১৯৬২ সালের ১১মে অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক ৬০ বছর আগে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘ কাঞ্চনজঙ্ঘা ‘ মুক্তি পেলো।এই ছবিতে দেখা যায় যে প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন স্বামী ছবি বিশ্বাসের দাপটে লাবণ্য অর্থাৎ করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্র চাপা পড়ে থাকে।দার্জিলিং এর এক বিশেষ আবহাওয়ায় অসীমের দিকে চেয়ে তিনি গেয়ে ওঠেন ‘ এ পরবাসে রবে কে’।দাদা জগদীশরূপী পাহাড়ি সান্যাল সস্নেহে বলে ওঠেন,
– কতদিন পরে তুই গান গাইলি।
লাবণ্য যেন কোথা থেকে সঞ্চয় করলেন এবং বললেন,
– এক্ষুণি মণিকে একটা কথা বলা দরকার সে যেন নিজে ভালো বোঝে তাই করে।
রুদ্ধ আবেগকে গানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করে স্বামীর পুরুষত্ব বা প্রতাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার স্পর্ধা তিনি লাভ করেন।পার্বত্য পরিবেশ যেন লাবণ্যকে এই সাহস দেয়।করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে এই গানখানি গেয়েছিলেন অমিয়া ঠাকুর।জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির বধূ রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা অমিয়া ঠাকুরকে বর্তমান প্রজন্মের প্রায় কেউই চিনবে না কিন্তু যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে চলেছেন বা রবীন্দ্রগানের পরম্পরা নিয়ে চর্চা করেন তাঁদের কাছে অমিয়া ঠাকুর অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত এক নাম।
সরাসরি যাঁরা রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শিখেছিলেন তাঁদের মধ্যে অমিয়া ছিলেন অন্যতম।ছোটোবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে সাঙ্গীতিক প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে।যখন বেথুন স্কুলে অমিয়া পড়াশুনা করতেন সেখানকার পাঠ্যক্রমে ছিলো গান।মাত্র ৮ বছর বয়সে এক মুসলমান সারেঙ্গীবাদকের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেওয়া শুরু করেন অমিয়া।এরপর দীর্ঘ ছয় বছর ধ্রুপদ শিল্পী যোগীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তিনি সঙ্গীতশিক্ষা করেছিলেন।তারপর বিষ্ণুপুর ঘরানার গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সুরের সাধনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন অমিয়া।সেসময় কিশোরী অমিয়া নানাস্থানে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন।রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে এবং সরলা দেবীর পরিচালনায় যখন মায়ার খেলা গীতিনাট্য হয়েছিলো তখন প্রমদার চরিত্রে অভিনয় করে অমিয়া সকলের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।এই মায়ার খেলার সূত্রেই ঠাকুরবাড়িতে অমিয়ার বিবাহ হলো।দেবেন্দ্রনাথের মধ্যম পুত্র হেমেন্দ্রনাথের পুত্র হিতেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র হৃদিন্দ্রনাথের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন অমিতা।অর্থাৎ তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে নাতবউ।জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অমিয়ার সঙ্গীতচর্চা চলতে লাগলো।রবীন্দ্রনাথের কাছে অমিয়া যেসব গান শিখেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘ কি রাগিণী বাজালে’,’ বড়ো বিস্ময় লাগে’,’ ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছো’,’ মরি লো মরি আমায়’,প্রভৃতি। কবি ৭০ বছরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে যে অনুষ্ঠান হয়েছিলো সেখানে অমিয়া গেয়েছিলেন ‘ মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে রে’ এবং ‘ ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছো ‘।সেই গান শুনে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন।যখন জোড়াসাঁকোতে শাপমোচন হলো অমিয়া সেখানে ‘ সখী আঁধারে একেলা ঘরে’ গেয়েছিলেন।রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো গানের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন অমিয়া ঠাকুর।
অমিয়া ছিলেন স্বভাবলাজুক।কবির সামনে গান গাইতে গেলে তিনি কুন্ঠিত হয়ে পড়তেন।একদিন শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণের বারান্দায় বসে গাইছিলেন অমিয়া দেবী গাইছিলেন গান।থামের আড়াল থেকে শুনে কবি ঘরে চলে গেলেন।লিখে ফেললেন সেই বিখ্যাত গান ‘ দৈবে তুমি কখন নেশায় মেতে’।
আরও একবার।গঙ্গার ধারে খড়দহর বাগানবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ এসেছেন
অমিয়া দেখা করতে গিয়েছেন সেখানে।কবি অমিয়ার কাছে একখানি হিন্দি গান শুনতে চাইলেন।অমিয়া গাইলেন ‘ এ ধনি ধনি চরণ পরসত’। পূরবী রাগের আড়াঠেকা তালের একটি খেয়াল।সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে ফিরে আসার সময় রবীন্দ্রনাথ ডেকে পাঠালেন।অমিয়ার মুখে সেই গানটি আর একবার শুনতে চাইলেন।অমিয়া গাইলেন।এরপর কবি লিখলেন,’ কি ধ্বনি বাজে গহন চেতনা মাঝে’।
গানটি অমিয়া শিখলেন এবং মাঘোৎসবে গাইলেন সেই গান।
অমিয়া ছিলেন আকাশবাণী অডিশান বোর্ডের সদস্য।১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে ‘ হে নূতন দেখা দিক আরবার’ এবং ‘ সম্মুখে শান্তি পারাবার’ এই গান দুখানি রেকর্ড করেন।গ্রামাফোন কোম্পানী থেকে পঞ্চকন্যা নামে একখানি রেকর্ড প্রকাশিত হয় তাতে অমিতা ঠাকুর,মালতী ঘোষাল প্রমুখের সঙ্গে তাঁর গলায় গাওয়া দুখানি গান ছিলো। গানদুটি হলো ‘ বড়ো বিস্ময় লাগে’ এবং ‘ তবু মনে রেখো’।শেষ বয়সেও তাঁর গাওয়া এই দুখানি গানে যেন সাতটি সুরের পাখি খেলা করেছিলো।
অমিয়া ঠাকুর সম্বন্ধে দেবব্রত বিশ্বাস বলেছিলেন,’ অমিয়া ঠাকুর বোধহয় তাঁর ৭০ বৎসর পার করে ফেলেছেন।তিনি এখনও গান করেন।এখনও তাঁর গলায় যা স্বাভাবিক কাজ বেরোয় তা স্বরলিপি করা তো দূরের কথা,বর্তমানকালের অথরিটিরা কেউ তা নিজের গলায় গেয়ে দেখাতে পারবেন না’।
রবীন্দ্রঙ্গীতের এই সাধিকা অমিয়া ঠাকুরকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।
– পেশাগতভাবে সরকারী কর্মী, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েই বাঁচেন, লেখলেখির মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত।
খুব ভালো লাগলো