আমার ইতিহাসশাশ্বত সনাতন

দক্ষিণ রাঢ়ের দক্ষিণ প্রয়াগ বিবর্তন আক্রমণ ও প্রতিরোধের ইতিহাস

– শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার

 

অতঃ পরং প্রবক্ষ্যামি প্রাচলমনুত্তমম্ ।
তেজোহমৃতময়ং দিব্যং মহাপাতকনাশনম্ ।।
বিংশত্যা ঘৃতকুম্ভানামুত্তমঃ স্ব্যাদ্্ঘৃতাচলঃ।
দশভির্নধ্যমঃ প্রোক্তঃ পঞ্চভিস্ত্বধর্মঃ স্মৃতঃ।। (একোননবতিতমোহধ্যায়।) – মৎসপুরাণ

ঈশ্বর কহিলেন,— অতঃপর অনুত্তম স্বতা- চল-বিধান বলিতেছি। তেজ এবং অমৃতময় দিব্য ঘৃতাচল দান করিলে মহাপাতক নাশ পায়। বিংশতি কুম্ভ স্বতদ্বারা উত্তম, দশ কুম্ভে মধ্যম এবং পঞ্চকুম্ভ পরিমাণে অধম ঘৃতাচল হয়।

এখানে কুম্ভের সংখ্যা ন্যূনতম ৫ হতেই হবে উল্লেখ রয়েছে কিন্তু ভারতে বর্তমানে ৪ টি কুম্ভমেলা হয়। পঞ্চমটি কোথায়?

“বাম দিকে হালিশহর দক্ষিণে ত্রিবেণী
যাত্রীদের কোলাহলে কিছুই না শুনি।”

চণ্ডীমঙ্গল

একাদশ শতকের কুমারহট্ট থেকে একবিংশ শতকের হালিশহর— দীর্ঘ পথ চলার সাক্ষী শহরের গা ছুঁয়ে যাওয়া প্রবহমান গঙ্গা। প্রাচীন এই জনপদে গঙ্গা যেমন তার গতিপথ বদলেছে, তেমনি সময়ের সঙ্গে বদলেছে শহরের ইতিহাস।

রাঢ়ের প্রাচীন জনপদ ও পবিত্র তীর্থক্ষেত্র হলো সুহ্মক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত ত্রিবেণীধাম । পূর্বের এই স্থান একটা প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র মধ্যে পরিগণিত ছিল। এটি গঙ্গাতীরে, ২২°৫৮ ১০ উত্তর অক্ষাংশে ও ৮৮°২৬ ৪০´ পূর্ব দ্রাঘিমায় অবস্থিত।

ত্রিবেণী কেন প্রয়াগ সমতুল্য? একে দক্ষিণ প্রয়াগ কেন বলে ? এখানে মহাকুম্ভের ইতিহাস কি?

স্মার্ত রঘুনন্দনের প্রায়শ্চিত্ত তত্ত্বে পাওয়া যায় –

“প্রড়ায়নগরাদ ধামো সরস্বতা থোত্তরে।
তদ্দক্ষিণ প্রয়াগত্ত গঙ্গা। মুদ্রা গতা।
মায়া তজাক্ষয়ং গুণার প্রয়াগ ইব লক্ষ্য ॥”

মর্ম্ম ;—“প্রদ্যুম্ন নগরের ( পাণ্ডুয়ার ) দক্ষিণ ও সরস্বতী নদীর উত্তরে, দক্ষিণ প্রয়াগ। এই স্থানে গঙ্গা হইতে যমুনা চলিয়া গিয়াছেন। এখানে স্নান করিলে প্রয়াগে স্নানের ন্যায় অক্ষর পুণ্য লাভ হয়।”

“দক্ষিণ প্রয়াগ উন্মুক্তবেণী সপ্ত গ্রামাখ্যা দক্ষিণ দেশে ত্রিবেণীতি খ্যাত।”

মৰ্ম্ম ;—উন্মুক্ত বেণী দক্ষিণ প্রয়াগ, সপ্ত গ্রামের নিকট দক্ষিণ দেশের ত্রিবেণী নামে খ্যাত।

এতদ্বারা জানা যাচ্ছে, এই স্থান কেবল ‘ত্রিবেণী’ নামে অবিহিত নহে, পরন্তু তীর্থ-গৌরবে একে ‘দক্ষিণ প্রয়াগ’ আখ্যা প্রদান করা হয়েছে।

কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে ত্রিবেণী ধাম –

প্রাচীন কবিগণের বর্ণনায়ও এই স্থানের তীর্থজনিত সম্মান পরিলক্ষিত হয়। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম বলিয়াছেন ;-

“বাম দিকে হালি সহর দক্ষিণে ত্রিবেণী।
বাত্রিদের কোলাহলে কিছুই না শুনি ৷৷
লক্ষ লক্ষ লোক এক কালে করে স্নান ।
বাস হেম তিল ধেনু দ্বিজে দেয় দান ।
গর্ভে বসি শিব পূজা করে কোন
জন রজতের সিপে কেহ করয় তৰ্পণ ৷৷
শ্রাদ্ধ করে কোন জন জনের সমীপে।
সন্ধ্যাকালে কোন জন দের ধূপ দীপে ।”

কবিকঙ্কণ চণ্ডী – 

কবিকঙ্কণ এই ত্রিবেণীকে “তীর্থের চূড়ামণি” বলিয়াছেন। বৰ্ত্তমান কালেও এই স্থানের তীর্থজনিত সম্মান যথেষ্ট আছে, বারুণী ও মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে এখানে তিন দিবস ব্যাপী মেলা বসে, এবং বহু যাত্রী সমাগম হয়ে থাকে।

যমুনা, গঙ্গা ও সরস্বতী নামে তিনটি নদীর মিলন থেকে ত্রিবেণী নামটি পাওয়া যায়। সম্ভাব্য পূর্বে নামগুলি ছিল “মুক্তবেণী”, প্রয়াগে অবস্থিত গঙ্গার উপনদীনির্মিত যুক্তবেণী ত্রিবেণীতে এসে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে তৈরি করে মুক্তবেণী ।

“ত্রিস্রো বেন্য: বারিপ্রবাহা বিযুক্তা বা যত্র”

ত্রিবেণী স্নানের মাহাত্ম্য – 

ত্রিবেণী স্নানের অর্থ নিদ্রিতা শক্তি কুন্ডলিনীর জাগরণ ত্রিবেণীস্নানের মূলাধার পক্ষে হয়, যেখানে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না এই তিনটি নাড়ি একসাথে মিলিত হয়েছে ।

এক্ষেত্রে সরস্বতী নদী সুষুম্না হিসেবে কল্পিত, বামে যমুনা নদী ইড়া ও দক্ষিণে গঙ্গা নদী হলো পিঙ্গলা । এই গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীর সঙ্গমস্থল ত্রিবেণীধাম হলো মুলাধার । তাই ত্রিবেণীতে স্নান করলে সাধকের সুপ্ত শক্তি জাগ্রত হয়, জ্ঞানলাভের পথ প্রশস্ত হয় এবং স্নানার্থী অপার্থিব শান্তিলাভ করে । তাই ত্রিবেণীধামে স্নান পরম পবিত্র বলে এই স্থান পুণ্যক্ষেত্র বলে কথিত । সাধকরঞ্জন উল্লিখিত ত্রিপদী ছন্দের একটি কাব্য থেকে পাওয়া যায় –

“ইড়া বাসস্থানে পিঙ্গলা দক্ষিণে
মধ্যে নাড়ি সুষুম্না ।।
বামে ভাগীরথী মধ্যে সরস্বতী
দক্ষিণে যমুনা বয় ।
মূলাধারে গিয়ে একত্র হইয়ে
ত্রিবেণী তাহারে কয় ।।”

সরস্বতীর প্রবাহের পরিবর্তন –

ত্রিবেণীর বিখ্যাত হিন্দু দর্শনের এলাকা “শ্মশান ঘাট”-র পাশ দিয়ে সরু নদীখাতে প্রবাহিত হত সরস্বতী নদী যা ছিল সপ্তগ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে।

পরে এই নদীপথ ছেড়ে গঙ্গা নদী বিশেষ করে হুগলি বা ভাগীরথী নামে পরিচিত হয়ে সমুদ্রে মিলিত হয়। ব্রহ্মপুরাণে ত্রিবেণীমাহাত্ম্যে বর্ণিত হয়েছে ত্রিবেণীসদৃশ পবিত্র পুণ্যক্ষেত্র জগতে দ্বিতীয় আর নেই –

“न माधव समो देवो न च गंगा समा नदी ।
न तीर्थराजसदृशं क्षेत्रमस्ति जगत्रये ।।”

ত্রিবেণীসঙ্গমে স্নান তীর্থযাত্রার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ‘ঋগ্বেদ পরিশিষ্ট’ খণ্ডে ।

ত্রিবেণীর বিবর্তন –

মহাভারতে অতীতের ভুল এবং অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত তপস্যার উপায় হিসাবে ত্রিবেণীসঙ্গমে স্নান তীর্থযাত্রার উল্লেখ রয়েছে।

খ্রীঃ ১ম শতকে প্লিনি লেখেন – ‘That the ships near the Godaveri sailed from thence to Cape Palimerous thence to Tennigale opposite Fulta, thence to Tribeni’.

৭ ম শতাব্দীর বৌদ্ধ চীনা পরিব্রাজক জুয়ানজাং (হিউয়েন সাং) গৌড়াধিপতি মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কদেবের শাসনকালে প্রয়াগ ক্ষেত্রের উল্লেখ করেছেন, যাকে তিনি শত শত “দেব মন্দির” এবং দুটি বৌদ্ধ মঠসহ একটি পবিত্র হিন্দু শহর বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি নদীর সংযোগস্থলে হিন্দু স্নানের আচারের কথাও উল্লেখ করেছেন।

সেনযুগীয় ত্রিবেণী –

ধোয়ীর পবনদূত গ্রন্থে ত্রিবেণী-সঙ্গমের ভাগীরথীকেই বলা হয়েছে গঙ্গা।
…..

তৎ ক্ষেত্রও ত্রিদিবসরিতশ্চাতরা সেবনীয়ঃ শ্রীবল্লাল ক্ষিতিপতিযশোবান্ধবঃ সেতুবন্ধঃ।
…..

তৎ ক্ষেত্রও ত্রিদিবসরিতশ্চাতরা সেবনীয়ঃ
শ্রীবল্লাল ক্ষিতিপতিযশোবান্ধবঃ সেতুবন্ধঃ।
আরঢ়ানাং ত্রিদিবতটিনীস্নানহেতোজ’
নানাং যত্র ধোপ্যমরনগরী সন্নিকৃষ্টা বিভাতি ৷৷ ৩১ ৷৷

গঙ্গাং ফেনস্তবকম কুরং বাঁচিহস্তে বহন্তীং
সেবোস্তামথ পরিসর প্রৌঢ়হংসাবতৎসাম।

..
তোয়ক্রীড়াসরস নিপতৎস হ্মাসীমন্তিনীনাং
বীচাঁধোঁতৈঃ স্তনম,গমদৈঃ শ্যামলী ভূয় ভূয়ঃ ।
ভাগীরথ্যাস্তপনতনয়া যত্র নির্যাতি দেবী
দেশং যায়াস্তমথ জগতী পাবনং ভক্তি নম্রঃ ॥ ৩৩ ৷

উপরের শ্লোকে ভাগীরথীর ও যমুনার গতিপথ উল্লেখ রয়েছে। সেখানের বিষ্ণু মন্দিরেরো উল্লেখ রয়েছে।

লক্ষ্মণসেনের গোবিন্দপুর পট্টোলীতে বেতড়ে পূর্ববাহিনী নদীটি জাহ্নবী নামে অভিহিত। বল্লালসেনের নৈহাটি লিপিতে ভাগীরথীকে ‘সুরসরিৎ’ অর্থাৎ স্বর্গীয় নদী আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনবতুতা তাঁর ‘কিতাব-অল-রোহিলা’ ভ্রমনবৃত্তান্তে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, গঙ্গা ও যমুনার সংযোগস্থলে বাঙ্গালার সপ্তগ্রাম বন্দর সংলগ্ন ত্রিবেণী তে মূর্তিপূজক বা মুশরিকদের একটি তীর্থযাত্রার সমাবেশ হয় । দশম শতাব্দীতে কবি বিপ্রদাস পিপলাই এর মনসামঙ্গল গ্রন্থে চন্দ্রপতি বণিকের মধুকর ডিঙ্গা ত্রিবেণী প্রবেশের বর্ণনা নিম্নরূপ –

“দেখিয়া ত্রিবেণী গঙ্গা চাঁদরাজা মনে রঙ্গা
কুলেতে চাপায় মধুকর ।”

যমুনার প্রবাহে পরিবর্তন –

পশ্চিমবাংলার ত্রিবেণী সংগমের অন্যতম নদী যমুনা অতীতে প্রবহমান ও গুরুত্বপূর্ণ নদী ছিল। পঞ্চদশ শতকে বিপ্রদাস পিপলাই এর কালে

“যমুনা বিশাল অতি” বলে উল্লেখ করা আছে। ত্রিবেণী সপ্তগ্রামের বর্ণনায় বিপ্রদাস বলেছেন ‘গঙ্গা আর সরস্বতী যমুনা বিশাল অতি, অধিষ্ঠান উমা মাহেশ্বরী’। কালক্রমে যমুনা তার প্রবাহ হারিয়ে খালের আকারে বয়ে গঙ্গাতে পড়েছে আদিগঙ্গাকে বুজিয়ে যেভাবে কলকাতা শহর বসেছে সেভাবেই যমুনা নদী বুজিয়ে কল্যানী শহর।..ফলে নদীটি উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

আইন-ই-আকবরির লেখক আবুল ফজল ত্রিবেণীতে গঙ্গা যমুনা ও সরস্বতীর উল্লেখ করেছেন । ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম হেজেস ও ১৭৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দে স্ট্যাভরিনাস ত্রিবেণী পর্যবেক্ষণ করেছিলেন । দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত ‘গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিনী’ গ্রন্থে ত্রিবেণীধামের উল্লেখ রয়েছে । ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে জেমস রেনেলের বাংলার মানচিত্রে “টেরবোনি” নামে অভিহিত করা হয়েছিল।

সপ্তগ্রাম নামকরণের কারণ – 

সরস্বতী নদীর তীরে ত্রিবেণী সংলগ্ন বাংলার প্রাচীন ও এককালীন সমৃদ্ধশালী বাণিজ্যবন্দর হলো সপ্তগ্রাম । দক্ষিণ রাঢ়ের সুহ্মদেশের রাজা প্রিয়বন্ত’র মোট সাতজন পুত্র [অগ্নিত্র, মেধাতিথি, বপুস্মান, জ্যোতিস্মান, দ্যূতিস্মান, সবন আর ভব্য]| ত্রিবেণীধাম সংলগ্ন এই স্থানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, সংলগ্ন সাতটি গ্রামে তারা তাদের আশ্রম তৈরী করলো। এই সাতটি গ্রাম হলো বাসুদেবপুর, বাঁশবেড়িয়া, নিত্যানন্দপুর, কৃষ্ণপুর, দেবানন্দপুর, শিবপুর এবং বলদঘাটি,তাই এর নাম সপ্তগ্রাম । আচার্য রঘুনন্দনের ‘প্রায়শ্চিত্ততত্ত্বে’ উল্লেখ রয়েছে,

“দক্ষিণ প্রয়াগ উন্মুক্তবেণী সপ্তগ্রামোখ্যা
দক্ষিণা দেশে ত্রিবেণী খ্যাত:।”

বৈদেশিক বিবরণে ত্রিবেণী – 

খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোমান লেখক প্লিনি দ্য ইউলার এর বর্ণনাতে উল্লেখ করেছেন, সপ্তগ্রাম ভারতের এক বৃহৎ বন্দর ও সমুদ্রগামী জাহাজসকল সপ্তগ্রাম যাতায়াতকালে ত্রিবেণীতে নোঙর করতো । ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে ভেনেশিয় পর্যটক সিজার ফ্রেডরিক তাঁর ভারত ভ্রমণ বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন বিশাল সপ্তগ্রাম বন্দরে মোট ৩০-৩৫ টি জাহাজে মাল তোলা হতো । ইংরেজ পর্যটক বণিক রালফ ফিচ বলেছেন, “উত্তর আফ্রিকার শহরগুলির তুলনায় সপ্তগ্রাম রূপকথার নগরী ।” ষোড়শ শতকে মহারাজ রুদ্রনারায়ণের নেতৃত্বে সপ্তগ্রাম অঞ্চল ভূরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় ।

“পুর্টুগীজগণ চট্টগ্রামকে পোর্টো গ্রান্ডি বা বৃহৎ বন্দর ও সপ্তগ্রামকে পোর্টো পেকিনো বা ক্ষুদ্রবন্দর নামে অভহিত করিত। সময়ে সময়ে হুগলী ও পিপলী পোর্ট পেকিনো নামে কথিত হইত।

“১৫৭০ খৃঃ অব্দে ফ্রেড্রিক নামে একজন ইউরোপীয় বঙ্গদেশে আগমন করিয়াছিলেন, তিনি সপ্তগ্রামের বাণিজ্যের বিষয় উল্লেখ করিয়াছেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে ১৫৮৬ খৃঃঅব্দে প্রথম ইংরেজ র‍্যালফ ফিচ্ বঙ্গদেশে উপস্থিত হন। ফিচ বাঙ্গালার বহুস্থানের কার্পাস, কার্পাসবস্ত্র ও রেশমীবস্ত্রের প্রাচুর্যয়্যের বিষয় উল্লেখ করিয়াছেন। টাঁডা, কুচবিহার, হিজলী, বাকলা, শ্রীপুর প্রভৃতি স্থানের কার্পাস, কার্পাসবস্ত্র ও রেশমীবস্ত্রের বিষয় তাঁহার বিবরণে দৃষ্ট হয়। ফিচের বিবরণে সোনারগাঁওয়ের মসলিনের উল্লেখ আছে। তিনি উল্লেখ করিয়াছেন যে, হিজলীর একপ্রকার তৃণ হইতে রেশমীবস্ত্রের ন্যায় সুন্দর বস্ত্র নির্ম্মিত হইত। এতদ্ভিন্ন অপর্য্যাপ্তপরিমাণে ধান্য চাউলের উৎপত্তি ও বাণিজ্যের কথা তাঁহার বিবরণে দৃষ্ট হইয়া থাকে। সপ্তগ্রাম প্রভৃতির যে বাজারের বিষয় তিনি বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা হইতে জানা যায় যে, সেই সমস্ত বাজারের অনেক দ্রব্যের আমদানী রপ্তানী হইত।”
[“সোনার বাঙ্গলা” – শ্রী নিখিলনাথ রায়]

ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের পৃষ্ঠপোষনায় সপ্তগ্রাম অঞ্চলে সুবর্ণবণিক / সোনার বেনে সম্প্রদায়ের ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি হয়েছিল এবং তাঁরা তীর্থক্ষেত্রে প্রচুর দানধ্যান করতেন। ভূরিশ্রেষ্ঠ শাসনে সুবর্ণবণিকদের সমৃদ্ধি প্রসঙ্গে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন –

“সপ্তগ্রামের বেনে সব কোথা নাহি যায় ।
ঘরে বসে সুখ মোক্ষ নানা ধন পায় ।।
তীর্থ মধ্যে পুণ্যতীর্থ অতি অনুপম ।
সপ্তঋষি শাসনে বলয়ে সপ্তগ্রাম ।।”

খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীতে সপ্তগ্রামে –

রূপা বা পরম ভট্টারক শ্রীশ্রী ১০৮ রূপনারায়ণ সিংহ নামে বাগদী জাতীয় বৌদ্ধধর্মাবলম্বী একজন পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন; ইনি সপ্তগ্রামে একটি বিহার বা সঙ্ঘারাম প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন সপ্তগ্রামের সমৃদ্ধির পরিচয় সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের “কপালকুণ্ডলা” ও মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর “বেনের মেয়ে” নামক উপন্যাসে বর্ণিত আছে।

লক্ষ্মণসেন পরবর্তীকালীন রাঢ় ও প্রথম ইসলামী আক্রমণ
বল্লালের সময়ে কোন হিন্দু রাজা সপ্তগ্রামে রাজত্ব করিয়াছিলেন, তাহা নিশ্চিতরূপে বলিতে পারা যায় না, তবে লক্ষণে সেনের রাজত্বকালে মুরারি শর্মা রাজে রাজত্ব করিতেন এবং সপ্তগ্রাম তাহার রাজধানী ছিল।

১২২৫ তে কেশব সেনের বংশীয় বীর সেনের রাজধানী বীরভূমের লখ্নৌরের পতনের পর রাঢ়ের পশ্চিম সেন সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে অসংখ্য ছোট রাজ্য সৃষ্টি হয়।

মরারি শর্মার পর রাজা শত্রুজিত সপ্তগ্রামের শাসনকর্তা হয়েছিলেন। কবি কৃষ্ণরাম তৎপ্রণীত ষষ্ঠীমঙ্গল” নামক গ্রন্থে লিখেয়াছেন

“সপ্তগ্রাম যে ধরণী তার নাহি তুল।
চালে চালে বৈসে লোক ভাগীরথী হল ।
নিরবধি যজ্ঞদান পূণ্যবান লোক।
অকাল মরণ নাহি, নাহি দুঃখ শোক
শত্রুজিৎ রাজার নাম তার অধিকারী।
বিবরয়ে কত গুণে বলিতে না পারি।
নির্মল যশের দর্শী প্রতাপে তপন।
জিনিয়া অমরাপুরী তাহার ভবন।”

রাজা শত্রুজিতের বংশীয় কোন রাজার রাজত্বকালে ১২৯৮ খৃস্টাব্দে জাফর খাঁ সপ্তগ্রাম অধিকার করেন । সম্ভবত পান্ডুয়া কিসসায় উল্লিখিত বিখ্যাত রাজা।

“কাফেরের কাছেতে মোমিন মেছলমান
বাঘের নিকট রৈত বকড়ির সমান “
পান্ডুয়ার কিসসা

এনার প্রতাপ এমন ছিলো তে বহুকাল শাহ সুফি ও জাফর খাঁ চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি|

ত্রিবেণী ধামে ইসলামী শাসকদের আক্রমণ ও প্রতিরোধ –

১২৯২ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি সালতানাতের সিপাহসালার বাহরাম আইতিগিন জাফর খান গাজী ত্রিবেণী আক্রমণ করে । জাফর খানের নির্দেশে তুর্কি সেনা ত্রিবেণীতে প্রচুর গণহত্যা চালায়, হিন্দুদের ধর্মীয় শোভাযাত্রা বন্ধ করে দেয় ও ত্রিবেণীর পালযুগে নির্মিত একটি বিষ্ণু মন্দির ভেঙে দেয় । পবিত্র তীর্থক্ষেত্র ত্রিবেণীধামে জাফর খান হিন্দুদের জমায়েত নিষিদ্ধ করে এবং কুম্ভমেলা বন্ধ করে দেয় ।

এমন সময় বর্ধমানভুক্তির মহারাজা ভূদেব রায় ত্রিবেণী পুনরুদ্ধার ও হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন । ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দের মাঘী পূর্ণিমার দিন রাজা ভূদেব রায়ের নেতৃত্ব বর্ধমানের ভেদিয়ার সৈন্যবাহিনী ত্রিবেণী আক্রমণ করে । ইটাচুনার কাছে মহানাদের প্রান্তরে রাজা ভূদেব রায় আর জাফর খান গাজীর সাক্ষাৎ হয় । মহানাদের প্রান্তরে বর্ধমান সেনার সাথে দিল্লি সালতানাতের সেনার প্রবল যুদ্ধ শুরু হয় । এই যুদ্ধে মহারাজা ভূদেব রায় দিল্লির সেনাকে পরাস্ত করেন ও জাফর খান গাজীর মুণ্ডচ্ছেদ করে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেন । বর্ধমানের হিন্দু সেনা ত্রিবেণী ও সপ্তগ্রাম বিজয় করে, ত্রিবেণীধামে পুনরায় হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা হয় এবং পুনরায় কুম্ভমেলা শুরু হয় ।

হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে মাজার নির্মিত –

বড়খাঁ গাজীর সমাধির অভ্যন্তরে কয়েকটি প্রাচীন লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রায় একশাে বছর আগে মনিসাহেব ত্রিবেণী পরিদর্শন করতে গিয়ে বাংলা অক্ষরেই খােদাই করা এই লিপিগুলির সন্ধান পান। ব্রিটিশ শাসনামলে হুগলির সিভিল সারভেন্ট ডি. মানি (D. Money) তার পাঠোদ্ধার করেন (এশিয়াটিক সােসাইটির জার্নাল, ১৮৪৭ সাল, প্রথম ভাগ)। পরে বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ শ্রী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই পাঠ কিছু সংশােধন করে প্রকাশ করেন (সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৫ বর্ষ, ১ সংখ্যা)। রাখালদাসের সংশােধিত পাঠে, এখানে লেখা আছে – ১। শ্রীসীতানিব্বাসঃ–, ২।অভিষেক, ৩। শ্রীরামেণ রাবণ বধঃ, ৪। – র্য্যুদ্ধম, ৫। দৃষ্টদ্যুম্ন দুঃশাসনয়োর্য্যুদ্ধম্। এছাড়া আরও দুটি লিপি রাখালদাস উদ্ধার করেছেন – ১। খরত্রিশিরসােৰ্ব্বধঃ-, ২। বস্ত্রহরণঃ। এইসব টুকরাে-টুকরাে লিপি থেকে বােঝা যায় যে, জাফর খাঁর আস্তানাটি পূর্বে একটি বিষ্ণুমন্দির ছিল।

ভাগীরথী-গঙ্গার অভিমুখে জাফর খাঁ গাজীর মসজিদের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে বহু হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি। মূর্তিগুলি উল্টো করে বসানো। মূলত হিন্দুদের নেত্রপীড়া তৈরির উদ্দেশ্যেই দেবদেবীর মূর্তিগুলি মসজিদের দেওয়ালে উল্টো করে গাঁথা যে হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। এছাড়া মসজিদে রয়েছে সংস্কৃত লিপিও।

এ বিষয়ে “কেম্ব্রিজ হিস্ট্রি অব্ ইণ্ডিয়া” -র তৃতীয় খণ্ডে বলা হচ্ছে, “Curiously enough, it is not at Gaur, but at Tribeni in the Hughli District, that the oldest remains of Muslim buildings have survived. These are the tomb and mosque of Zafar Khan Ghazi, the former is built largely out of the material taken from a temple Krishna, which formerly stood on the same spot but now so multilated as to have lost most of its architectural value.”

এখানে বলা হচ্ছে, স্থানীয় কৃষ্ণ মন্দিরের সামগ্রী দিয়েই তৈরি হয়েছে এই মসজিদ। বলা যায়, আশেপাশের হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সেসব উপাদান দিয়েই তৈরি হয়েছে জাফর খাঁ গাজীর এই মসজিদ। বাঁটালি দিয়ে হিন্দু দেবদেবীদের নাক-মুখ কেটে তাদের পরিচয় লোপ করার চেষ্টা হয়েছে। তারপর পা নিচে এবং মাথা ওপরে করে সেই পাথরগুলো দিয়ে গাঁথা হয়েছে মসজিদের দেওয়াল। এটিও বাংলার মাটিতে তুর্কিদের ধর্মোন্মাদনার একটি ঐতিহাসিক প্রমাণ।

জাফর খাঁর গঙ্গাস্তবের myth/অতিকথার পিছনে কি !!!?

যৎতক্ত্যং জননী-গণৈর্ষদপি ন স্পৃষ্টং সুহৃদ্বান্ধবৈ-
যস্মিন পান্থ দিগন্ত সন্নিপতিতে তৈ স্মর্য্যতে শ্রীহরি।
স্বাষ্কে নস্য তদীদৃশং বপুরহো সংনীয়তে পৌরুষং
ত্বং তাবৎ করুণাপরায়ণপরা মাতাসু ভাগীরথী।

শোনা যায় এই শ্লোকটি নাকি জাফর স্তব করতেন ও তিনিই রচনা করেন। এরকম দাবি বহু ঐতিহাসিক করেন।

এটি আদৌও জাফরের লেখা না এটা আসলে বেদব্যাস রচিত গঙ্গাষ্টক স্তোত্র।
● সম্ভবত বলপূর্বক গণধর্মান্তরিত মুসলিমরা তাদের হিন্দু ঐতিহ্য ত্যাগ করতে পারেননি ।তারা গোপনে গঙ্গা উপাসনা করতেন। এবং এই বিষয়টা আরাফিদের পছন্দ ছিল না
● তাই তাঁরা জাফর খাঁকে জড়িয়ে এই myth/অতিকথা প্রচার করেন

এই অঞ্চলের মাজারগুলো নির্মাণ হোসেন সাহৈ করান । তাই একথা বললে ভুল হবে না হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে তার ওপরেই জাফর খাঁর মাজার নির্মীত।

ইলিয়াস শাহী আক্রমণ প্রতিরোধ – 

চতুর্দশ শতকে (১৩৭৩ খ্রি:) বিহার-লক্ষ্নৌতির ইলিয়াস শাহী গভর্নররা পুনরায় সপ্তগ্রাম দখল করে হিন্দুদের কুম্ভমেলা বন্ধ করে দেয়। এর বিরুদ্ধে রাঢ়ভূম ও বঙ্গভূম দুই অঞ্চলেই প্রবল প্রতিরোধ শুরু হয় । হিজলিপতি রাজা হরিদাস ভুঁইয়া রায় জোট নির্মাণ করে ইলিয়াস শাহী কেন্দ্র ‘ওলায়েৎ এ সাতগাহ’ (اولایت آ ساتگا) আক্রমণ ও বিজয় করেন । তাঁদের সম্মিলিত সৈন্যবর্গের যৌথ আক্রমণে সপ্তগ্রাম পুনরুদ্ধার হয় ও ত্রিবেণীধামে কুম্ভমেলা পুনঃসূচনা হয় ।

[১৪ শতকের মধ্যভাগ সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য সময়কাল। পূর্ব বঙ্গে সাভারে দ্বিতীয় বল্লাল সেনের বিজয়ের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গে সেন রাজশক্তির পুনরুত্থান ঘটছে। দেব সাম্রাজ্যের বিস্তারের মাধ্যমে হিন্দু রাজশক্তির পুনরুত্থান ঘটছে। সিকন্দর শাহ দক্ষিণ পশ্চিমে বিস্তার করার চেষ্টা করলেন। পূর্বস্থলী ও ভাল্কির শাসকরা দিল্লি লখনৌতির যুদ্ধের সময় দুর্বলতার সুযোগেই স্বাধীনতা অবলম্বন করেছিলেন। অন্যদিকে লখ্নূর ও সপ্তগ্রাম হাতছাড়া হয়েছিল।

সিকন্দর অভিযাণ প্রেরণ করেন যথাক্রমে ভাল্কির বিরুদ্ধে জামতাড়ার যূদ্ধে পরাজিত ও পূর্বস্থলী রাজ্যের বিরুদ্ধে বিজয়ী হন।
ত্রিবেণীর যুদ্ধে পূর্বস্থলীরাজ মুকুট রায় মারা যান।১৩৬৫ নাগাদ তিনি আরো পশ্চিমে বিস্তার করার চেষ্টা করেন।চকিত হামলা করে পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির লুন্ঠন করেন। ও পরবর্তীতে দক্ষিণ পশ্চিমে নিজের প্রভাব সুদৃঢ় করতে তাম্রধবজ রাজ্য আক্রমণ করে যা কিনা গঙ্গা সাম্রাজ্য ও দিল্লি সুলতানাতের buffer state ছিল।

১৩৬৯ হিজলির সামন্তরাজ হরিচরণ দাস ভুঁইয়ার নেতৃত্বে পুরো তাম্রধ্বজ রাজ্য একত্রিত হয়। হিজলির নৌযুদ্ধে সিকন্দর শাহের বাহিনী ধূলিসাৎ হয়ে ত্রিবেণী-সপ্তগ্রাম তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় আবার।হিজরীর পরাজয়ৈ সম্ভবত গৌড়ে রাজা গণেশের উত্থানের পটভূমি তৈরি করেছিল।]

ইবন বতুতার বিবরণীতে উল্লেখ পাওয়া যায় এসময় সপ্তগ্রামে বন্দরের কাছে মুশরিকরা সম্মিলিতভাবে লক্ষ্নৌতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল।ঘন ঘন কামানের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।অন্য তীরে একটি ঘাটে যমুনার ও গঙ্গার সংযোগস্থলে হিন্দুরা তীর্থযাত্রা করছিল।

হুসেন শাহের উড়িষ্যা আক্রমন ও কুম্ভমেলা নিষিদ্ধকরণ (১৫০৫ খ্রি:) :

এখন কিছু ইতিহাসবিদ জাফর খাঁ গাজি ত্রিবেণী কুম্ভমেলা বন্ধ করেন এই মত প্রচার করেন। কিন্তু এই তত্ত্ব আদৌও সঠিক নয় কারণ জাফরের আক্রমণে ত্রিবেণীর যথেষ্ট ক্ষতি ও অনেক মন্দির ধ্বংস হলেও পুণ্যস্নানযাত্রা বন্ধ হয়নি । তার প্রমাণ পাওয়া যায় রঘুনন্দনের শ্লোকে ও কিতাব উল রোহিলার বিবরণীতে। রঘুনন্দন খুব গর্বের সাথে সপ্তগ্রামের ত্রিবেণীকে দক্ষিণ প্রয়াগ বলে উল্লেখ করেন অর্থাৎ ত্রিবেণী কুম্ভমেলা তখনো বন্ধ হয়নি ।বরং হোসেন সাহের ক্ষমতা প্রয়োগের ফলে বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে| 

১৫০৫ সালে পান্ডুয়ার ( মালদা) সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উড়িষ্যা আক্রমণের জন্য এই অঞ্চল দখল করে । তিনি সপ্তগ্রাম থেকে ত্রিবেণী যাওয়ার জন্য সেতু নির্মাণের আদেশ দেন এবং এই অঞ্চলে কাফের হিন্দুদের জমায়েত নিষিদ্ধ করেন । আলাউদ্দীন হসেন শাহের সময়ে সপ্তগ্রামের নাম “হুসেনবাদ” রাখা হয়। তিনিই ত্রিবেণীর কুম্ভমেলা পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ করে দেন । উড়িষ্যা আক্রমণ করে তিনি বহু মন্দির ধ্বংস করেন ।

হোসেন শাহের রাজত্বকালে অনেক বেশী নতুন মসজিদ তৈরী হয়েছিল; কারণ মুসলিম আমলের বেশীর ভাগ শিলালিপিই মসজিদের গাত্রে উৎকীর্ণ। তার মধ্যে ৩১টিতে শিলালিপি পাওয়া গেছে। স্বয়ং সুলতান হোসেন শাহের নির্দেশে সুতী (মুর্শিদাবাদ), হজর পাওয়ার ছোটী দরগা, মৌলানাতলী (মালদহ ) প্রভৃতি জায়গায় মসজিদ এবং মচাইন (ঢাকা ), বনহরা (পাটনা), শাহ গদার দরগা (মালদহ ), ধরমাই ( ঢাকা ), বাঢ় (পাটনা) ও আরও দু’তিন জায়গায় জামী মসজিদ নির্মিত হরেছিল। তিনি গৌড়ে মখদুম শেখ আখী সিরাজুদ্দীনের সমাধিগৃহে দুটি দরজা এবং একটি সিকায়াহ্ বা জলসত্র তৈরী করিয়ে দিয়েছিলেন।

‘কদম রসুল’ ভবনের শিলালিপিতে হুলতান হোসেন শাহকে “ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষক” বলা হয়েছে, কাটাদুয়ারের শিলালিপিতে তাঁকে বলা হয়েছে “মুসলিম পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের প্রতি দয়াশীল” এবং জাহানাবাদের শিলালিপিতে তাঁর সম্বন্ধে লেখা হয়েছে, “যার উদ্যোগে ইসলাম বর্ধিত হচ্ছে।” সুতরাং হোসেন শাহ যে সত্যকার ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সৈয়দ বংশের সন্তানের পক্ষে- তা’ই হওয়া স্বাভাবিক । তার সময়কালে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার এতই বৃদ্ধি পায় যে হিন্দুরা বাধ্য হয়ে সত্যনারায়ণের সাথে সত্যপীরের কথা মিলিয়ে পাঁচালী লিখতে বাধ্য হন। চৈতন্যজীবনী গ্রন্থে হোসেন শাহকে ‘কালযবন’ বলেছেন স্বয়ং মহাপ্রভু।

চৈতন্যের যাত্রাপথে ত্রিবেণী ও আদিগঙ্গা –

জানুয়ারি মাসে বাংলা থেকে উড়িষ্যার দিকে গেলে সুন্দরবনের ছত্রভোগ সীমান্তের রক্ষক রামচন্দ্র খাঁ চৈতন্যদেবকে পান্ডুয়া সালতানাত-উড়িষ্যার যুদ্ধ সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন। রামচন্দ্র খাঁ যশোরের শাসক ছিলেন, ভবিষ্যতে তাঁকেই আমরা দেখবো বলপূর্বক ধর্মান্তরিত হতে। সম্ভবত সেই সময় উড়িষ্যার অধীনস্থ তাম্রলিপ্ত ও সালতানাতের সীমানা হিসেবে সরস্বতী নদীই ব্যবহৃত হত । নদীর অপর তীরে হিজলীর সামন্ত গোবর্ধন ভূঁইয়া তাম্রলিপ্তের পক্ষে এই অঞ্চল শাসন করতেন। যুদ্ধের পর তাজ খাঁ হিজলি অঞ্চল অধিকার করে মসনদ-ই-আলা উপাধি সেই অঞ্চলের শাসক হন। ভবিষ্যতে আমরা এই জায়গা থেকেই উড়িষ্যার লোহানি সালতানাতের বিস্তার ও দক্ষিণ রাঢ়ের হিন্দু রাজ্য গুলোর উপর আক্রমণ দেখব।

মহাপ্রভুকে নবদ্বীপ হতে সুলতানি মৃত্যু পরোয়ানা থেকে বাঁচতে ত্রিবেণী ও সপ্তগ্রাম হয়ে আদিগঙ্গা বেয়ে উড়িষ্যায় প্রবেশ করতে দেখি। এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে পূজা দেন । সম্ভবত এই অঞ্চলের শাসক শাক্ত রামচন্দ্র খাঁর অনুগ্রহ পেতেই উনি বৈষ্ণব হয়েও ত্রিপুরাসুন্দরীর পূজা দেন।

“শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয়’ নাটকে বলা হচ্ছে যে ঐ সময়ে দুই রাজ্যের মধ্যে বিবাদ নেই।১৫১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চৈতন্যদেব যখন উড়িষ্যা থেকে বাংলা আসার জন্য এগোন তখন তাঁকে উড়িষ্যা সীমান্তে কিছুকাল অপেক্ষা করতে হয়েছিল।উড়িষ্যা থেকে আগত হিন্দু যাত্রীদের উপর পাঠানরা অত্যাচার করত তাও উল্লেখ রয়েছে।

কবি কর্ণপুরের নাটকে এগুলি উল্লিখিত হয়েছে। তিনটি পথের মধ্যে জলপথ মাত্র খোলা আছে। বাংলার পান্ডুয়া সালতানাতের তুরস্ক সীমান্তরক্ষী সকলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। শ্রী কৃষ্ণদাস কবিরাজের “চৈতন্যচরিতামৃত” গ্রন্থেও ঐ একই কথা পাওয়া যায়। ১৫১৪ সালে দুয়ার্ত বারবোসা যখন উড়িষ্যা থেকে বাঙলাতে আসছিলেন তখন কোনো যুদ্ধ ছিল না। বলা যায় ১৫১২ থেকে ১৫১৪ সাল পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ ছিল। ১৫১৪ সালে চৈতন্যদেব যখন বাংলায় আসেন তখন দুদেশের মধ্যে সন্ধি আসন্ন ।

হোসেন শাহের রাজত্বকালেরই আর একটি ঘটনা থেকে জানতে পারি তাঁর মুসলমান উজ্জীররা কীভাবে কথায় কথায় হিন্দুর ধর্ম নষ্ট করতেন।এই রামচন্দ্র খানের রাজকর বাকী পড়ার হোসেন শাহের উজ্জীরের হাতে তাঁর কী অবস্থা হয়েছিল, তা কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি,

……রামচন্দ্র না দেয় রাজকর
ক্রুদ্ধ হঞা ম্লেচ্ছ উজীর আইল তার ঘর আসি সেই দুর্গামণ্ডপে বাসা কৈল।
অবধ্যবধ করি মাংস সে ঘরে রান্ধাইল ॥
স্ত্রী-পুত্র সহিতে রামচন্দ্রেরে বান্ধিয়া তার ঘর গ্রাম লুটে তিনদিন রহিয়া সেই ঘরে তিনদিন করে অমেধ্য রন্ধন।
আর দিন সভা লঞা করিল গমন।
জাতি-ধন-জন খানের সব নষ্ট হৈল।
বহুদিন পর্যন্ত গ্রাম উজাড় রহিল।

রাজকর না দেওয়ার জন্য রামচন্দ্র খানকে বন্দী করে এবং তার ঘর গ্রাম লুঠ করেও উজীরের তৃপ্তি হল না, তিনি হতভাগ্য রামচন্দ্রের দুর্গামণ্ডপে “অবধ্য ” অর্থাৎ গরু বধ করে তার মাংস তিনদিন ধরে রন্ধন করে তবে ক্ষান্ত হলেন!

#”পৈতা ছিঁড়িয়া ফেলে থুতু দেয় মুখে”

হোসেন শাহৈ কুম্ভস্নান বন্ধ করেন এটা আমরা এত নিশ্চিত হয়ে কিভাবে বলি ?

আসুন জেনে নিই “Chaitanya and His Age” গ্রন্থে শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন কি বলছেন।

মসনদে বসেই লুট করলেন নবদ্বীপ শহর। ফতেশাহের লক্ষ্যস্থল ছিল শুধু ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের উপর। অত্যাচার করতেন তাঁদের উপরেই। হুসেন শাহ কিন্তু ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিশেষ করে চৈতন্য অনুগামী বৈষ্ণবদের উপরই হয়ে উঠলেন রুষ্ট। ফতেশাহ ব্রাহ্মণদের উপবীত ধারণ নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু হুসেন শাহ তুলসীর মালা ধারণ করার উপরও করলেন নিষেধাজ্ঞা জারী। এমন কি আদেশ দিলেন তুলসী গাছ দেখলেই তা উপড়ে ফেলো। নিষিদ্ধ হল হরি সংকীর্তনও। স্নানের সময় গঙ্গার ঘাটে জমায়েত হত বৈষ্ণবরা, তাই বৈষ্ণবদের নিষিদ্ধ করেছিলেন গঙ্গা স্নান। এক কথায় বৈষ্ণব আন্দোলন যাতে দানা বাঁধতে না পারে, তার সব রকম ব্যবস্থাই নিলেন সুলতান হুসেন শাহ।

এখানে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে গঙ্গার তীরে স্নানযাত্রার সমাবেশ তিনি নিষিদ্ধ করেন । খুব সম্ভবত কুম্ভ মেলাও ওই সময় বন্ধ হয়ে যায়।

কররানি ও ভুরিশ্রেষ্ষ্ঠর ত্রিবেণীর যুদ্ধ (১৫৭৫ খ্রি:) – 

মহারাজা রুদ্রনারায়ণের রাজসভায় কবি মাধবাচার্য চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করেন, সেখানে তিনি ভূরিশ্রেষ্ঠের রাজাকে শ্রীরামচন্দ্রের সাথে তুলনা করে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন-

“অপার প্রতাপী রাজা বুদ্ধি বৃহস্পতি ।
কলিযুগে রামতুল্য প্রজাপালে ক্ষিতি ।।
সেই পঞ্চগৌড় মধ্যে সপ্তগ্রাম স্থল ।
ত্রিবেণীতে গঙ্গাদেবী ত্রিধারে বহে জল ।।
সেই মহানদী তটবাসী পরাশর।
যাগ-যজ্ঞে জপে তপে শ্রেষ্ঠ দ্বিজম্বর ।।”

১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভূরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের মহারাজা রুদ্রনারায়ণ টাণ্ডার কাররানী আফগান সুলতান সুলেমান খান কাররানীকে ত্রিবেণীর যুদ্ধে পরাজিত করে সপ্তগ্রাম বিজয় করেন । ভূরিশ্রেষ্ঠ সীমান্তে ত্রিবেণীতে পাঠান সৈন্যের সাথে ভূরিশ্রেষ্ঠ সৈন্যের যুদ্ধ শুরু হয় । ভূরিশ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর সেনানায়ক ছিলেন রুদ্রনারায়ণের জ্ঞাতিভ্রাতা রাজীবলোচন রায়ভাদুড়ি । উড়িষ্যার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব এই যুদ্ধে সহায়তা করেন এমন কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য ইতিহাসবিদদের কাছে পাওয়া যায়। “কুমারসদৃশ বীর্যশালী মহাবীর রাজীবলোচন বেগবান তুরঙ্গমোপরি আরোহণ করিয়া নিষ্কষিত অসি-হস্তে শত্রুব্যূহ ভেদ করতঃ অগণিত সুলতানি সৈন্য ধ্বংস করিতে আরম্ভ করিলেন ।” সম্পুর্ন দিবস ভীষণ যুদ্ধের পর অবশেষে পরাজিত হয়ে সুলতানি সেনা পালিয়ে যায় ও ত্রিবেণীধামে ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যর শাসন প্রতিষ্ঠা হয় ।

এরপর ১৫৭৫ পর্যন্ত সলেমান সপ্তগ্রাম পুনরাধিকারের জন্য বহু, চেষ্টা করেন কিন্তু উপর্যপুরি চারবার তার পরাজয় ঘটে। অতঃপর তিনি রুদ্রনারায়ণকে বহু, উপঢৌকন পাঠাইয়া দিয়া তাহার সহিত সন্ধি করেন ও সপ্তগ্রাম তাঁহাকে ছাড়িয়া দেন।

যুদ্ধজয়ের প্রতীক স্বরূপ মহারাজা রুদ্রনারায়ণ ত্রিবেণীধামে রাঢ়ীয় ( গৌড়ীয়) রীতিতে বিষ্ণুমন্দির ও একটি বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেন । এছাড়াও তিনি গঙ্গাতীরে গজগিরি-সংলগ্ন একটি ঘাট নির্মাণ করেন ।

ত্রিবেণীর সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল:

বাংলায় সংস্কৃতচর্চার জন্য চারটি স্থান অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল – নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, গুপ্তিপাড়া ও ত্রিবেণী । ত্রিবেণী সংস্কৃত শিক্ষাকেন্দ্রে মোট ৩০ টির অধিক গুরুকুল ছিল ।

ব্রিটিশ আমলে ত্রিবেণী –

ত্রিবেণীর আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য মুখের প্রভাবে ম্রিয়মান হলেও একেবারে অবলুপ্ত হয়নি।এই স্থানে মকরসংক্রান্তি, বিষ্ণু সংক্রান্তি, দুর্গাপুজো, দশহরা, বারুনী, সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ প্রভৃতি হিন্দুপর্ব উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হতো এবং সেই উপলক্ষ্যে সুবিশাল মেলা বসতো । ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবেণীধামে মোট ৫৩০০০ ভক্তের সমাগম হয়েছিল, যার মধ্যে একমাত্র মেদিনীপুর থেকেই ৩০০০০ ভক্ত সমাগত হয়েছিল । আজ এত বছর পরে আবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত আসুন আমরা একতাবদ্ধ হই । ত্রিবেণীকে তার পূর্বের গরিমায় ফিরিয়ে দিই।

তথ্যসূত্র:

 

  • হুগলি জেলার ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড— সুধীর কুমার মিত্র
  • Kitab ul Rohilla– Ibn Batuta
  • মধ্যযুগের বাঙলা 123 page
  • Culture of West Bengal(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি,বিষয় ঘোষ) Binoy Ghosh pp-491,686-691.
  • সোনার বাঙ্গলা – নিখিলনাথ রায়
  • শ্রীরাজমালা (দ্বিতীয় লহর) – কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণ 37
  • গৌড়ের ইতিহাস রজনীকান্ত চক্রবর্তী
  • Mutawalli Kursinama(متولي كورسيناما)
  • South Radh (দক্ষিণ রাঢ়) Ambikacharan Gupta
  • Raymangal (রায়মঙ্গল) Madhavacharya Krishnaram Das ,Haridatta, Rudradeva.
  • রায় বাঘিনী ও ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজকাহিনী-বিধুভূষণ ভট্টাচার্য
  • Chaitanya and His times Dinesh Chandra Sen
  • বৃহত্তর তাম্রলিপ্তের ইতিহাস যুধিষ্ঠির জানা

 

(লেখক পরিচিতি: শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার B.Tech Ceramic Technology তে পাঠরত)

 

Comment here