বিজ্ঞান

“অশ্বগন্ধা”

-শ্রী অংশুমান গঙ্গোপাধ্যায়

 

অশ্বগন্ধা (বিজ্ঞানসম্মত নাম — Withania somnifera) সোলানেসী (Solanaceae) গোত্রভুক্ত একটি সপুষ্পক গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ, যা Winter cherry নামেও পরিচিত। ভারতবর্ষে, ভারতীয় উপমহাদেশে, মধ্য – প্রাচ্যে, এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে এই উদ্ভিদ টি হতে দেখা যায়। উদ্ভিদের এই প্রজাতি টি আকারে ছোট, এবং উচ্চতায় ৩৫ – ৭৫ সেন্টিমিটার হয়। পাতা গুলি ঈষৎ সবুজাভ ( dull green ) , উপবৃত্তাকার এবং ১০ – ১২ সেন্টিমিটার মাপের হয়। ফুলগুলিও সবুজ এবং ঘণ্টা আকৃতির হয়ে থাকে। পাকা ফল কমলা বর্ণ ধারণ করে থাকে।

বৈজ্ঞানিক নামের মধ্যে প্রজাতি অংশের — “somnifera” শব্দের অর্থ হল —- নিদ্রাকারক বা sleep – inducing, এটি একটি ল্যাটিন শব্দ। ভারতীয় নাম — “অশ্বগন্ধা” শব্দ টি “অশ্ব” ( অর্থাৎ ঘোড়া ) , এবং ” গন্ধা ” ( অর্থাৎ গন্ধ কারক ) — এই দুটি সংস্কৃত শব্দের সমবায়। এই উদ্ভিদের মূলের গন্ধের সাথে ঘোড়ার শরীরের গন্ধের সাদৃশ্য কে এই শব্দবন্ধ নির্দেশ করে।

আয়ুর্বেদিক পথ্য রূপে, নানা জটিল ব্যাধির প্রতিষেধক রূপে, অনাক্রম্যতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিকাশে এবং গ্রহগত সমস্যার উপশমে ভারতীয় ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতির ক্ষেত্রে অশ্বগন্ধা একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম।

ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, চীন, ইয়েমেনের শুষ্কতর অঞ্চল গুলিতে অশ্বগন্ধার চাষ হয়ে থাকে। শুষ্ক, পাথুরে জমি, সাথে সূর্যালোক এবং আংশিক ছায়া অশ্বগন্ধার চাষের পক্ষে উপযুক্ত। বসন্তের শুরুতে বীজ বা বসন্তের শেষে cutting এর প্রয়োগ অশ্বগন্ধার চাষের ক্ষেত্রে আবশ্যক।

অশ্বগন্ধার চাষের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ক্ষতিকর পোকার প্রাদুর্ভাব, এবং রোগের সংক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশে Alternaria alternata নামক ছত্রাকের সংক্রমণে leaf spot disease হল অশ্বগন্ধার ক্ষেত্রে সব চেয়ে ক্ষতিকর। এই রোগের কারণে এই উদ্ভিদের জীবিত থাকা এবং প্রজননের পক্ষে কিছু গুরুত্বপূর্ণ secondary metabolites – এর অভাব পরিলক্ষিত হয়। Hemiptera গোত্রের এক ধরণের পতঙ্গ / পোকা, নাম — Treehopper — অশ্বগন্ধার কচি, সবুজ কাণ্ডের অগ্রভাগের অভ্যন্তরীণ কলা ( tissue of the apical portion of stem ) ভক্ষণ করে নেয়, — এর ফলে কাণ্ডের রঙ হয়ে ওঠে অমসৃণ, কাষ্ঠল ও বাদামী বর্ণের। Carmine red spider mite ( Tetranychus urticae ) নামক একটি মাকড় হল অশ্বগন্ধার ক্ষেত্রে সব চেয়ে ক্ষতিকর pest। ইদানীং বেশ কিছু বছর ধরে অশ্বগন্ধা একটি invasive মিলি বাগ ( mealy bug ) – এর প্রজাতির ( প্রজাতির নাম — Phenacoccus solenopsis ) ক্ষেত্রে reservoir host plant হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে।

শতাব্দী-প্রাচীন এই ভেষজ উদ্ভিদটির পাতা, ফুল, ফল, কাণ্ড ও মূল থেকে যে সকল প্রাকৃতিক, জৈব তত্ত্ব গুণ পাওয়া যায় এবং আয়ুর্বেদিক ঔষধ প্রস্তুত হয় তা হল —- প্রধানতঃ Withanolides নামক কিছু secondary metabolites, যার মধ্যে — Triterpene lactones, Withaferin A , কিছু alkaloids , steroidal lactones, tropine, cuscohygrine অন্যতম। মোট ৪০ প্রকার Withanolides, ১২ প্রকার Alkaloids এবং কিছু Sitoindosides নামক জৈব যৌগ এখনও পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে অশ্বগন্ধাজাত দ্রব্য গুণ এর প্রাকৃতিক তত্ত্ব ( active chemicals / active potentials ) রূপে প্রকাশিত হয়েছে।

Traditional Indian medicine হিসেবে বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত অশ্বগন্ধা হতে প্রস্তুত বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ঔষধ ( বিশেষত অশ্বগন্ধার root powder ) ও dietary supplements — ২০১৯ পরবর্তী বছর গুলিতে কোভিড অতিমারী পরিস্থিতিতে, কোভিড সংক্রান্ত চিকিৎসায় — জ্বর, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্ত – শর্করা কমাতে, সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ( immunity ) বৃদ্ধিতে
অত্যন্ত সহায়ক ও কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অকারণে বা বিনা প্রেসক্রিপশনে অশ্বগন্ধা সেবনের কারণে কিছু adverse effects / side effects বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়, যার মধ্যে —- ডায়েরিয়া, মাথা ধরা / মাথা ব্যথা ( headache ) , nausea ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গর্ভবতী ও মাতৃদুগ্ধপ্রদানকারী স্ত্রীলোক দের ক্ষেত্রে অশ্বগন্ধাজাত কোনো product সেবন উচিত নয়।

 

(লেখক পরিচিতি – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে জীববিদ্যায় ( Zoology ) অনার্স সহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন, তারপরে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন ” ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণ ” ( Zoological Survey of India) — প্রতিষ্ঠানে Junior Research Fellow হিসেবে যোগদান এবং প্রাণী বিজ্ঞান গবেষণায় অংশ গ্রহণ। বর্তমানে ” গ্রাম সমৃদ্ধি ফাউন্ডেশন ” সংস্থায় —- জৈব কৃষি সংক্রান্ত গবেষণায় নিযুক্ত)

Comment here