– শ্রী সৌগত বসু
২০১৯এর ৯ই নভেম্বর এ দেশের অতি গর্বের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসের এক অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিন। সেদিনই ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে সুষ্ঠু সর্বজনগ্রাহ্য মীমাংসা হয়েছিল প্রায় অর্দ্ধশতাব্দী যাবৎ বিচার ব্যবস্থার অলিগলি থেকে রাজপথে ঘুরতে থাকা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মামলার। ১৩০ বছরেরও বেশী সময় আগে সেই কবে ব্রিটিশ আমলে যার সূত্রপাত। যদিও তারও অনেক অনেক আগে থেকে এই মামলার মূলগত বিষয়ের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আসমুদ্রহিমাচল ভারতের কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাস, আস্থা, ভাবাবেগ, ত্যাগ, তিতিক্ষা আর আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন সময়ে সমাজের বিভিন্ন অংশের – এমনকি অনেক সময়ে কেন্দ্রীয় আর প্রাদেশিক সরকারেরও – প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ অসহযোগিতা আর বিরোধিতার মাঝে আটকে ছিল সে মামলার সত্যনিষ্ঠ সমাধান। অবশেষে ২০১৯-এর প্রায় শেষে এসে এ দেশের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে, সময়ের নিরিখে অন্যতম দীর্ঘ মামলার চূড়ান্ত নিস্পত্তি করেছিলেন ভারতের মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। আইনের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান সমাজের বেশিরভাগ মানুষেরই নেই। আর সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। যদিও এটা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, যে অনেকগুলো কারণে এই রায় আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক তার মধ্যে অন্যতম হলো সেদিন ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের পাঁচ বিচারপতির সিদ্ধান্ত ছিল সর্বসম্মত। শুধু তাই নয়। আদালতের আর পাঁচটা রায়ের মতন এই রায় কোন বিচারপতি লিপিবদ্ধ করেছেন নির্দিষ্ট করে তার কোনও উল্লেখ এই রায়ে ছিল না। অর্থাৎ মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের সেই পাঁচজন বিচারপতির প্রত্যেকে এই ঐতিহাসিক মামলার চূড়ান্ত রায়ের প্রতিটা শব্দের দায়িত্ব সমান ভাবে গ্রহণ করেছিলেন। শুধু এক আইনী বিবাদের সুষ্ঠু মীমাংসাই নয় সেদিন ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে একই সাথে সুরক্ষিত আর সমাদৃত হয়েছিল ভারতীয়দের বেশ কয়েকটা প্রজন্মের কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাস, আস্থা, ভাবাবেগ, ত্যাগ, তিতিক্ষা আর আত্মমর্যাদা।
এর ঠিক দিন কুড়ি পরে নভেম্বরের ২৯ তারিখ তামিলনাড়ুর “শাস্ত্রা ইউনিভার্সিটির” এক অনুষ্ঠানে এই বিষয়েই বক্তব্য রাখছিলেন স্বামীনাথন গুরুমূর্তি। তামিল ভাষার “তুঘলক” সহ আরো বেশ ক’খানা হিন্দী আর ইংরাজী পত্রিকার সম্পাদক, স্বনামধন্য সাংবাদিক, প্রথিতযশা লেখক তথা প্রাবন্ধিক, পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক বিষয়ে এ দেশের অন্যতম সেরা বিশেষজ্ঞ এবং আরো অনেক অনুকরণীয় পরিচয়ে সুপরিচিত পন্ডিত এক মানুষ। সেদিন গুরুমূর্তির ভাষণের প্রতিটা শব্দ থেকে মুগ্ধতা, প্রশংসা, শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছিল সেই সময়ে প্রায় ৯২ বছর বয়সের এক নবতিপর প্রথিতযশা আইনজ্ঞের উদ্দেশ্যে। তিনি কেশব পরাশরণ। গত শতাব্দীর ৮০-এর দশকের প্রায় পুরোটা জুড়ে যিনি তাঁর সুযোগ্য হাতে সুনামের সাথে প্রথমে সামলেছিলেন ভারতের সলিসিটর জেনারেলের আর পরে, অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব। তারও আগে ৭০-এর দশকে সাফল্যের সাথে সামলেছেন তামিলনাড়ুর অ্যাডভোকেট জেনারেলের দায়িত্ব। ২০০৩-এ ভারত সরকার তাঁকে সম্মানিত করেছেন পদ্মভূষণে আর ২০১১-তে পদ্মবিভূষণে। ২০১৯-এর ৯ই নভেম্বর ভারতের সর্বোচ্চ আদালত যে ঐতিহাসিক মামলায় যুগান্তকারী এবং চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন – সেই মামলায় “রাম লালার” মর্যাদা রক্ষার্থে, তাঁর পক্ষে আইনজ্ঞদের যে দল অক্লান্ত, সফল ও সার্থক লড়াই লড়েছিলেন – কেশব পরাশরণ ছিলেন সেই আইনজ্ঞদের দলের কান্ডারী।
পেশাগত ভাবে স্বামীনাথন গুরুমূর্তি যদিও নিজে উকিল নন। তা সত্ত্বেও অর্থনীতি, হিসাবশাস্ত্র, রাজনীতি, আইন সহ বহুমুখী বিষয়ে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য আর বিপুল অভিজ্ঞতা তাঁকে নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ আর ঐতিহাসিক মামলায় দেশের সেরা আইনজ্ঞদের সহযোগী, সহকর্মী তথা সহযোদ্ধা হিসেবে যুক্ত থাকার সুযোগ করে দিয়েছে বহুবার। আর সেই সূত্রে তিনিও সঞ্চয় করেছেন বিপুল আর দুর্লভ সব অভিজ্ঞতা। রাম জন্মভূমি পুনরুদ্ধার আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য গুরুমূর্তি এই ঐতিহাসিক মামলার সাথেও ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত ছিলেন। আর তাঁর ঈর্ষণীয় বিপুল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই সেদিন নিজের ভাষণে গুরুমূর্তি বলেছিলেন – শুধুমাত্র আইনের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে এই মামলা লড়ার মতন যোগ্যতা হয়তো দেশের অনেক আইনজীবীরই ছিল এবং আছে। কিন্তু শুধুই অর্থমূল্যের বিনিময়ে কোনও লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী আদালতে সওয়াল করবেন – এই মামলা আদৌ সেই ধরণের ছিল না। এই ঐতিহাসিক মামলা আর তার চূড়ান্ত রায়কে সেদিন তিনি অভিহিত করেছিলেন “ন ভূত ন ভবিষ্যতি” এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করে। এমন ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম। এ এক এমনই ঘটনা যা অতীতে কখনও ঘটেনি – ভবিষ্যতেও আর কখনও ঘটবে না। গুরুমূর্তির মতে ভারতের বিচার ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটানো, আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক আর যুগান্তকারী এমন এক মামলায় সাফল্য পেতে প্রয়োজন ছিল আইনের সর্বোচ্চ স্তরের ব্যুৎপত্তি। কিন্তু সাথে প্রয়োজন ছিল তার থেকেও আরও অনেক বেশী কিছুর। আইনের বিষয়ে তাঁর প্রশ্নাতীত ব্যুৎপত্তির সাথে নিষ্ঠা, আন্তরিকতা আর প্রজ্ঞার মেলবন্ধনে ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ আর অন্তরাত্মার যে নির্যাস কেশব পরাশরণ এই মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতে উপস্থাপন করেছেন তা অন্য কারো পক্ষে হয়তো তেমন সুচারু ভাবে করা সম্ভব ছিল না।
স্বামীনাথন গুরুমর্তি সেদিন অকপটে বলেছিলেন – টেলিভিশনের পর্দায় যখন সর্বোচ্চ আদালতের সেই ঐতিহাসিক রায়ের খবর সম্প্রচার হচ্ছিল সেই সময়ে আবেগে, আনন্দে তাঁর পরিবারের সকলের চোখে ছিল জল। সেই সময়েই তাঁর সহধর্মিনী জানিয়েছিলেন তিনি কেশব পরাশরণকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে কৃতজ্ঞতা জানাতে চান। গুরুমূর্তি যেন তাঁকে সেই সুযোগ করে দেন। এই মামলার মূলগত বিষয় নিয়ে আসমুদ্রহিমাচল প্রায় প্রতিটা ভারতীয় পরিবারে আত্মমর্যাদা আর আবেগের উপস্থিতি কত গভীরে তা বোঝাতে গিয়ে তার শ্রোতাদের নিজের পরিবারের আর সহধর্মিনীর উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন পোড় খাওয়া গুরুমূর্তি। সেদিন তাঁর প্রতিটা শব্দ এঁকে দিয়েছিল ভারতের বৃহত্তর সমাজের এক নির্ভুল চিত্র। আদতে অভূতপূর্ব এই আন্দোলন আর তার সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত এই মামলা শুধুমাত্র মন্দির পুনর্নির্মাণের বিষয় ছিল না। ছিল এই পৃথিবীতে এখনও বর্তমান অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার কোটি কোটি ধারক আর বাহকদের আত্মমর্যাদা আর অতীত গৌরব রক্ষার সতস্ফূর্ত আকুলতা। ছিল ইতিহাস তাদের উপর যে অপমান, যে গ্লানির বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল তা ঝেড়ে ফেলে আবার ঋজু হয়ে উঠে দাঁড়ানোর সংগ্রাম। আর এমনটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল হলেও এর আগেও ঘটেছে।
১৯৬৩ সালে ভারতীয় বিদ্যা ভবন আয়োজন করেছিল মৌলানা আজাদ মেমোরিয়াল লেকচারের। সেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন পৃথিবী বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার আর্নল্ড জোসেফ টয়েনবী। টয়েনবী ছিলেন ব্রিটিশ আর একজন আদ্যন্ত পেশাদার ঐতিহাসিক। ভারতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ নিয়ে তাঁর কোনও আত্মিক টান থাকার কথা নয়। স্বাভাবিক ভাবেই ছিলও না। যদিও আর্নল্ড টয়েনবী নিজের বক্তৃতায় সেদিন যে কথা বলেছিলেন তার বছর তিনেক আগে ১৯৬০ সালে প্রথমবার প্রকাশিত তার বিখ্যাত বই “ওয়ান ওয়ার্ল্ড এন্ড ইন্ডিয়া”- এর ৫৯-৬০ পৃষ্ঠায় সে কথা তিনি লিখেওছিলেন। সেদিন টয়েনবী বলেছিলেন ভারতের মাটিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তার নিজের দীর্ঘদিন আগের এক অভিজ্ঞতার স্মৃতি তাঁর চোখের সামনে আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেই স্মৃতি পোল্যান্ডের রাজধানী শহর ওয়ারসা-র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষের কিছু পরে ১৯২০-এর দশকে সেখানে গিয়েছিলেন টয়েনবী। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ১৮১৫-তে প্রথমবার পোল্যান্ড দখল করে সেখানে তাদের প্রভুত্ব কায়েম করতে সফল হয়েছিল রাশিয়া। তার পরের কয়েক দশকে বেশ ক’বার পোল্যান্ডের মানুষদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সমর শক্তি দিয়ে দমন করেছিল সেখানকার রাশিয়ান শাসকেরা। কোনও ধর্মীয় ভাবাবেগ থেকে নয় বরং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে শুরু করে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে ওয়ারসা-র প্রাণ কেন্দ্রে পোল্যান্ডের রাশিয়ান শাসকেরা তাদের নিজেদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের চিহ্ন স্বরূপ গড়ে তুলেছিল জাঁকজমকপূর্ণ এক অতিকায় “ইস্টার্ন অর্থডক্স খ্রীষ্টান ক্যাথেড্রাল”। রাশিয়ানরা যার নাম রেখেছিল “আলেক্সান্ডার নেভস্কি ক্যাথেড্রাল”। যে গীর্জা সেই সময়ে হয়ে দাঁড়িয়েছিল একদা (রাশিয়ান আগ্রাসনের আগে) “রোমান ক্যাথলিক খ্রীষ্টান রাষ্ট্র” পোল্যান্ডের রাজধানী শহর ওয়ারসা-র সব থেকে উঁচু নির্মাণ কাঠামো। টয়েনবীর মতে – পোল্যান্ডের নাগরিকদের সামনে নিজেদের প্রভুত্বের স্থায়ী প্রদর্শনী করতেই রাশিয়ানরা সেটা করেছিল। এর নির্মাণের ইতিহাস প্রতি পদে অন্তত সেই সাক্ষ্যই বহন করে। আসলে প্রতিনিয়ত চোখে আঙুল দিয়ে পোল্যান্ডের মানুষদের রাশিয়ানরা দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল যে তারাই পোল্যান্ডের প্রভু।
১৯১৮-তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে রাশিয়ান আগ্রাসনের অবসান হলে আবারও নিজের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় পোল্যান্ড। আর স্বাধীন পোল্যান্ডের সরকার প্রথমেই রাশিয়ানদের তৈরী সেই গীর্জা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। শুধু তাই নয় – গীর্জা ভাঙার কাজ যতদিন ধরে চলেছিল ততদিন তার ধারাবিবরণী শোনানো হতো পোল্যান্ডের সরকারী রেডিওতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষের কিছু পরে ১৯২০-এর দশকে টয়েনবী সেখানে পৌঁছনোর কিছুদিন আগেই সম্পূর্ণ সরকারী উদ্যোগে সেই রাশিয়ান গীর্জা সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলে পোল্যান্ড। সেটাও সরকারী উদ্যোগে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য বিষয় এটাই যে রাশিয়ানদের মতনই পোল্যান্ডের মানুষরাও কিন্তু খ্রীস্ট ধর্মানুলম্বী। তবুও চোখের সামনে সটান দাঁড়িয়ে থাকা রাশিয়ান প্রভুত্বের চিহ্ন দুরমুশ করতে পোল্যান্ড এতটুকু দ্বিধা বোধ করেনি। অর্থাৎ সেই সময়ে ধর্মীয় ভাবাবেগকে ছাপিয়ে গিয়েছিল পোল্যান্ডের মানুষদের আত্মমর্যাদা আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার প্রশ্ন।
এর পরেই টয়েনবী বলেন পোল্যান্ডে তাঁর অতীত অভিজ্ঞতার সাথে ভারতে যে অভিজ্ঞতা তিনি সঞ্চয় করেছেন সেই দু’য়ের মধ্যে অদ্ভুত মিল তিনি খুঁজে পেয়েছেন। স্পষ্ট শব্দে সেদিন টয়েনবী বলেছিলেন – যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে পোল্যান্ডের রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে রাশিয়া তাদের নিজেদের সাবেকী ঐতিহ্যের গীর্জা বানিয়েছিল ঠিক সেই একই ইচ্ছাকৃত অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাশী, মথুরা আর অযোধ্যাতে তিনটি মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন ঔরংজেব, বাবরের মতন ভারতের মুঘল শাসকরা। ভারতের তথা সনাতন হিন্দুদের ধর্মীয় আস্থার পবিত্রের মধ্যে পবিত্রতম তিন কেন্দ্রে এই তিনটে মসজিদ আসলে ভারতে ইসলামী শাসনের প্রভুত্বের প্রতীক চিহ্ন। তিনি এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে প্ররোচনা দেওয়ার মতন পরিস্থিতি বা দৃশ্যপট সৃষ্টি করার এক অদ্ভুত উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর অনন্য পারদর্শীতা ঔরংজেবের ছিল। এ ক্ষেত্রে ঔরংজেব আর স্পেনের শাসক দ্বিতীয় ফিলিপকে জুড়িদার বলা যেতেই পারে। এরা আদতে খ্রীস্ট বা ইসলামের মতন আব্রাহামিক ধর্মের ধার্মিক উন্মাদনার নিষ্ঠুর অবতার স্বরূপ। ঔরংজেব আসলে অত্যন্ত খারাপ ধরণের ধর্মোন্মাদ আর আদতে দিগভ্রষ্ট এক মানুষ। যে তার ব্যর্থতার বিশাল বিশাল সৌধ নির্মাণ করতেই নিজের গোটা জীবন ব্যয় করেছে। স্বাধীনতা পাওয়ার পরেই পোল্যান্ডের মানুষ নিজেদের আত্মমর্যাদা আর সংস্কৃতির প্রতি যে সুবিচার করেছে ভারতীয়রা তা করতে পারেনি।
পরিশেষে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের বক্তৃতার অংশ বিশেষ উল্লেখ না করে এই নিবন্ধ শেষ করলে অনুচিত হবে। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পরে ১৯৫০-এ সোমনাথ মন্দিরের পুনর্নির্মাণ সম্পূর্ণ হলে তার উদ্বোধন করেছিলেন ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ। যে সোমনাথ মন্দির একাদশ শতাব্দীতে আরেক ইসলামিক আক্রমণকারী, মাহমুদ গজনীর আগ্রাসনে লুন্ঠিত আর ধ্বংস হয়েছে বারে বারে। সেই সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের পরে তার উদ্বোধন করে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেছিলেন – ধ্বংস্তুপের ছাই থেকে আবারো উঠে দাঁড়িয়ে এই ভব্য সোমনাথ মন্দির উচ্চকন্ঠে ঘোষণা করছে – যার প্রতি কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে অটুট বিশ্বাস আর নিঃসীম শ্রদ্ধা আছে তাকে চিরতরে মুছে দেওয়ার ক্ষমতা পৃথিবীর কোনও শক্তির নেই। আজ আমাদের এই প্রচেষ্টা ইতিহাসের ভুল শুধরে দেওয়ার জন্যে নয়। যে দৃঢ় বিশ্বাস, শ্রদ্ধা আর মূল্যবোধ ধারণ করে আমাদের সনাতন ধর্ম স্মরণাতীত কাল থেকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে অগ্রসর হয়ে চলেছে তার সাথে একাত্ম হওয়ার কথা নতুন করে আবারও উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।
(লেখক পরিচিতি: ইতিহাস চর্চায় ব্যাপ্ত নিবন্ধকার)
শ্রী অনিমিত্র চক্রবর্তী হলেন একজন সাংবাদিক ও বিভাগীয় লেখক (columnist) এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের এক সক্রিয় কর্মী।
Comment here