সংস্কৃতি

ঘন্টাকর্ণ সংক্রান্তি – এক অবলুপ্তপ্রায় লোকোৎসব

– শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার

 

আজ ঘন্টাকর্ণ সংক্রান্তি । ফাল্গুন সংক্রান্তিতে ঘেঁটু বা ঘন্টাকর্ণের পূজানুষ্ঠান হত বেশ জাঁকজমক করেই। ঘেঁটু গাছের অধিষ্ঠাতা দেবতা। তিনি কুষ্ঠ ও চর্মরোগের নিরাময়কারী দেবতা ও শিবের অনুচর।বসন্ত কালে খোসপাঁচড়া, ছোঁয়াচে চর্মরোগের হাত থেকে রেহাই পেতে গ্রামের লোক-সাধারণ পরপর কয়েকদিন সকালে কচি ঘেঁটু পাতার তেঁতো রস সেবন করেন। পাতা বেটে তা হলুদের সঙ্গে মিলিয়ে গায়ে মাখেন তারা। এতে শরীরের যাবতীয় চর্মরোগ দূরীভূত হয়। একদা এটাই ছিল এক অবর্থ্য লোকৌষধ।

পূজার জন্যে লাগে মুড়িভাজার পুরোনো ঝুলকালিমাখা একটি মাটির খোলা (‘কেলে হাড়ি’), তেল হলুদে চোবানো অব্যবহার্য ছোট বস্ত্রখণ্ড, তিনটি কড়ি, ছোট ছোট তিনটি গোবর দিয়ে পাকানো পিণ্ড, ঘেঁটু ফুল, সিঁদুর, ধান ও দূর্বা ঘাস।

প্রতি বছর ফাল্গুনের সংক্রান্তির সকালে ঘেঁটু পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পূজার জন্য আলাদা করে পুরোহিতের দরকার হয় না, গৃহস্থ পুরুষ-মহিলারাই করতে পারে।দিনের বেলায় গ্রাম্য পথের ধারে অথবা জলাশয়ের পাড়ে ভাঙ্গা হাড়ি উল্টে তার উপর গোবরের মণ্ড দিয়ে তৈরি হয় ঘন্টাকর্ণর মুখ। প্রথমে ব্রতধারিণীরা এলোচুলে বসে বাম হাতে মাটির খোলাটা নিকোনো জায়গায় বসিয়ে দেন। তার উপরে তিনটি গোবরের পিণ্ড লাগিয়ে সেগুলি কড়ি, সিঁদুর ঘেঁটু ফুল দিয়ে সেটি সাজানো হয়,(গোবরের মধ্যে কড়ির চোখ আর সিঁদুরের টিপ দেওয়া)। খোলার উপরে বস্ত্রখণ্ডটি বিছিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ির সামনে উঠোনে বা একটু দূরে রাস্তার তিনমাথা, চারমাথার ধারে জনতার মাঝে এটি সম্পন্ন হয়। ছড়া কাটা হয় —

“ধামা বাজা তোরা কুলো বাজা
এলো এলো দ্বারে ঘেঁটু রাজা।”

পূজার নৈবেদ্য বলতে সামান্য বাতাসা, কদমা আর নকুলদানা। পূজার শেষে শিশুর দল কলার বেউনো বা খোল দিয়ে তৈরি করে নেয় পাল্কি। তা কাঁধে চাপিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘেঁটুঠাকুরের গান গেয়ে বেড়ায় । গৃহস্থ থালা ভরে চালডাল-আলু , সব্জি ও টাকা দিয়ে তাদের আবদার মেটায়। সংক্রান্তির দিন রাতে খিঁচুড়ি রেধে একসঙ্গে ভোজন হয়।

“ঘেঁটু যায় ঘেঁটু যায় গৃহস্থের বাড়ি
এক কাঠা চাল দাও কুমড়োর বড়ি।
যে দেবে থালা থালা তার হবে কোঠা-বালা
যে দেবে মুঠো মুঠো তার হবে হাত ঠুটোঁ।
যে দেবে থালা থালা,তার হবে সোনার বালা ।
যে দেবে শুধু বকুনি ঘাঁটু দেবে খোসচুলকানি।”

মধ্যপ্রদেশে জৈন ধর্মেও ঘন্টাকর্ণ মহাবীরের পুজা হয়। অশোকের জৈন গণহত্যার আগে রাঢ় ও পুন্ড্রবর্ধনেও জৈন ধর্মের বিস্তার খুব বেশি ছিল ‌। সম্ভবত বাঙলার নাথপন্থী সিদ্ধাচার্যদের মাধ্যমেই শিবের অনুচর ঘন্টাকর্ণ হয়ে ওঠেন জৈনদের ঘন্টাকর্ণ মহাবীর।

শোন শোন সর্বজন ঘাঁটুর জন্ম বিবরণ।

পিশাচ কুলে জন্মিলেন শাস্ত্রে লিখন।

বিষ্ণুনাম কোনমতে করবে না শ্রবণ

তাই দুই কানে দুই ঘন্টা করেছে বন্ধন।

ঘেঁটু দেবকুমার থাকা অবস্থায় বড়সড় অপরাধ করে বসেন। এর জন্য বিষ্ণু তাকে অভিশাপ দেন। এই অভিশাপের ফলে তাকে জন্ম নিতে হয় পিশাচ কুলে। কোনোভাবেই যেন বিষ্ণু নাম কানে না আসে সেজন্য দুই কানে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখার কারণে নাম হয় ঘণ্টাকর্ণ। কোনো মন্দিরে ঘেঁটু ঠাকুরের পূজা হয় না। পূজা হয় জলাশয়ের পাশে রাস্তার মোড়ে।

হারিয়ে যাচ্ছে এই সংস্কৃতি। ঘেঁটু / ঘন্টাকর্ণ যা আসলে হুগলী জেলার পরিচিতি ছিল তা উঠে যেতে বসেছে। আগেকার দিনে ঘেঁটুপুজোর দিন স্কুল একবেলা ছুটি থাকতো। আগে আমাদের ঘরে ৯/১০ টা দল আসতো, গোটা গ্রামে ১০/১৫ টা দল বেরুতো। গত বছর খেয়াল হল সেদিন কেউ বেরুইনি। আসলে বদলাতে থাকা পরিস্থিতি ও শহুরে হাওয়ায় লোকসংস্কৃতি অবলুপ্ত হতে বসেছে।

 

(লেখক পরিচিতি: শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার B.Tech Ceramic Technology তে পাঠরত)

Comment here