সংস্কৃতিসাদাকালো রঙমাখা

ওস্তাদ আমির খানের প্রতি – কুসুমাঞ্জলি

-শ্রী শুভদীপ দে

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উৎপত্তি কোথা হতে? যা সমগ্র পৃথিবী তথা মানব জাতিকে সুরের মূর্ছনায় প্লাবিত করে তার সূত্রপাত সামবেদ হতে। মূলত, যজ্ঞানুষ্ঠানে সামগান বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পরিবেশন করা হতো; প্রণম্য ঋষিরা সুরসহযোগে মন্ত্র উচ্চারণ করতেন যা অপূর্ব্ব ধ্বনির মাধ্যমে শ্রোতার চিত্তশুদ্ধিতে এক অনির্বচনীয় ভূমিকা অর্জন করতো। ক্লেশ, পক্ষপাত ছিলোনা তাতে; ছিলোনা রাজন্যবর্গ ও প্রজাবর্গের মধ্যে পার্থ্যক্য প্রতিষ্ঠার কোন হীন প্রবৃত্তি। জননী, জন্মভূমি ও বিশ্বপ্রকৃতির ও মানবতার অগ্রগতি ও বিস্তৃতিই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। অন্তরের এই নিষ্কলঙ্ক প্রকাশ আকৃষ্ট করে সাধক ও শ্রোতাদের যুগে যুগে; ধর্ম, সংস্কারের বিভাজনকে অগ্রাহ্য করে – শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সমাহিত সাধক কালক্রমে হয়ে ওঠেন ঋষিতুল্য।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাযুজ্য ও ওস্তাদ আমীর খান সমার্থক। সম্ভবতঃ এ জগতে এমন কোন শিল্পী বা শ্রোতা নেই যিনি এই নামটির সাথে পরিচিত নন।

ওস্তাদ আমীর খান, এক কথায়, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। সঙ্গীতের নিষ্ঠাবান শিক্ষার্থী ও শ্রোতাকুলে এমন মানুষ নেই বললেই চলে, যিনি কখনও না কখনও ওনার সুরের ঝংকারে হারিয়ে যান নি। তাঁর দীর্ঘদিনের সাধনায় খণ্ডমেরু বা মীরখণ্ড যে পর্যায়ে তিনি আয়ত্ত করেছিলেন, এবং পরিবেশনে তা অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন, সেই কুহকের মায়াজালে প্রত্যেক নিবিষ্ট শ্রোতাই মগ্ন হয়েছে যুগে যুগে।

তিনি যখন প্রথম দিকে পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন, ভারতীয় সুরের আকাশে তখন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের চোখধাঁধানো আলোকচ্ছটা। তাঁর মাখনের মতো মিষ্টি গলা, সাথে অভাবনীয় সব মুড়কি মেশানো ঠুমরীর নেশায় শ্রোতারা মগ্ন। তাই দেখে আমীর খান শুধু খেয়াল ও তারানা গায়নে মনোনিবেশ করেন। এবং এমনই মহিমা, তাতেই দর্শক-হৃদয় জয় করে নেন। সবাই যেখানে বিলম্বিত একতাল ছাড়া গাইতেন না, সেখানে আমীর খাঁ একমাত্র বিলম্বিত ঝুমড়াতে বন্দিশ, তার বঢ়হৎ গাইতে লাগলেন। পণ্ডিত গোবিন্দ বসু একবার বলেছিলেন, ১৯৬৬ সাল, নিখিল বঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলন, মহাজাতি সদনে আমীর খানের অনুষ্ঠান ছিল, তবলায় গোবিন্দ বসু। তার ঠিক আগেই পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি সেতারে ঝড় তুলে দিয়েছেন, সাথে তবলায় বেনারসের শামতা প্রসাদের না ধিন ধিন না… সে এক স্বর্গীয় যাদু, ‘৬৬ নিখিল ব্যানার্জি, শান্তা প্রসাদের বাজনা যারা শুনেছে, তারাই জানে সে কেমন অভিজ্ঞতা। ওরকম উন্মাদনার শেষে মঞ্চে ওঠার পর গোবিন্দ বসু প্রচণ্ড ঘাবড়ে ছিলেন, যে সেতারে এমন ঝালার পরে আমীর খানের খেয়াল কতোটা আসর জমাতে পারবে। তিনি বলেন, ‘খাঁ সাহেব সেই গম্ভীর ধ্যানমগ্ন গলায় সেই যে আলাপ ধরলেন, তারপর… ঠিক ১০ মিনিট… পুরো প্রেক্ষাগৃহ মন্ত্রমুগ্ধের মত শান্ত।’ উনি সেই রাতে চারটে প্রভাতকালীন রাগ গেয়েছিলেন, গোটা Hall প্রস্তরবৎ হয়ে শুনেছিল। এমনই ছিল ওনার মহিমা। গাইতে বসে তিনি কোনোদিনও মাথা হাত পা নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে নজর কাড়তে চাননি, ধ্যানমগ্ন ঋষির মত চোখ বুজে সমকায়শিরোগ্রীব হয়ে বসতেন, অন্তর থেকে যেন মহাজগতের মন্দ্রধ্বনি ভেসে আসতো।

পণ্ডিত রবিশঙ্করের কথায়, “… সেই ছোটখাট কন আর হরকৎ লাগিয়ে প্রত্যেকটা সুরে যেন আরো বেশী প্রেম আনলেন। লোকের মনে সেঁদিয়ে যেত, প্রাণ কেঁদে উঠত। আর কি জান, কোনো গাইয়ের এইরকম একটা বসা আর মুদ্রা দেখা যায়নি। গান গাইতে বসে লোকটার কোনো লম্ফঝম্প নেই, হাত-নাড়া মুখ-ভেঙচানো নেই, শ্রোতার সঙ্গে চোখ মিলিয়ে তারিফ নেবার চেষ্টা নেই। চোখ বন্ধ করে যেন পুজো করছেন, এইরকম একটা ধ্যানগম্ভীর ভাব।…”

বিশিষ্ট সেতারী, আমার সবচেয়ে প্রিয়, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে খণ্ডমেরুর যে রেওয়াজ, তা আমাদের মধ্যে আমীর খানের থেকে ভালো কেউই করেননি।’ উল্লেখ্য, নিখিল ব্যানার্জিও খণ্ডমেরুতে প্রভূত পারদর্শী ছিলেন। খাঁ সাহেব এই খণ্ডমেরুর বহু সরগম পণ্ডিত গোবিন্দ বসুকে দিয়ে গেছেন, যিনি তাঁর সাথে ১৯৬৬ থেকে প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে তবলা সঙ্গত করেছিলেন।

আমীর খান কোলকাতা এলেই ল্যান্সডাউন রোড (বর্তমান শরৎ বোস রোড) এর আমন্ত্রণ বিয়েবাড়িতে উঠতেন। ১৯৭৪ সালের ১৭ জানুয়ারি, ঐ দিন তাঁর এই আমন্ত্রণ Hall এই তাঁর খেয়ালের অনুষ্ঠান ছিল। অসাধারণ অনুষ্ঠান শেষে সকলে ফিরে গেছেন। পরের দিন বেলায় গোবিন্দ বসু খাঁ সাহেবের সাথে যখন দেখা করতে যান, তিনি দেখেন খাঁ সাহেব কেমন যেন মনমরা। জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বললেন, “গোবিন্দ্, আজ সুবহ্ জব রিয়াজ় কর রহা থা, তব গলেসে ইহ্ গান্ধার ইতনা অনোখা নিকলা… হম সবলোক হয়রান রহ গয়ে। ইয়ে গান্ধার জিসকো লগ্ জাতা হৈ, বহ্ জ়্যাদা দিন টিকতে নহী”। 

শ্রী কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর বহুপঠিত ও সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘কুদরত রঙ্গীবিরঙ্গী’ তেও এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন।

এরপর ঠিক এক মাসেরও কম সময়ে, আজকের দিনেই, রাত ১২ টার দিকে এক দুর্ঘটনায় তিনি অকালে প্রয়াত হন, তামাম ভারতবাসীকে শোকস্তব্ধ করে।

১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ এর সেই অভিশপ্ত রাতে ১১ টার সময় নিউ আলিপুরের এক পরিচিতের বাড়ি থেকে নৈশভোজ সেরে ফিরছিলেন, সাথে গাড়িতে শিষ্যা পূরবী মুখোপাধ্যায় ও লেখক-সাংবাদিক শম্স্-উ-জ়মা। সাদার্ন অ্যাভিনিউ এর ল্যান্সডাউন ক্রসিং-এ হঠাৎ একটি গাড়ি মুখোমুখি ধাক্কা মারে। এতই প্রচণ্ড সে ধাক্কা যে দু’টি গাড়িই পুরো ঘুরে গিয়ে আবার মুখোমুখি হয়ে আবারও ধাক্কা খায়। খাঁ সাহেব পিছনের সিটে যে দিকে বসেছিলেন, তার দরজা আপনাআপনি খুলে গিয়ে তিনি বাইরে বিদ্যুৎ সরবরাহের জাংশান বক্সের সামনে ছিটকে পড়েন, তাঁর মাথা জাংশান বক্সে সজোরে দু’বার ঠুকে যায়, তিনি চার ফুট দূরে ছিটকে পড়েন। তৎক্ষণাৎ তাঁকে রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হলেও, এক ঘন্টার মধ্যে সব শেষ।

শ্ৰীমতী পূরবী মুখোপাধ্যায় বহুদিন পরেও কেঁদে বলতেন, খাঁ সাহেবের জায়গায় বিধাতা কেন আমার মৃত্যু দিলেন না!
মার্চ মাসের শেষেই তাঁর পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি ও গোবিন্দ বসুর সাথে আমেরিকা যাবার কথা ছিল, সান ফ্রান্সিসকোতে, Visiting Professor হিসাবে।

শোকস্তব্ধ ওস্তাদ বিলায়েত খান লিখলেন, ‘আমীর খাঁর মৃত্যুর সাথে দেশের কন্ঠসঙ্গীতও শেষ হয়ে গেল, তিনি চলে গেলেন, খেয়াল শোনার আনন্দও চলে গেল।

পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাঁর ‘রাগ-অনুরাগ’ গ্রন্থে লিখছেন, “… আহা, আমার আইডিয়াল ছিলেন মানুষটি— as an artist! কেন, কেন অহেতুক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন মানুষটি? কেন এই অন্যায় বিচার ভগবানের?… ওঁর অভাব সংগীতজগতেই তো শুধু নয়, আমার মনেও। I miss you very much, ভাই আমীর খাঁ; যেখানেই থেকো না কেন, জেনো এ কথা!”

আজকেই সেই রাত, যেদিন আধুনিক যুগের তানসেন মর্ত্যলোক থেকে চিরবিদায় নিয়েছিলেন। গোবরা সমাধিক্ষেত্রে তাঁর পার্থিব দেহ আজ কবরে শায়িত।

সূত্র: সংগীতসূর্য উস্তাদ আমীর খাঁ, তেজপাল সিং ও প্রেরণা অরোরা। বঙ্গানুবাদ মীনা বন্দ্যোপাধ্যায়
এছাড়াও, পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জির সাক্ষাৎকার, গোবিন্দ বসুর মৌখিক স্মৃতিচারণ এবং অন্যান্য।

(লেখক পরিচিতি: শ্রী শুভদীপ দে-মহাশয়ের নিবাস: শ্যামনগর, জেলা: উত্তর ২৪ পরগনা। বর্তমানে স্থানীয় উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতারত। ভারতীয় সনাতন ধর্ম-সংস্কৃতি ও সঙ্গীতে একান্ত অনুরাগী)

Comment here