তর্পণে প্রণত মসীশাশ্বত সনাতনস্বভূমি ও সমকাল

সাভার সেন বংশ –

-শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার

 

ঐতিহাসিক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণে সর্বাধিক প্রয়োজন ঔদার্যের, যা বিনা পক্ষপাতদুষ্ট বীক্ষণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় শ্রেষ্ঠত্বের আবহ। অতীব পরিতাপের বিষয়, ভারতবর্ষের ইতিহাস চর্চা এ পশ্চাদ্গামীতা হতে ব্যতিক্রম নয়। প্রাদেশিকতা ও দম্ভের আধিক্য প্রখর, বৈজ্ঞানিক ইতিহাস চর্চা, সর্বোপরি শাশ্বত সত্যকে ব্যাহত করে অনেকাংশেই এবং এই নিকৃষ্ট আক্রমণ ধাবিত হয় বাঙ্গালীর দিকে বারংবার। বঙ্গমাতা কি বীর প্রসবিনী নন? বাঙ্গালী কি রক্তাক্ত সংঘর্ষে আবদ্ধ হয়নি মাতৃভূমির শৃঙ্খলামোচনে ঐসলামিক বিধ্বংসীতার বিরুদ্ধে? প্রত্যেক ক্ষেত্রেই উত্তর ইতিবাচক এবং প্রচন্ডরূপে।

১৩৭৫ খ্রি বা ১২৯৭ শকাব্দে প্রদত্ত সাভার অঞ্চলে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। যথারীতি প্রশ্ন উঠতে পারে এটা কোন সেন বংশ?

যখন প্রসঙ্গ সেন বংশের আছে তখন পূর্ববর্তী ইতিহাস নিয়ে কিছুটা জানা উচিত।

যেহেতু তথাকথিত ইতিহাসবিদরা লক্ষণ সেনের পরাজয় তত্বটিকে বহুল প্রচার করেছেন সেহেতু পরবর্তী সেন বংশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় না।

‘চতুর্বিংশোত্তরে শাকে সহস্ৰৈক শতাব্দীকে।
বেহার পাটনাত্ পূৰ্ব্বং তুরস্কঃ সমুপাগতঃ।।’ (হলায়ুধ মিশ্রের ব্রাহ্মণ সর্বস্ব)

এখান থেকে জানা যায় পাটনা বিহার দখল হয় ১২০২-৩ খ্রি:(১১২৪শকাব্দ)।

● ১২০৩ খ্রি : রাজমহলের জঙ্গলময় অঞ্চল দিয়ে বখতিয়ার খিলজি প্রায় ১৮,০০০(১৮ না,ওটি একটি অতিরঞ্জন) তুর্কি সৈন্য নিয়ে বৈষ্ণব তীর্থক্ষেত্র একটি অসফল আক্রমণ চালায় । নবদ্বীপে এসময় অধিক সৈন্যসংস্থান না থাকায় গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণ সেন এ-সময় শঙ্খহট্টে/বিক্রমপুর গমন করেন সৈন্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এবং নৌ ও হস্তি,অশ্বারোহী( নৌবল হস্তাশ্ব) বাহিনী নিয়ে ফিরে এসে বখতিয়ার খিলজিকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাস্ত করেন ।

এই প্রাথমিক পশ্চাদ অপসারণটিকেই অতিরঞ্জিত করে পলায়ন হিসেবে দেখানো হয়।

উমাপতিধর’রে দেবপাড়া শিলালিপির শ্লোক থেকে জানা যায়, এই যুদ্ধে ৭০ বর্ষীয় বৃদ্ধ সম্রাট লক্ষ্মণ সেন বিশাল হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করে ধনুর্বানসহ খিলজিদের প্রতিহত করেন, গজারূঢ় মারাঙ্কমল্লদেব লক্ষ্মণসেন ম্লেচ্ছ বখতিয়ারকে শাণিত তীর দিয়ে আহত করেন, যা তার হাতে আঘাত করায় সে অস্ত্র হারিয়ে ফেলে ও ‘হাতিয়ার হাতিয়ার’ আর্তনাদ করতে থাকে ।

“সাধু ম্লেচ্ছনরেন্দ্র সাধু ভবতো মাতৈব বীরপ্রসূর্-
নীচেনাপি ভবদ্বিধেন বসুধা সুক্ষত্রিয়া বর্ততে
দেবো কূট্যতি বস্য বৈরিপরিযম্মারাঙ্কমল্লে পুরঃ
শস্ত্র শস্ত্রমিতি স্ফুরতি রসনাপত্রান্তরালে গিরঃ।।”

অধিকাংশ ঐতিহাসিকরা যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে primary source বা পাথুরে প্রমাণ চান তাঁরা এই ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নীরব। এবার আমাদের মনে রাখা দরকার লক্ষণ সেনের বিষয়ে যে myth তবকাতে-নাসিরির লেখক মিনহাজ কিন্তু নিজে চোখে দেখে লেখেননি। তিনি লিখেছেন ৪০ বছর পর ছাতনা-শিখরভূম-লখনৌতির লখ্নূর-কাটাসিনা যুদ্ধের সময় এক সৈনিকের মুখ থেকে শুনে।

অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন বক্তিয়ারের মুদ্রা যেহেতু দেবীকোট থেকে পাওয়া গেছে তাই গৌড়- লখ্নৌতী বিজয় হয়ে গিয়েছিল ১২০৪-৬ নাগাদ। কিন্তু তৎকালীন ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান কোন নদীর প্রবাহ বিচার না করে এই সিদ্ধান্তে কি আসা উচিত?

শ্রী রজনীকান্ত চক্রবর্তীর ‘গৌড়ের ইতিহাস’ থেকে আমরা জানতে পারছি মিস্টার উইলফোর্ডের মত অনুসারে গঙ্গা সেসময় গৌড়ের উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত হতো।

তওকাতে নাসিরী অনুসারেও গৌড় নগর গঙ্গার পশ্চিমভাগে অবস্থিত। এবং পূর্বভাগে দেবীকোট।

সুতরাং দেবীকোট কে কোন ভাবেই লখনৌতি বলা যায়না।

লখনৌতির অবস্থান বর্তমান মালদার পান্ডুয়াকনকপুর এলাকায়। গৌড় প্রথমবারের জন্য বিজয় হয় ১২১৫ তে। শ্রী নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় তাঁর ‘বাঙালির ইতিহাস’ রাজন্য কাণ্ডে এই মতকেই সমর্থন করেছেন।

°⚔️ বস্তুত এই যুদ্ধে পরাজিত হয়েই বখতিয়ার বিহারে পালিয়ে যায় । লক্ষণ সেন এর তিন পুত্র এসময় বাংলার তিন অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণ করে —

📌বরেন্দ্রভূম অঞ্চলে পরমসৌর মহারাজাধিরাজ মাধব সেন – রাজধানী গৌড় । মাধব সেনের বিষয়ে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলে শাসক ছিলেন এটুকু জানা যায় শ্রী জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমারের ‘বংশপরিচয়’ তৃতীয় খন্ড থেকে, একই সঙ্গে বরেন্দ্র অঞ্চলে তুর্কিদের সাথে যুদ্ধ উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও সেন বংশের সামন্ত দনুজারি ও মাধব সেনের নদিয়া অঞ্চলে তুর্কি প্রতিরোধের বিষয়েও জানা যায় শ্রী নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ রাজন্য কান্ড থেকে। কুমায়ুন অঞ্চলের যোগেশ্বর মন্দির শিলালিপি থেকে এটুকু জানা যায় যে তিনি সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। সম্ভবত ১২০৭ বা তার আশেপাশে।

এবার আমরা জয় সেন বিশ্বাসের ‘সদ্বৈদ্য কূল চন্দ্রিকা থেকে কয়েকটি’ শ্লোকে কেশব ও বিশ্বরূপের উল্লেখ পাচ্ছি যা থেকে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হয়।

শ্রীমল্লম্মণসেন জজ্ঞিয়ে পুত্র কাস্ত্রয়ঃ।
ধৰ্ম্মপালসুতরাঞ্চ বসুদেব্যাস্তনূদ্ভবাঃ।।
অগ্রজো মাধবস্তেষু পূৰ্ব্বমেব দিবং যযৌ।
কেশবো বিশ্বরূপশ্চ রাজ্যভাজৌ বভুবতুঃ ।
পূর্ব্বরাজ্যং রামপালং বিশ্বরূপোং-নুজোং-শিষৎ। কেশবঃ পশ্চিমে ভাগে গৌড়াখ্যেঽভূন্নরাধিপঃ।
স লাক্ষ্মণেরাম্রাগীৎ প্রসিদ্ধঃ পিতৃনামতঃ।

উপরোক্ত শ্লোকাংশ থেকে যে সিদ্ধান্তে আসা যায় ১২০৬ তে লক্ষণ সেনের মৃত্যুতে রাজ্য দু’ভাগে ভাগ হয়। কেশব পায় পশ্চিমভাগের গৌড় অঞ্চল এবং তার রাজধানী ছিল লাক্ষণের বা লখনুর অঞ্চলে ও এবং বিশ্বরূপ পায় রামপাল প্রদেশ (বিক্রমপুর)। যদিও পূর্বের ন্যায় গৌড় রাজধানী ছিল না। তবু তাতেও গৌড়ের প্রসিদ্ধি হ্রাস পায় নি।

📌রাঢ়ভূম অঞ্চলে পরমসৌর মহারাজাধিরাজ কেশব সেন- রাজধানী রাজনগর বা লাখনুর।

📌বঙ্গভূম অঞ্চলে পরমসৌর মহারাজাধিরাজ বিশ্বরূপ সেন- রাজধানী বিক্রমপুর ।

●⚔️ ১২১২ খ্রি: এসময় সমগ্র আর্যাবর্তে ম্লেচ্ছশাসন বর্তমান থাকলে গৌড়বঙ্গ একমাত্র সনাতনী শক্তি হিসেবে ভারতাত্মার বিজয়যাত্রা অক্ষুণ্ণ রেখেছিল ।

🔱 ১২১২ খ্রিস্টাব্দে গৌড়েশ্বর বিশ্বরূপ সেন-এর নেতৃত্বে বিশাল গৌড়ীয় সেনা উত্তর ভারতে অভিযান করে শৈবক্ষেত্র কাশীধাম ম্লেচ্ছ অধিকার থেকে মুক্ত করে । বাঙ্গালার সেনা কর্তৃক সনাতনধর্ম বিজয়ঘোষণায় মহারাজ বিশ্বরূপ সেন কাশীতে ‘বিজয়স্তুপ’ নির্মাণ করেন ও কাশীধাম’কে মহাদেব ‘বিশ্বেশ্বর-শিব’ এর পুণ্যভূমি বলে ঘোষণা করেন ।

✔️(তথ্যসূত্র- ‘1996 Construction and Reconstruction of Sacred Space in Vārāṇasī.’ in: Numen 43 (1996), 37-42
Hans T Bakker)

●⚔️ ১২১৫ খ্রি: এসময় কেশব সেন গৌড়ে এক সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন ।
হরি মিশ্রের কারিকায় লিখিত আছে,

📜”বল্লাল তনয়ো রাজা লক্ষ্মনোভুৎ মহাশয়:
তৎপুত্র কেশবো রাজা গৌড় রাজ্যং বিহায় স:৷”

বিহার ও দেবীকোট থেকে আলী মর্দান এর আক্রমণে ও স্থানীয় কিছু সম্প্রদায়ের বিশ্বাসঘাতকতায় লক্ষ্নৌতি বিজয় হয়।

দানেন কৰ্ণ: শৌর্ষেণ ভীমঃ পরমধাম্মিকঃ ॥
তস্যমাত্যঃ পশুপতিরভূদ্বিশ্বাসঘাতকৃৎ।
যো গৌড়রাজ্যং লোভেন যবনায় সমার্পয়ৎ।।
(জয়সেন বিশ্বাসের কুল চন্দ্রিকা)

যা থেকে বোঝা যায় গৌড় অঞ্চল দখল হয় পশুপতি নামক এক অমাত্যের বিশ্বাসঘাতকতায়।

এসময় রাঢ় অঞ্চল কেশব সেন ও বঙ্গ অঞ্চল বিশ্বরূপ সেন-এর বাহুবলে সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে । মিনহাজ লিখেছেন, যাজনগর বা উৎকলের উত্তরাংশ মহারাজ লক্ষ্মণ সেন এর অধিকারভুক্ত ছিল।কেশব সেন উৎকলের সেই পিতৃ অধিকার বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন ।

তাহার পরিচয়ে আছে – “সমস্ত সুপ্রস্তপেত অশ্বপতি গজপতি নরপতি রাজত্রয়াধিপতি সেনকূলকমল বিকাশভাস্কর সোমবংশ প্রদীপ-প্রতিপন্নদান কর্ণ সত্যব্রত গাঙ্গেয় শরণাগতবজ্রপন্থর পরমেশ্বর পরমভট্টারক পরমসৌর মহারাজাধিরাজারিরাজ ঘাতুকশঙ্কর গৌড়েশ্বর” ।

তিনি লক্ষ্ণৌর বা রাজনগর ও উড়িষ্যা থেকে একাধিকবার লক্ষ্নৌতি পুনরুদ্ধারের সৈন্যসংযোগ করেছিলেন। সম্ভবত ১২২৩ সাল নাগাদ লখনৌর দখল হয়ে যায় কেশবের পুত্র বীর সেনের সময়কালে। লখনুর দখলের পর বীর সেন চন্দ্র পাহাড়ি এলাকায় সরে গিয়ে রাজধানী স্থাপন করেন। কোনরূপ সহায়তা এই সময় পশ্চিম সেন সাম্রাজ্য বিক্রমপুর সেন সাম্রাজ্যের থেকে পায়নি। সেই কারণে নগেন্দ্রনাথ বসুর পারিবারিক গৃহবিবাদ মতকেও অস্বীকার করা যায় না।

রামপালং গতং ভূপং মন্ত্রণায়ানুজেন সঃ।
বিদিত্বা পাণকৃদ্রাত্রৌ দুৰ্গদ্বারমপাবৃণোৎ।
এবঞ্চ দশমে তস্যাভিষেকাদ্বৎসরেহশুভে।
যবনাঙ্কগতং গৌড়রাজ্য শোচ্যাং দশাং গতম ।
বেপক্ষেন্দুচন্দ্রাব্দে খিলজীযবনাদভূৎ।
উৎপীড়িতপ্রজং গৌড়ে দুষ্টং যাবনাশাসনম্ ॥
বিদিত্বা পাপকৃদ্রাত্রৌ দুৰ্গবারমপাবৃণোৎ।
বিশ্বরূপত্ত বঙ্গেযু স্বাধিকারমকুণ্ঠিতম্ ।
রক্ষণ বাহুবলাদ্বীরঃ প্রজাঃ রাজ্যমগীপলৎ । ত্রিচত্বারিংশবর্ষাণি পালয়ন্নখিলাঃ প্রজাঃ। – (কুল চন্দ্রিকা)

এখান থেকে সম্পূর্ণভাবে দেখতে পাওয়া যায় ১২১৫-এ গৌড়ের দুর্গদ্বার ভেতর থেকে খোলা হয়েছিল। একই সঙ্গে পূর্ববঙ্গে বিশ্বরূপ সেনের প্রতিরোধ বিষয়েও জানা যায়।

•১২২৫ নাগাদ তেলিয়াগড়ে দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশ ও গিয়াস-উদ্দিন-ইযুজ খিলজির যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। পূর্ব দিক থেকে বিশ্বরুপসেন ও তার সামন্ত দেব বংশের মিলিত বাহিনী অভিযান চালায়। এবং যবনদের পরাজিত করে গৌড় পুনরুদ্ধার করেন। এবং ‘সগর্গযবণ্বান্বয় প্রলয়কালরুদ্র ‘উপাধি নেন। এই অধিকার দীর্ঘস্থায়ী না হলেও সমকালীন তাম্রশাসনে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশ্বরূপ সেনের ইদিলপুর তাম্রশাসনে ‘সগর্গযবণ্বান্বয় প্রলয়কালরুদ্র’ উপাধি থেকে ও দামোদর দেবের পাকামোড়া তাম্রশাসন থেকে। দামোদর দেবের তাম্রশাসনে গৌড় মহোৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায় যা গৌড় পুনরুদ্ধারকে সূচিত করে। সম্ভবত গৌড় পুনরুদ্ধারের কারণে রাজ্যে গৌড় মহোৎসব পালিত হয়।

●⚔️ বিশ্বরূপ-সাইফুদ্দিন যুদ্ধ (১২৩০-৩৫) : মালিক সাইফুদ্দিন আইবক ছিলেন দিল্লির সুলতান ইলতুতমিস-এর অধীনে লখনৌতির শাসক। তিনি সেন-শাসিত পূর্ববঙ্গে একটি অভিযান সামরিক চালান। তবে তিনি এই অঞ্চলের কোন অংশে অভিযান চালান তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তার অভিযান সফল হয়নি। মহারাজ বিশ্বরূপ সেন-এর বিশাল নৌবাহিনীর আক্রমণে তুর্কি বাহিনী পরাজিত হয়ে পালাতে বাধ্য হয় ।

●⚔️ বিশ্বরূপ – ইউজউদ্দিন যুদ্ধ (১২৩৫-১২৪৪ খ্রি) : ইউজউদ্দিন খিলজির সময় শিখরভূম এর ছাতনা রাজ্যের সামন্ত রাজা উত্তর হামীর রায় রাঢ় অঞ্চলের সমস্ত নৃপতিদের একত্রিভূত করে রাজনগর আক্রমণ করেন। খিলজিদের পরাজিত করে গৌড়ীয়রা লক্ষ্মনুর দুর্গ জয় করে ও রাজনগরে ১৯ বছরের খিলজি শাসনের অবসান হয় । এসময় ইউজউদ্দিন খিলজি বঙ্গ অঞ্চলে আক্রমণ করে । মহারাজ বিশ্বরূপ সেন এর বিশাল কৈবর্ত্য নৌবাহিনী ও তীরন্দাজবাহিনী খিলজিদের ধূলিসাৎ করে দেয় । গৌড়ীয় সেনা ক্রমশ সম্মুখে লখনৌতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে । লক্ষনৌতি রক্ষা করতে ইউজউদ্দিন দিল্লির সুলতানের থেকে সৈন্য সাহায্য কামনা করে।

● তৎপরবর্তীতে নারায়ণ সেন ও সূর্য সেনের বিরুদ্ধে দিল্লি সালতানাতের বাহিনী বহু আক্রমণ পরিচালনা করে ব্যর্থ হয়।

সেন বংশের আরো একবার পুনরুত্থান হয় ১২৭২ সাল নাগাদ। ১২৬৮ নাগাদ পূর্ববঙ্গে একডালা গড় আক্রমণ করে বিহার-লখনৌতির শাসক শের খান। সেই যুদ্ধে আক্রমণ প্রতিরোধ করেন মধু সেন এবং পরবর্তীতে প্রতি আক্রমণ চালিয়ে গৌড় পুনর্দখল দখল করে নেন। যুদ্ধে শের খান নিহত হন। এবং সেখানে শ্রীহট্টের গোবর্ধনকে সামন্ত শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। যে কারণে সেই বংশের শাসক নিজের নামের আগে গৌড় উপাধি ধারণ করতেন।

পরবর্তীতে ১২৭৬-৭৮ নাগাদ অবধ ও বিহারের শাসককে পরাজিত করে মধু সেন নিজের সাম্রাজ্য মগধ অঞ্চল অবধি বিস্তার করেন। মধুসেন সম্ভবত বৌদ্ধ ছিলেন। তাই এই অঞ্চল পুনরুদ্ধার করে নালন্দা বুদ্ধগয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সমকালীন সময়ে প্রাপ্ত বুদ্ধগয়া এলাকার একটি শিলালিপিতে “লক্ষণসেনস্য দেবপাদানামতীতরাজ্যে” শব্দটি পাওয়া যায়।

একই ধরনের শব্দ “শ্রীমল্লক্ষ্মণসেনদেবপাদানুখ্যাত” “শ্রীমল্লক্ষ্মণসেনদেবপাদানুধ্যাত” বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেনের তাম্রশাসনে পাওয়া যায়। তাই অনুমান করা যায়। সেন সম্রাজ্যের একটি পুণঃবিস্তার হয়।
এবং একই সঙ্গে এই সময় কালে গৌড়ে কোন শাসক নিয়োগের তথ্য পাওয়া যায় না। এবং এর স্বপক্ষে আরো একটি সেটি পাওয়া যায় সেটি হল বারাণ্বর পাঁচালীর দুটি পঙতি।

“শ্রীহট্ট নগরে বাস মগধ নৃপতি।
চিরকাল করি তার রাজ্যে বসতি”
গৌড় গোবর্ধন যথার্থই সেনসামন্ত শাসক হিসেবে মগধ শাসন করেছেন একসময় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

মধু সেনের মৃত্যুর পরবর্তী সময়কালে সিংহাসন নিয়ে রাজনীতি বিক্রমপুরে জটিল হয়ে পড়ে। এবং সাভারের ব্রহ্মপুত্র শীতলক্ষ্যা বদ্বীপ অঞ্চলে শাসন করা ভীম সেন বংশীয়রাও এই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ফলত পশ্চিম দিক থেকে যবন সৈন্যবাহিনী একের পর এক অঞ্চল দখল করতে করতে সুবর্ণগ্রামের নিকটবর্তী অঞ্চলে উপস্থিত হয়। ফলত পরিস্থিতি দেখে চট্টগ্রাম অঞ্চলের দেববংশের শাসকদল দনুজ রায় দশরথ দেব বিক্রমপুর অঞ্চল অধিকার করেন। এবং দেববংশের সঙ্গে এই সময়কালে একটি যুদ্ধও হয় মুগিস উদ্দিন তুগ্রিলের। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী সুবর্ণগ্রাম তুগ্রিলের অধিকার ভুক্ত হয়। সাভারের সেন বংশীয় লক্ষণ সেন ( দ্বিতীয়) সামন্ত হিসেবে সোনারগাঁও শাসনের অধিকার পান। পদ্মা নদী দেব রাজ্য ও দিল্লি সালতানাতের সীমানা হয় (সেই সময় পদ্মা নদী ঢাকেশ্বরী খাতে বৈত)।

● পরবর্তীকালে দশরথ দেব অনেকগুলি সমঝোতায় আসেন। কখনো গিয়াসউদ্দিন বলবনের পক্ষ নিয়ে সুবর্ণগ্রামে তুগ্রিলকে পরাজিত করেন।কখনো বা আরাকানের শাসক মিং হেট্টের সাথে জোট করে নিয়ে সুবর্ণগ্রাম পুনরুদ্ধার করেন।

দেব সাম্রাজ্যের বিস্তার কোন সময় কি রকম হয়েছিল সেটা আমার সুহৃদ স্নেহাংশু এই বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করেছে। আমার লেখার বিচার্য বিষয় হলো পরবর্তীকালে সেন বংশের একটি পুনরুত্থান হয়েছিল সেই বিষয়ে আলোকপাত করা।

১৩৭৫ খ্রি বা ১২৯৭ শকাব্দে সাভারে একটি শৈব মঠকে জমি দান করা হয়। এটি মহেন্দ্র সেনের শাসনামলে প্রদত্ত বলা হয় এবার মহেন্দ্র সেনের পরিচয় কি?
উনি কি স্বাধীন রাজা ছিলেন?
সেন বংশের সঙ্গে উনার কি কোন যোগ ছিল?
শিলালিপিটা এরকম:

শিলালিপিতে পাঁচজন রাজার উল্লেখ রয়েছে ভীম সেন, ধীমন্ত সেন, রনধীর সেন, হরিশচন্দ্র, মহিন্দ্র।

● ভীম সেন:

নম সুগতায়

যে জাতো বীরবর মহিতাদিন্দু বংশৌর্যধেশাৎ
ধীমস্তো ধীরবরঃমুকুটাৎ ভীমসেনান্নৃ পেন্দ্রাৎ।
সোদৰ্যে বৈর্দশবল গেতত্বাদ্বিরাদ্ধঃ সগেহাৎ আরাতিস্মাদ্রিবন নশিতে ভাবলীনে প্রদেশে।
(১)।

বল্লাল চরিত অনুসারে বল্লাল সেনের মৃত্যুর পর পিন্ডদান করেন দুজন ১) লক্ষণ সেন,২) ভীম সেন।
সেখানে ভীমসেনকে রাজবল্লভ বলে উল্লেখ করা হয়।

ভীম সেন যে সেন বংশেরই ছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। শ্রী দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’, শ্রী জয়সেন বিশ্বাসের ‘প্রাচীন কুল চন্দ্রিকা’, শ্রী মৃত্যুঞ্জয় শর্মার ‘রাজাবলী’-তেও তার পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়।

● ধীমন্ত সেন:

বংশাবতী ব্রহ্মাবুত প্রবিষ্টং
দক্ষেণ গাজং স চ ভাবলীনং ।
ধীমন্তসেন: সহসৈন্যযোধৈ
রাক্রামতি স্মা প্রবলাৎ কিরাতাৎ॥ (২)।

শিলালিপি থেকে ভীম সেনের পুত্র ধীমন্ত সেনের বিষয়ে জানা যায় যে তিনি বৌদ্ধ ছিলেন এবং নিজের যোদ্ধা ও সেনাপতিদের সহায়তায় ব্রহ্মপুত্র ও বংশাই ও গঙ্গা মধ্যবর্তী এলাকার কিরাতদের পরাজিত করেন। ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ এলাকা অধিকারভুক্ত করে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

● রণধীর সেন কার্তিকেয় :

ধীমন্তপুত্রো রণধীরসেনঃ
সংগ্রামজেতা ইব কার্ত্তিকেয়ঃ ।
হিমালরব্যাপ্ত দেশান্বিজিত্য
সারপুৰ্য্যামবসৎ প্রবীরঃ ॥ (৩)।

তাঁর পুত্র রনধীর সেনের বিষয়ে বলা হয়েছে তিনি মহাবীর ছিলেন দেবসেনাপতি কার্তিকের ন্যায় এবং হিমালয় পর্যন্ত ভূভাগ জয় করেন ও সম্বার নামক স্থানে নিজের রাজধানী স্থাপন করেন। এখানে হিমালয় বিজয় বলতে খুব সম্ভবত গারো খাসি পাহাড়ের কথা বলা হয়েছে। এই পর্যন্ত সময়কালকে ধরতে হবে। শ্রী জয়সেন বিশ্বাসের ‘কুল চন্দ্রিকা’-তেও কার্তিক সেন নামে এক নৃপতির উল্লেখ পাওয়া যায়। এবং তাঁর রাজ্ঞীর নাম কমলা ছিল। খুব সম্ভবত কার্তিক সেন ও সাভারের শিলালিপিতে উল্লেখিত রণধীর সেন এক লোক । কারণ ওখানে বিশেষণ হিসেবে দেবসেনাপতি কার্তিক-এর ন্যায় বলে তুলনা করা হয়েছে।

খুব সম্ভবত এই সেন বংশের রণধীর সেন ছিলেন বিক্রমপুর সেন বংশের সেনাপতি, ১২৮৩ পূর্ববর্তী। ১২৮৩ তে তুগ্রিলের আক্রমণ হয়। সম্ভবত সেই আক্রমণেই রনধীর মারা যান।

•হরিশচন্দ্র লক্ষণ সেন(দ্বিতীয়): (১২৮৩-১২৫৫)•

হরিশ্চন্দ্রো মহারাজ: রণধীরস্য পুত্রক:
ধৰ্ম্মেশ ইব ধৰ্ম্মাত্মা ধনাঢ্যঃ কুবেরাধিকঃ। (৪)।

নৃপেন্দ্রবংশমার্ত্তন্ড হরিশ্চন্দ্র ইবাভবৎ।
প্রশস্তিলোকান সৰ্ব্বান্ সঃ অথবা ইব রাঘবঃ। (e)

যমলাত্রাসিনী তীরে বৌদ্ধাঙ্কমঠমন্দিরে
বিজনে চ স রাজর্ষি ধর্ম্মার্থং স্মারতিষ্ঠতে। (৬)

ভিষককূলে চেন্মলিন: শশাঙ্ক:
সমুজ্জ্বলঃ কিস্ত্বিব পূর্ণচন্দ্ৰঃ।
রাজষিণা কণ্টক-শাখিশৈলা
সুবাসিতা বৈ মলয়াদ্রি জেন (৭)।

শিলালিপি থেকে জানা যায় হরিশচন্দ্র বৌদ্ধ ছিলেন ও বহুমূত্র মঠ-মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রখ্যাত অধ্যাপক শ্রী মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘রাজাবলী’ গ্রন্থে এক দ্বিতীয় লক্ষণ সেনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে উল্লেখিত হরিশচন্দ্র সেনকে দ্বিতীয় লক্ষণ সেন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

‘শেখ শুভোদয়া’ নামক পুঁথিতে লক্ষণ সেনের এক উল্লেখ পাওয়া যায়। অধিকাংশ ঐতিহাসিকরা এই পুঁথিটিকে তার ব্যবহৃত ভাষা দেখে সেই সময়কার লেখা নয় বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেখানে বল্লভা নামক এক একজনকে লক্ষণ সেনের পত্নী বলা হয়েছে। যেখানে লক্ষণ সেনের বল্লভা নামে কোন পত্নী ছিল না। বরং উনার পত্নীর নাম ছিল তন্দ্রা।

অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই পুঁথিটিকে জাল বলেছেন কারণ পুথির সংস্কৃত অশুদ্ধ ছিল।

তবে আমরা যদি সময়কাল দেখে মেলাই তবে একজন দ্বিতীয় লক্ষণ সেনের অস্তিত্ব অস্বীকার করার জায়গা থাকে না।

১২৮৪-৮৫ নাগাদ বিক্রমপুরের সেন শাসনের অস্তিত্ব আর ছিলনা।কিন্তু সুবর্ণগ্রাম অঞ্চলে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল । তাই রাজকার্যে শেখ জালালউদ্দিন নামক এক গাজীর প্রভাব আমরা দেখতে পাই। সে ক্ষেত্রে খুব সম্ভবত এটি দ্বিতীয় লক্ষণ সেন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। খুব সম্ভবত তিনি সুলতানের অধীনস্থ সামন্ত ছিলেন।

হট্টনাথের পাঁচালী ও শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তেও আমরা দেখেছি প্রায় ১৫ বছর ধরে শ্রীহট্ট অধিকারের জন্য সুলতানের বাহিনী অভিযান চালায়। খুব সম্ভবত এই অঞ্চলের অন্যান্য হিন্দুর সামন্তরা যাতে বিদ্রোহ না করে সেই উদ্দেশ্যেই গাজীদের নিয়োগ করা হতো। এবং দ্বিতীয় লক্ষণ সেনের রাজসভায় সম্ভবত শেখ জালালউদ্দিন প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থাকতো। সম্ভবত এটা দেশীয় রাজসভায় ইংরেজ রেসিডেন্ট থাকার মতো ব্যবস্থা ছিল। সাভারের শিলালিপিতে সেই সময়কার শাসকের নাম হরিশচন্দ্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘হরিশচন্দ্র’ একটি উপাধি কোন নাম নয় একথা শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেনও উল্লেখ করেছেন। একই সাথে শিলালিপিতে উল্লেখিত হরিশচন্দ্রের কোন বীরত্বের কথা সেভাবে দেখা যায় না। খুব সম্ভবত পরবর্তী শাসক তার প্রতি তীব্র ক্ষোভ ও শ্লেষ বশতঃ ‘হরিশচন্দ্র’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন তার রাজ্যশাসনে অক্ষমতা বোঝাতে। সেই ক্ষেত্রে ওনার পুরো নাম হবে হরিশচন্দ্র লক্ষণ সেন।

খুব সম্ভবত সুলতানের অধীনতা স্বীকার করে নিয়ে আয় পূর্ববর্তী সেনরাজগণের মত সামরিক খাতে ব্যায় থাকে না ফলতঃ বেশ ধনাঢ্য এক রাজা হিসেবে বলা হয়েছে। সম্ভবত তাঁর পুত্র তাঁর প্রতি শ্লেষ বশতঃ এই কথাগুলি লিখেছিলেন। রাজকার্যে গাজীদের হস্তক্ষেপ সুলতানের অধীনতা স্বীকার ইত্যাদি বিষয়ের জন্য তাঁর ওপর তাঁর পুত্র ক্ষিপ্ত ছিলেন। রাজনৈতিক বিষয়ে সম্ভবত তিনি নিস্পৃহ থাকতেন। ১২৯৪-১৩১৭ পর্যন্ত সুবর্ণগ্রামে দশরথ দেবের শাসন থাকে। সেই সময় কালেও এনার বিশেষ কোনো বিরোধিতা করেছিলেন বলেও উল্লেখ পাওয়া যায় না।

● মহেন্দ্র বল্লাল সেন(দ্বিতীয়): (১২৫৫-

হরিশ্চন্দ্র পুত্রেণ মহেন্দ্রণ মীনাঙ্কাদ্রিস্থিতো দত্তঃ
ক্ষপর্ণং বৈ মহেশ্বরং
প্রণম্য সুগতং দেব রচিতা শাসলী
ময়া কবীন্দ্র শিবদেবেন ভিষগমাধবসুসুনা।

(শকাব্দাঃ– অস্পষ্ট)

নিঃসন্দেহে উনি স্বাধীন নৃপতি ছিলেন। কারণ ভূমি দান ও শিলালিপি জারি করার অধিকারী স্বাধীন নৃপতিরাই হন। শিলালিপি অনুসারে ইনি শৈব ছিলেন।

হরিশচন্দ্রের পুত্র রাজর্ষি মহেন্দ্রর বিষয়ে বলা হয় কন্টকাণ্বিত পার্বত্য জঙ্গলে চন্দন তরু নিঃশেষ করেছিলেন। ১২৯৭ শকাব্দতে সেই শৈব মঠ তাঁর তত্ত্বাবধানেই নির্মান করা। এটা থেকে বোঝা যায় তিনি এক অত্যন্ত স্বাধীন নৃপতি ছিলেন এবং সেই জন্যেই সম্ভবত তাঁর নিজের শিলালিপি ছিল এবং তিনি ভূমি দানের অধিকারী ছিলেন। এইবার পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন এই সময়কালে কোন সফল বিদ্রোহ ওই অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল কিনা।

● খুব সম্ভবত মহেন্দ্রও একটি উপাধি বিক্রমপুর এলাকায় যা বাবা আদম ও বল্লাল সেনের যুদ্ধের একটি তথ্যে পাওয়া যায়। শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর সুবিখ্যাত ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে এই বল্লাল সেনকে অপর বল্লাল সেনের সঙ্গে এক বলেননি। তিনি এই ব্যক্তিকে দ্বিতীয় বল্লাল সেন বলেছেন ।  শ্রী নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘অঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ অনুযায়ী দ্বিতীয় বল্লাল সেনের সময় কাল ১৩৩৫। এই সময় কালে না হলেও ১৩৫৫ নাগাদ দিল্লি এবং লখ্নৌতীর মধ্যে একটি সংঘর্ষ উপস্থিত হয়, সম্ভবত সেই সময়কালেই এই সময় চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগের সারা বঙ্গব্যাপী রাষ্ট্রবিপ্লব হয়েছিল, এর উল্লেখ আমরা শ্রী গৌরীহর মিত্রের ‘বীরভূমের ইতিহাস’ গ্রন্থে পাওয়া যায়।

সেই সময় কালে বহু নৃপতি স্বাধীনতা অবলম্বন করেন এবং তাঁদেরকে দমন করতে বহু আউলিয়া গাজী প্রেরিত হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম হল বাবা আদম। সাভারের শিলালিপিতে এই আউলিয়া সমস্যাকেই ‘কন্টক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং এখান থেকে অবশ্যই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় সাভারের শিলালিপিতে উৎকীর্ণ মহিন্দ্র ও দ্বিতীয় বল্লাল সেন অভিন্ন এবং সম্ভবত দ্বিতীয় বল্লাল সেন ও মহেন্দ্রের সময়কাল মিলিয়ে ধারণা করা যায় মহিন্দ্র দ্বিতীয় বল্লাল সেনের উপাধি। এবং সেটা ধরলে (১৩৫৫- ১৩৭৫ ) পর্যন্ত দ্বিতীয় বল্লাল সেন স্বাধীন নৃপতি ছিলেন।

বাবা আদম ও বল্লাল সেনের যুদ্ধ:

বল্লাল সেনের সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনীটি এই প্রকার – 

রাজ্যের মধ্যে এক গাজি (সম্ভবত জালালুদ্দিনের কোন উত্তরসূরী) গো হত্যা করে রাজপ্রাসাদের সন্নিকটে। বল্লাল সেন ক্রুদ্ধ হয়ে সমগ্র বাহিনী নিয়ে সেই গাজিকে আক্রমণ করে। গাজী পলায়ন করে লক্ষণৌতীতে আশ্রয় নেয়। লখনৌতি থেকে ইলিয়াস শাহ বল্লালের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ হয় ও তার নেতৃত্বে ছিলেন বাবা বায়াদুম্ন বা বাবা আদম। বাবা আদম বিক্রমপুরের সন্নিকটে এসে শিবির ফেলেন।

মুসলমানদিগের সহিত যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে রাজা অন্তঃপুরে প্রবেশ করেন, তখন রাজ-সিমন্তিনীগণ তাঁহাকে সাশ্রুনেত্রে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ ! রাজ্যে মহাশত্রু উপস্থিত, এবং চণ্ডেলী দৈবাৎ যদি পরাজয় ঘটে তবে আমরা কি করিব, তৎসম্বন্ধে আমাদিগকে উপদেশ দিন। ” রাজা প্রতি মহিষীকে বলিলেন, “অন্তঃপুরে আগুন জালিয়া রাখ ; আমি যদি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাই, তবে তোমরা তোমাদের রাজ ধর্ম পালন কোরো।”

কঠোর যুদ্ধে বায়াদুম্ন বল্লালের হস্তে পরাজিত ও মৃত্যুমুখে পতিত হয়। যদিও কোন এক বিশ্বাসঘাতক কর্তৃক ভুল সংবাদ পৌঁছেনোয় রাজ্ঞীরা রাজ মৃত্যু নিশ্চিত জেনে অগ্নিকুন্ডে প্রাণ বিসর্জন করেন।

বিক্রমপুর অঞ্চলে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এই অঞ্চলটিকে ‘পোড়া রাজার বাড়ি’ বলা হতো। এছাড়াও পরবর্তী সেনরাজাদের বংশাবলি সম্পর্কে একটি ছড়া প্রচলিত আছে। শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন সেখানে ‘সোণার গাঁয়ের ইতিহাস’ গ্রন্থটির সূত্র প্রদান করেছিলেন। বইটি বর্তমানে আমার কাছে না থাকায় সেটির উল্লেখ দিতে পারলাম না। সাভারের সেন বংশের পরবর্তী সময়কালের উল্লেখ সেভাবে পাওয়া যায় না।

এই সময়কালে সেন বংশের পুনরুত্থান একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। নিঃসন্দেহে দেব সাম্রাজ্যের উত্থান ও তার সমান্তরালে সেন বংশের পুনরুত্থান ইলিয়াস শাহী মিথকে ভুল প্রমাণ করে।

তথ্যসূত্র:
•বাঙালির ইতিহাস- নিহার রঞ্জন রায় ৪১০ পৃষ্ঠা
•গৌড়ের ইতিহাস রজনীকান্ত চক্রবর্তী- ১৯৩,১৬৫-১৮৯ পৃষ্ঠা
বৃহৎ বঙ্গ দীনেশ সেন ২৭৭,২৭৮,৫৪৮ ১১৪১ পৃষ্ঠা (ভূমিকার পরিশিষ্ট)
•Construction and Reconstruction of Sacred Space in Vārāṇasī. in: Numen 43 (1996), 37-42
Hans T Bakker
•বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ রাজন্য কান্ড- নগেন্দ্র নাথ বসু ১৫৬-৫৭,
•বংশপরিচয় জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার, তৃতীয় খন্ড ৪৬৮ পৃষ্ঠা
• বীরভূমের ইতিহাস গৌরীহর মিত্র
পৃষ্ঠা ৩৬-৪১
•শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত – পূর্বাংশ অচ্যুত চৌধুরী তত্ত্বনিধি ১৭৫ পৃ
•ঢাকার ইতিহাস-যতীন্দ্রমোহন রায় দ্বিতীয় খন্ড ৩৭৭

(লেখক – শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার: B. Tech., Ceramic Technology, তৃতীয় বর্ষ)

Comment here