ব্যায়ামাচার্য শ্রী বিষ্ণুচরণ ঘোষ (বিষ্টু ঘোষ) ১৯০৩ সালের ২৪শে জুন আজকের দিনেই জন্মগ্রহণ করেন। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট। বয়স ১০ মাস হতেই, তার মা মারা যান।ছোট থেকেই তিনি খুব দুর্বল ছিলেন। কিন্তু ১৪ বৎসর বয়স থেকেই তার স্বাস্থ্যোদ্ধার হতে থাকে। তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিখ্যাত পরমহংস যোগানন্দ প্রতিষ্ঠিত রাঁচি স্কুল ফর বয়েজ এ উনি ভর্তি হয়েছিলেন। রাঁচি থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিষয়ক অধিকর্তা আর.এন.গুহ ঠাকুরতার ( পুরো নাম রাজেন্দ্র নারায়ণ গুহঠাকুরতা যদিও উনি রাজেন গুহ ঠাকুরতা নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন) কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন এবং এর ফলও পাওয়া যায় হাতেনাতে।
একদিন রাজেন ঠাকুরতার জিমনেশিয়ামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখেন জিমনেশিয়ামে একজন বলশালী মানুষ যাতায়াত করছেন। পরে জানেন ওনার নামই রাজেন ঠাকুরতা। ওনার কাছে যাওয়ার পর মাত্র তিন মাসে ওনার ৬৮ পাউন্ড দৈহিক ওজনের উপর আরও ৩২ পাউন্ড ওজন বৃদ্ধি পায় এবং বুকের ছাতিও নয় ইঞ্চি বৃদ্ধি পায়।
বিষ্ণুচরণ ঘোষ করতেন যে ভারোত্তোলন ও বডি বিল্ডিং-এর সাথে কেউ যদি হঠযোগ করেন তবে তার শরীর এবং মন দুইয়েরই উন্নতি সাধন হবে। এই তত্ত্বটিকে ভারতের ‘ফিজিক্যাল কালচার’ আন্দোলনের প্রথম সারিতে নিয়ে আসে এবং তিনি যে তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণও তিনি সবার সামনে তুলে ধরেন: বুকের উপর দিয়ে চলন্ত গাড়ি চলে যাওয়া, ১২ ফুট উপর থেকে পেটের উপড়ে ব্যক্তির ঝাঁপ, লোহার পাত বাকানো পরিণত করা ইত্যাদি।
আইন পড়ার সময় বিষ্ণুচরণ তারই এক কলেজের বন্ধু, কেশব চন্দ্র সেনগুপ্তের সাথে মিলে ‘Muscle Control and Barbell Exercise’ নামে একটি বই লিখে ফেলেছিলেন যেখানে মাংসপেশীকে কিভাবে আরও সুগঠিত ও সুঠাম বানানো যায় এবং তার উপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করা যায়, সেই পদ্ধতিগুলির আলোচনা করেন। পরবর্তীকালে বিষ্ণুচরণ নিজেই কলকাতায় ঘোষ কলেজ অব যোগা অ্যান্ড ফিজিক্যাল কালচার প্রতিষ্ঠিত করেন যেখানে উনি বিভিন্ন প্রকার শারীরিক কসরত শেখানোর পাশাপাশি ৮৪টি হঠ যোগ ভঙ্গির উদ্ভাবন করেন।
বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ওনার কাছ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে দেশ তথা গুরু বিষ্ণুচরণ ঘোষের নাম উজ্জ্বল করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছাত্ররা হলেন শ্রী মনতোষ রায়(প্রথম ভারতীয় মিস্টার ইউনিভার্স), তাপস ভট্টাচার্য(1918-1992)কমল ভান্ডারী ( ৮ বারের ভারতশ্রী)বুদ্ধ ঘোষ, বিক্রম চৌধুরি,শান্তি চক্রবর্তী ( Most Muscular man), ওংকার সাহা, হিতেন রায়।বিষ্টু ঘোষের আখড়া থেকে প্রত্যেকেই যারা বেরিয়েছেন তারা রত্ন।
ব্যায়ামের সব বিভাগেই ব্যায়ামাচার্যের অতুলনীয় দক্ষতা ছিল। সাধারণ মানুষ তাঁকে দেহগঠন ও যােগব্যায়ামের বিশেষজ্ঞ বলে জানে; কিন্তু কুস্তি, ভারােত্তোলন ও জিমন্যাস্টিক্সে পশ্চিমবঙ্গের স্থান যখন ভারতবর্ষের শীর্ষে, তখন ব্যায়ামাচার্যই ছিলেন এইসবের পুরােধা এবং তাঁরই সক্রিয় সহযােগিতায় তা সম্ভব হয়েছিল। তিনি যদিও ভারতবর্ষকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করবার সাধনা করেছিলেন তবুও যেহেতু কলকাতা তাঁর কর্মস্থল ছিল সেইহেতু বাংলার ছেলেকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করে দেশের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। তাঁর প্রখর দূরদৃষ্টি ছিল; যেকোন ছেলেকে দেখে, তিনি বলে দিতে পারতেন ব্যায়ামের কোন বিভাগে গেলে সে পারদর্শিতা অর্জন করতে পারবে এবং তিনি তাকে সেই বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে Champion করে দিতেন।
তিনি সবাইকে বলতেন – নিজেকে কখনও বড় বলে মনে করবেনা। মানুষকে, হুকুম করে নয় ভালবেসে জয় করবার চেষ্টা করবে। তােমার শত্রুও যদি ব্যায়ামের প্রচারের জন্য তােমার সাহায্য চায়, তুমি তাকে ফিরিয়ে দেবেনা।ওনার ভাই সানন্দলাল ঘোষ প্রথম রবীন্দ্রনাথের পুর্নায়ব ছবি তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার প্রশংসা করে ঘোষেস ষ্টুডিওকে প্রশংসাবাক্য লিখে দিয়েছিলেন।
একবার তার শোয়ার ঘরে বিরাট আয়নার সামনে বাইসেপ কার্লিং করছিলেন প্রিয় ছাত্র কমল ভান্ডারী। গুরু একটু ঘুমিয়েছেন দেখে যেই ডাম্বেল নামাতে যাবেন ওমনি গুরু বলে উঠলেন বাবা দুটো সেট যে কম হল। আবার করো। বিশ্বশ্রী মনতোষ রায় তখনো বিশ্বশ্রী হননি।গুরু কে জিজ্ঞেস করলেন এত ব্যায়াম করছি খাবো যে অর্থ কই। মাংস মাছ চাই।সামনেই মাঠে চরছিল একটা নধর গরু।বিস্নুবাবু বললেন দেখ ওই গরুটার কি সুন্দর চেহারা।ওরা কি খায় বলতো? ব্যাস নিমেষে উত্তর পেয়ে গেলেন।
ওনার ব্যায়াম প্রনালীও অসাধারন ছিল।ছাত্র মনোতোষের শরীর প্রবল অসুস্থ হয়ে ভেঙে পড়ে।এদিকে বিশ্বশ্রী প্রতিযোগিতার বাকি ২ মাস।কিভাবে যাবেন? সুস্থ হতেই গুরু পাঠান পুরীতে। বালি ভর্তি বালতি নিয়ে চলে ব্যায়াম। ম্যাজিক! একমাসে সেই আগের শরীর।কলকাতায় ফিরে পরের একমাস ধরে কঠোর সাধনা চলে।খালি মনতোষ জামা খোল,পোজ দাও।অন্যথা হলেই এক চড়।এসব ছাত্র বিশ্বশ্রী প্রয়াত মনোতোষ রায় লিখেছিলেন “শিশুসাথী” পত্রিকার ‘শরীরচর্চার বৈঠক’ কলামে।
তিনি নিজেই ছাত্র খুঁজে বেড়াতেন। কমল ভান্ডারীকে কলেজ থেকে ধরে এনে ছাত্র করেছিলেন।ওনাকে নিয়ে গোবর গোহের কাছে গেছিলেন।গোবরবাবু হাত দিয়ে মাসল দেখে খুব প্রশংসা করেন। ব্যায়ামকে জনপ্রিয় করে তুলতে সেকালে দুর্গাপুজো এবং কালীপুজোর মণ্ডপে মণ্ডপে বডিবিল্ডিং শো হতাে। বিখ্যাত ব্যায়ামবীরেরা তাতে অংশ নিতেন। মাইক হাতে বিষ্টুবাবু ব্যাখ্যা করতেন কোন্ পেশীর কী নাম, কী তার গঠন, কেমন তার সঞ্চালন ইত্যাদি। অতীব জনপ্রিয় ছিলাে এই শাে গুলি। ভিড়ে তিলধারণের স্থান থাকতাে না। এক মিশনের মতাে ছিলাে ওঁর কাছে এই শাে গুলি। উদ্দেশ্য ছিলাে বাঙালিকে জাগিয়ে তােলা, তাদের ব্যায়ামাগারমুখী করা। শুধু কলকাতা শহরেই নয়, জেলা জেলাতেও এহেন ব্যায়াম-প্রদর্শনীর আসর বসতো।
মহানায়ক উত্তমকুমারের মামাবাড়ি ছিলো উত্তর কলকাতার আহিরীটোলাতে। উত্তমের মামাবাড়িতে আসতেন বিষ্টুবাবু। ততদিনে ‘বসু পরিবার’ ছবি খ্যাতি এনে দিয়েছে উত্তমকে। বিষ্টুবাবু ওজন নিয়ে ব্যায়াম করতে শেখান যুবক উত্তমকুমারকে। তাঁর নির্দেশে ছাত্র মনােতােষ রায় সপ্তাহে তিন দিন উত্তমের বাড়ি গিয়ে ব্যায়াম দেখিয়ে দিয়ে আসতেন ও ম্যাসাজ করতেন। বলেছিলেন একে ভারতশ্রী করবই। হয়েও ছিলেন তাই। হিন্দু মুসলিম রায়টের সময় বহু দুবৃত্ত শায়েস্তা করেছেন এই বিষ্টু ঘোষের দলবল। আকাশবাণীতে ও নানা ম্যাগাজিনে ব্যায়াম নিয়ে ক্লাস নিয়েছেন ও কলম ধরেছেন। আমি শুকতারার একটি সংখ্যায় *ভিড় করো না কেউ* বলে একটি সুন্দর লেখা পড়েছিলাম। সে লেখা আগ্রহীরা পড়তে পারেন। বিষ্ণুচরণ ভারতীয় অলিম্পিক কমিটিতেও দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। তিনি জাপানে যোগের প্রচলন করেছিলেন এবং আমেরিকাতেও যোগের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
বিষ্টু ঘোষ যেমন খেতে ভালোবাসতেন তেমন খাওয়াতেও।সে গল্প করেছেন তার ছাত্র প্রয়াত ব্যায়ামতাপস শ্রী তাপস ভট্টাচার্য। কি সেই গল্প? একবার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখলেন রাস্তায় পকোড়া ভাজা হচ্ছে। সাথে সাথে কিনে খাওয়া আরম্ভ..’সেকি এতবড়ো ব্যায়ামবীর শেষে রাস্তার পকোড়া?’ ছাত্রকে বললেন লোককে তবেই না বলতে পারব ব্যায়াম করে সব হজম করতে পারি।
আরেকবার দেখলেন আখড়ার পাশ দিয়েই হেটে যাচ্ছে এক ঘুগনীওলা।।ডাকলেন..এই কত টাকার আছে? ১২ টাকার আছে! ১০ টাকার হলে সব দাও। কিনে নিলেন এক হাঁড়ি ঘুগনী। দিলেন ছাত্রদের। গুরুও বাদ যাননি সে থেকে।আরেকবার ছাত্র তাপসকে আর প্রভাস কে বললেন ‘চ’ তো একজায়গায় যাই,’ বলে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করলেন। সোজা শ্যামবাজারের এক গলিতে। গুমটি দোকানে শিঙাড়া ভাজছে…বললেন দুটো করে দাও। খেয়েই ছাত্ররা মুগ্ধ। আবার অর্ডার এল দুটো করে।প্রত্যেকে ছটা করে শিঙাড়া খেয়ে ফিরলেন।
প্রয়াত শ্রী তাপস ভট্টাচার্য (ওনার সুযোগ্য ছাত্র) লিখেছেন, বিষ্টুদার স্বাস্থ্য পরীক্ষার একটা অদ্ভুত পদ্ধতি ছিল, সাধারণ মানুষের কাছে যা অবিশ্বাস্য। তিনি নিজেই নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতেন। কোন ডাক্তারের প্রয়ােজন হত না। বর্ষাকাল, মুসলধারে বৃষ্টি পড়ছে আর প্রবল বেগে ঝড় বইছে। বিশেষ প্রয়ােজনে দুপুর বেলা তাঁর বাড়ীতে গেছি, দেখি বিষ্ণুদা নেই। আমায় দেখা করতেই হবে। যতক্ষণ না ফেরেন আমাকে অপেক্ষা করতেই হবে। একা বসে বসে ভাবছি এত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিষ্ণুদা কোথায় গেলেন। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, এমন সময় মােটর সাইকেলের আওয়াজ পেলাম। বেরিয়ে দেখি বিষ্ণুদা। সর্বাঙ্গ ভেজা, দেখেই বুঝলাম সমস্ত ঝড়-বৃষ্টি ওঁর মাথার ওপর দিয়ে গেছে। আমাকে দেখেই বললেন – বস, জামা কাপড় বদলে আসছি। কিছুক্ষণের মধ্যে শুকনাে জামা-কাপড় পরে বসবার ঘরে এলেন। মুখে চোখে কোন ক্লান্তি নেই। আমি বললাম- সারাদিন আপনি জল-ঝড়ে মােটরসাইকেল করে ঘুরে বেড়ালেন শরীর খারাপ হয় যদি। উত্তরে বললেন – স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছিলাম। শরীরকে ত সব সময় রুটিন মাফিক চালাই তাতে শরীরটা ঠিক থাকে। বছরে দুচার দিন এই বকম অত্যাচার করে দেখি কোন অসুখ করছে কিনা। যদি অসুখ করে তাহলে বুঝব ভেতরে কোন গলদ ছিল, তা নাহলে শরীরটা ঠিক আছে বলে মনে করি।
সাংবাদিক তরুন গোস্বামী স্মৃতিচারণা করেছেন,যে একবার বিয়ে বাড়িতে গিয়ে শেষ পাতে বসেছেন। খাওয়া দেখে মন ভরেনি।ধুর।কর্তাকে ডেকে বললেন যা মাংস আর রসোগোল্লার বালতিটা বসিয়ে দিয়ে যা। চোখের নিমেষে উধাও সব। ওনার বাইকপ্রীতিও ছিল দারুন।দারুন বাইক চালাতেন।একবার নেতাজী কে বসিয়ে হাইস্পীডে বাইক চালালেন।।ভেবেছিলেন ভয় পাবেন।পাননি।দেখলেন শান্ত হয়ে বসে নেতাজী।যেন কিছুই হচ্ছেনা।উনি বাইক থামিয়ে নেতাজীর পায়ে প্রণাম করেন।
।
বিষ্টুবাবু বলতেন বাবা বেশী করে জল খেয়ো, একটা পিয়ারা খেয়ো, কলা খেয়ো।এই ছিল তার সহজ ডায়েট। ১৯৭২ সালে উনি মারা যান CMRI হাসপাতালে। ওনার সাধের জিমনেশিয়াম বহুদিন বন্ধ।সম্প্রতি ইউটিউবে দেখলাম ওনার ডাম্বেল ও ওয়েট গুলো কলকাতার এক ব্যায়ামাগারে রাখা হয়েছে। প্রত্যেক প্লেটে নাম লেখা “BISHNU GHOSH”.দাদা পরমহংস যোগানন্দ বিখ্যাত ইয়র্কশায়ার ডাম্বেল পাঠিয়ে ছিলেন ভাইকে কলকাতায়, তার ব্যায়ামের জন্য। ওনার উত্তরসুরীরা যোগসাধনা কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
বিষ্টু ঘোষ আজও বেঁচে সব আখড়ায়। প্রকৃত ব্যায়ামসাধকদের মধ্যেই তার আদর্শ অনির্বাণ দীপ্তিতে জ্বলছে।
হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতক পাঠরত।
অবসরে বইপড়া,হাওয়াইন গীটার ও তবলা বাজানো, ও অবশ্যই আখড়ায় ব্যায়াম।
ভাল লাগল, বাঙ্গালী আখাড়ার ইতিহাস রচনা অত্যেন্ত দরকার, লেখকের কাছে অনুরোধ রইল এই বিষয়ে আরও লেখার জন্য
নেতাজির বাইক আরোহণ সম্পর্কে জানতে পেরে সমৃদ্ধ হলাম। আমাকে জানাবেন এই তথ্যের উৎস ….