওদের সাথে মেলাও’,’ সুন্দর হৃদিরঞ্জন তুমি’,’ এ কি সুধারস আনে’,’ কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে’,’ গহন ঘন ছাইল’,’ তিমির অবগুন্ঠনে’,’ আকাশ আমায় ভরল আলোয়’,’ তুমি জানো ওগো অন্তরযামী’,’ মহারাজ একি সাজে’ ইত্যাদি।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীত আর সুবিনয়বাবু যেন সমার্থক।ব্রহ্মসঙ্গীতের পরিবেশনের সময় তিনি যেন নিজেকে উজাড় করে দিতেন।’ বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা’,’ হৃদয়নন্দন বনে’,’ মধুর রূপে বিরাজো ‘, ‘ বসে আছি হে কবে শুনিব তোমার বাণী’,’ তারো তারো হরি দীনজনে’, ‘সদা থাকো আনন্দে’,’ ভক্তবিকাশ প্রাণবিমোহন’,ইত্যাদি গানগুলি যেন সুবিনয় রায়ের গান হয়েই রয়েছে।
গান যেমন গেয়েছেন,শিখিয়েওছেন অনেককে।তৈরী করেছেন অসংখ্য ছাত্রছাত্রী যাঁরা সুবিনয় রায়ের গায়নশৈলীকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন।সঙ্ঘমিত্রা গুপ্ত, ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য,সুরঞ্জন রায় প্রমুখ। তাঁর অন্যতম ছাত্রছাত্রী। কলকাতার বিভিন্ন সঙ্গীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।ভারত সরকারের আলাউদ্দিন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই শিল্পী।
সবসময় মনে করতেন শ্রোতাদের ভালবাসা তাঁর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।কোনও আত্মপ্রচারের মোহ তাঁর ছিলো না।রবীন্দ্রনাথকে জীবনদেবতা মনে করে তাঁর গানকে জীবনের পরম ধন করে তুলেছিলেন শতবর্ষ অতিক্রান্ত সুবিনয় রায়।আজও যাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেন প্রাণের আরাম আত্মার শান্তির জন্য তাঁদের কাছে সুবিনয় রায় এক পরমশ্রদ্ধেয় নাম।
– পেশাগতভাবে সরকারী কর্মী, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েই বাঁচেন, লেখলেখির মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত।
Comment here