আমি তখন বেশ ছোটো।রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসরে একটি গান কানে এলো।’ আজি শুভদিনে পিতার ভবনে অমৃত সদনে চলো যাই’। গানটির সুর বেশ অন্যরকম।অনেকটা খ্রিস্টমাস ক্যারল গানের মতো।এককভাবে যিনি গেয়েছেন তাঁর গানের সঙ্গে আবার সমবেতভাবে গলা মিলিয়েছেন অনেকে।সেই প্রথম আমার সাগর সেনের সঙ্গে পরিচয়।রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই দরদী পুরুষকন্ঠের অধিকারী সাগর সেন ছিলেন স্বল্পায়ু।মোটামুটিভাবে ২৫ বছরে তাঁর গাওয়া ১০০ টি মতো গান প্রকাশিত হয়েছিলো।কিন্তু ঐ কটি গানই সাগর সেনের গান হয়ে রয়ে গিয়েছে অগণিত শ্রোতাদের কাছে।
১৯৩২ সালের ১৫ মে সাগর সেনের জন্ম।বাংলাদেশের ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ জমিদার সেনবাড়ির সন্তান হলেও সাগর সেনের জন্ম কিন্তু কলকাতায়।তাঁর বাবার নাম বিজনবিহারী সেন ও মায়ের নাম নয়নমঞ্জরী সেন।দক্ষিণ কলকাতার তীর্থপতি ইনস্টিটিউশানে ছিলো তাঁর স্কুলজীবন ও সুরেন্দ্রনাথ কলেজে কাটে তাঁর কলেজ জীবন।
স্নাতক হওয়ার পর ধীরে ধীরে সঙ্গীতের জগতে প্রবেশ করেন সাগর সেন। সেভাবে প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিলো না। কোনো গুরুর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিমও তিনি নেন নি।শুধুমাত্র অসাধারণ এক সুমিষ্ট কন্ঠস্বরকে সঙ্গী করে গাইতে থাকেন একের পর এক গান।১৯৫৮ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সর্বপ্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন সাগর সেন। ১৯৬১ সাল।রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে মেগাফোন থেকে প্রকাশিত হলো সাগর সেনের রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম রেকর্ড। দুপিঠে দুখানি গান। ‘ওগো জলের রানী’ এবং ‘নুপুর বেজে যায় রিনিরিনি’। বলাবাহুল্য সেসময় পঙ্কজকুমার মল্লিক,দেবব্রত বিশ্বাস,হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়,প্রমুখ পুরুষকন্ঠ রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশাল ভান্ডারকে আমজনতার মাঝে ক্রমাগতঃ জনপ্রিয় করে তুলছিলেন।সেই তালিকায় নবতম সংযোজিত নাম হলেন সাগর সেন। হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক অপরিহার্য কন্ঠ।
প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ার পরই সাগর সেন কলকাতায় তৈরী করলেন “রবিরশ্মি”। “রবিরশ্মি” কলকাতায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনপ্রিয় হয়।প্রতি বছর অনেক শিল্পীকে নিয়ে সাগর সেন রবিরশ্মির অনুষ্ঠান করতেন।বিশেষতঃ রবিরশ্মির শ্রাবণসন্ধ্যা ছিলো খুবই জনপ্রিয়।সেসময় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সকল প্রথিতযশা শিল্পীরাই রবিরশ্মির অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন।সাগর সেনের রেকর্ড করা রবীন্দ্রসঙ্গীতে যন্ত্রাণুষঙ্গের একটি খুব বড়ো ভূমিকা থাকতো।গানের বাণী ও সুরকে অক্ষুণ্ণ রেখেও যন্ত্রাণুষঙ্গের পরীক্ষানিরীক্ষাতে সাগর সেন ছিলেন পারঙ্গম।
১৯৭৪ সালের ১৮ অক্টোবর রমাপদ চৌধুরীর কাহিনী নিয়ে অগ্রগামীর পরিচালনায় মুক্তি পেলো ‘ যে যেখানে দাঁড়িয়ে’। এই ছবিতে সাগর সেন গাইলেন নেপথ্য সঙ্গীত ‘ না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে’। ১৯৭৯ সালের ৮ জুন মুক্তি পেলো বিমল করের কাহিনীনির্ভর ছবি ‘পরিচয়’। পরিচালক প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়।এই ছবিতে সাগর সেন গাইলেন ‘ আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’।এই গানটি গাওয়ার জন্য তিনি পেলেন বি. এফ. জে পুরস্কার।সাগর সেন হলেন প্রথম পুরুষ সঙ্গীতশিল্পী যিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য এই পুরস্কার পেলেন।
এছাড়া আরও যেসব রবীন্দ্রসঙ্গীত তিনি রেকর্ড করেছিলেন তাদের মধ্যে ‘ যদি ঝড়ের মেঘের মত আমি ধাই’,’ প্রথম আদি তব শক্তি’,’ ওঠো ওঠো রে’,’ কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া’,’ আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান’,’ সখী বহে গেল বেলা’,’ নহ মাতা নহ কন্যা’,’ বাজে বাজে রম্যবীণা’,’ আধেক ঘুমে নয়ন চুমে’,’ আজি প্রণমি তোমারে চলিব নাথ’,’ আরও কত দূরে আছে সে আনন্দধাম’,’ এসো এসো হে তৃষ্ণার জল’,’ আমি কি গান গাব যে’,’ ঐ ঝনঝার ঝংকারে ঝংকারে’,’ ওরে ঝড় নেমে আয়’,’ আমায় থাকতে দে’,’ একি সত্য সকলি সত্য’,’ মধুর বসন্ত এসেছে’,’ এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম’,’ আহা আজি এ বসন্তে’,’ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা’,ইত্যাদি গান সাগর সেনের কন্ঠে আজ ইতিহাস হয়ে গিয়েছে।’ যদেমি প্রস্ফুরন্নিব ‘- এই বেদগানটি সাগর সেন রেকর্ড করেছিলেন যা জনপ্রিয়তার শীর্ষ ছুঁয়েছিলো।
কলকাতা কর্পোরেশান পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি একজন দরদী মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয়। নীরবে বহু মানুষকে তিনি সাহায্য করেছিলেন।স্ত্রী ও তিনপুত্র প্রিয়ম,প্রীতম ও প্রমিতকে নিয়ে তাঁর ছিলো সুখের সংসার। এদের মধ্যে প্রমিত সেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসাবে বিখ্যাত।
বিদেশ ভ্রমণ করেছেন সাগর সেন রবীন্দ্রনাথের গানের ডালি নিয়ে।মাত্র ৫১ বছর বয়সে ১৯৮৩ সালের ৪ জানুয়ারি দূরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে সাগর সেনের জীবনাবসান হয়।শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত নয় সলিল চৌধুরী,অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়,হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সুরকারদের সুরে গান গেয়েছেন।ছায়াছবিতেও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন।প্রথিতযশা সব রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের মাঝে সাগর সেন ও তাঁর গান আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
– পেশাগতভাবে সরকারী কর্মী, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েই বাঁচেন, লেখলেখির মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত।
Comment here