” ঐ কন্ঠ আকাশসীমায় দোলে
অনেকদূরের ডাকাডাকি চারিয়ে ফেরা
আমাদের ঘুমজাগরণ জুড়ে
রবীন্দ্রনাথের শব্দমালা
আমাদের স্নায়ুধমনীতে ঝলকায়
আমাদের রক্তকণিকারা আলোয় মাতে
ঐ কন্ঠের যাদুকরী খেলায়”
কবি অরুণ মিত্র এই কথাগুলি লিখেছিলেন যাঁর সম্বন্ধে তিনি শান্তিনিকেতনের আশ্রমকন্যা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিংবদন্তী শিল্পী,অবনীন্দ্রনাথের বড়ো আদরের আকবরী মোহর, আপামর রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুরাগী শিল্পীদের কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মোহরদি।
১৯৩৮ সাল| শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা অণিমা মুখোপাধ্যায় সর্বপ্রথম বাংলা আধুনিক গানের রেকর্ড করলেন।হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের কথায় ও নীহারবিন্দু সেনের সুরে গানদুটি হলো ‘ গান নিয়ে মোর খেলা’ এবং ‘ ওরে ঐ বন্ধ হলো দ্বার’। কিন্তু সে তো রবীন্দ্রনাথের আদরের কণিকা।তবে কেন সে ঐ গান গাইবে? রবীন্দ্রনাথ খুব অখুশী হলেন।ঐ বছর সেপ্টেম্বর মাসে ‘কণিকা মুখার্জী ( মোহর) ট্রেনড বাই শৈলজানন্দ মুখার্জি অব শান্তিনিকেতন’ এই লেবেলে হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে বেরোলো রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড ‘ ডাকবো না ডাকবো না অমন করে বাইরে থেকে ডাকবো না’।এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয় নি কণিকা মুখোপাধ্যায়কে।বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারিক বীরেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহসূত্রে তিনি হয়ে উঠলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাম্রাজ্যের অন্যতম অধীশ্বরী হয়ে সারা পৃথিবীর রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রেমীদের কাছে এক অন্যতম নাম।
শান্তিনিকেতনেই তাঁর পড়াশুনা আর বড়ো হয়ে ওঠা।গান শেখাও সেখানেই।তাই যাঁদের গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন তাঁরা প্রত্যেকে এক একজন কিংবদন্তী।দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর,শৈলজারঞ্জন মজুমদার, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী বা শান্তিদেব ঘোষের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা কণিকাকে শিখিয়েছেন।অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়,রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প. এন. চিনচোরে, ভি. ভি.ওয়াঝেলওয়ার প্রমুখের কাছে নিয়েছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম।আট ভাইবোনের মধ্যে সবার চেয়ে বড়ো কণিকা গুরুপল্লীতে নাচে, গানে,অভিনয়ে সবার মধ্যমণি হয়ে উঠলেন অনায়াসেই।
১৯৩৫ সালে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বপ্রথম নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করেন।শান্তিনিকেতনে শারদোৎসব অভিনীত হয় এবং সেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একই মঞ্চে অভিনয় করলেন কণিকা।১৯৩৭ সালে প্রথম কলকাতার রঙ্গমঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন কণিকা।সেই অনুষ্ঠান ছিলো বর্ষামঙ্গল।কণিকা গাইলেন’ ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’।শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং গলা মিলিয়েছিলেন সেই গানের সঙ্গে।১৯৪৪ সালে কলকাতায় গীতবিতানের উদ্যোগে ‘ মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যে প্রমদার চরিত্রে তাঁর গান প্রশংসিত হয়।
১৯৪৩ সালে বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনের শিক্ষিকা হিসেবে তিনি যুক্ত হন।সেই যে বিশ্বভারতীর সঙ্গে যুক্ত হলেন তা চলেছিলো ১৯৮৪ সালে অবসর নেওয়া অবধি।তারপর বিশ্বভারতীর এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে আমৃত্যু ছিলেন কণিকা।
১৯৬১ সাল।রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ।সেবছর সন্তোষ সেনগুপ্তর তত্ত্বাবধানে গ্রামাফোন কোম্পানী থেকে প্রকাশিত হতে লাগলো একের পর এক রবীন্দ্রগীতিনাট্যের লং প্লেয়িং রেকর্ড। শ্যামাতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় রইলেন মুখ্য ভূমিকায়। আবার চিত্রাঙ্গদায় সুরূপা চিত্রাঙ্গদা তিনি।তাসের দেশ গীতিনাট্যে হরতনী হিসেবে তাঁর গান ও ছোটো ছোটো অভিনয় প্রশংসিত হয়।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আর কিছু কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত যেন সমার্থক।’ আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’,’ বাজে করুণ সুরে’,’ হৃদয়বাসনা পূর্ণ হল ‘,’ আমার সকল নিয়ে বসে আছি’,’ আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’,’ বিরহ মধুর হল আজি’,’ দে লো সখী দে’,’ হায় এ কি সমাপন’,’ অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে’,’ হে মোর দেবতা’,’ হৃদয় নন্দন বনে’ ‘ মন্দিরে মম কে’ – এই গানগুলি যেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান হয়েই রয়েছে।
সারাজীবন ধরে কণিকা অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।বি এফ জে পুরস্কার,সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার,পদ্মশ্রী,দেশিকোত্তম,আলাউদ্দিন পুরস্কার,একের পর এক সম্মানে সম্মানিতা হয়েছেন। তৈরি করেছেন অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে যাঁরা তাঁদের ভালোবাসার ও শ্রদ্ধার মোহরদির গান ছড়িয়ে দিয়েছেন পৃথিবীর কোণে কোণে।যখনই কলকাতায় কণিকা অনুষ্ঠান করতেন মানুষের ভীড় উপচে উঠতো। ৯০ এর দশক থেকেই শারীরিক অসুস্থতার জন্য নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।২০০০ সালের মার্চে কলকাতায় পিজি হসপিটালে ভর্তি হন কণিকা।সেখানেই ৫ই এপ্রিল মৃত্যু হয় তাঁর।
আশ্রমকন্যা কণিকার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় শান্তিনিকেতনের মাটিতে।যে শান্তিনিকেতন ছিলো তাঁর সবচেয়ে আপন, যেখানকার আনন্দধারা নামক বাড়িতে তিনি সবথেকে বেশী থাকতে ভালোবাসতেন সেখানকার মাটিতেই মিশে রইলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকবরী মোহর সর্বজনশ্রদ্ধেয়া কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।পরিশেষে তাঁর শিক্ষক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কথা উদ্ধৃত করে বলি, ” সবচেয়ে নিকটের ছাত্রী ও আমার কাছে কোনও দিন ও কণিকা নয়,ও আমার মোহর,আমার মেয়ে।গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন মোহর আমার কাছে গান শিখুক।ওর কন্ঠ তো দেবদত্ত।রবীন্দ্রসঙ্গীতকে যারা আনন্দের ও প্রাণের সঙ্গী হিসাবে জানে মোহর তাদেরই একজন”|
– পেশাগতভাবে সরকারী কর্মী, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েই বাঁচেন, লেখলেখির মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত।
Comment here