বিজ্ঞান

বিজ্ঞানশিক্ষা –

– শ্রী সম্বুদ্ধ সেনগুপ্ত

 

কোনো একটি কলেজের এক অন্ধকার কোণে প্রথম সেমেস্টারের প্রথম ক্লাস শুরু হয়েছে। শিক্ষক মহাশয় ক্লাসে এসেছেন। এসেই সিলেবাস নামের একটা বস্তু সবার সামনে তুলে ধরলেন। ক্লাস শুরু হলো। শিক্ষক মহাশয় ক্লাসে যা পড়ালেন সিলেবাস অনুযায়ী সেই অনুযায়ী প্রশ্ন আসবে। নোট্স নেয়া শুরু হল। সবার হাতে একটি করে জেরক্স গেল। পরীক্ষা এল। নোট্স অনুযায়ী প্রশ্ন এলো। সবাই পাশ করল। সেই পাশের কি ধুম !!! কেউ নব্বই শতাংশ তো কেউ নিরানব্বই শতাংশ। তিন অথবা চার বছর পর সবাই চাকরি পেয়ে গেল। প্রচারমাধ্যমে জারি হলো সেই কথা।

এবার আমার প্রশ্ন হল যে মানবতার প্রতি অপরাধ কি আর কিছু আছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার গণহত্যাগুলোকে যদি মানবতার প্রতি অপরাধ বলে ধরা হয় তবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার নামে যা হয় তাকেও মানবতার প্রতি অপরাধ বলে ধরা উচিত। প্রধানমন্ত্রী আজ আত্মনির্ভর ভারতের কথা বলছেন কিন্তু এর থেকে বড় পরনির্ভর হওয়ার ফর্মুলা আর কি আছে। আমার বক্তব্য হলো এই যে শুধু কিছু নোট্স আর কিছু লেকচারের জন্য যদি ছাত্রদেরকে প্রতিদিন ক্লাসে আসতে হয় তাহলে প্রতিদিন কষ্ট করে ক্লাস করানোর দরকার কি ? একদিন ডেকে ডেকে শুধু নোট্স দিয়ে দিলেই তো হয় !!

কিছু বিজ্ঞ আবার বলা শুরু করেছেন যে বিভিন্নরকমের এনিমেশনের সাহায্য নিয়ে ক্লাস করানো উচিত। এনাদের ভারত মহাসাগরে ডুবে মরা উচিত। কারণ এনারা যা বলছেন তা আরো ভয়ঙ্কর। কারণ এতে রোগের উপশম তো হবেই না বরঞ্চ রোগটাকে আরো ভালোভাবে ঢাকা যাবে। এনাদের মুখে ছাই।

এবার বলে রাখা ভালো যে এইসব যদি শিক্ষার নমুনা হয় তাহলে আমাদের দেশ তো আত্মনির্ভর হবেই না বরঞ্চ দাস হবার জন্য উপযুক্ত হবে। কারণ দাসকেই নির্দেশ দেওয়া হয় কিভাবে মালিকের কথা শুনতে হবে, মালিককে খুশি রাখতে হবে। উল্টোটা কখনোই হয় না। মালিকের নির্দেশ অনুযায়ী না চললে চাকরের মাইনে কাটা যায়। ঠিক তেমনি নোট্স না পড়লে নম্বর কাটা যায়।

এর সমাধান আমরা কিভাবে বার করব ? কিভাবে আমরা দাস হওয়া থেকে নিজেদেরকে বাঁচাব। কিভাবে আমরা আবার মালিক হবো। যে জিনিসটা কারুর মাথায় আসছে না সেটা হল মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখানো, ভাবতে শেখানো। যেটা আমাদের দেশে কোথাও করা হয় না।

সেই সভ্যতার ঊষাকাল থেকে মানুষ শুধুই প্রশ্ন করে এসেছে প্রকৃতির জটিল রহস্যগুলোর পেছনের কারণ জানতে গিয়ে। আজকের আধুনিক বিলাসবহুল সভ্যতা সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজারই চেষ্টার ফসল। নিউটন আপেল কেন মাটিতে পড়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অতবড় তত্ত্বের গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়ে ফেললেন। প্রত্যেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেছনে আছে এরকম একেকটা প্রশ্ন। আর আছে তার উত্তর খোঁজার জন্য পৃথিবী তোলপাড় করে দেওয়া। আমাদের পাঠ্যক্রমে যা আছে তা হল কিছু উপাদান মাত্র। ওগুলোকেই বড় করে দেখানো হয়। কিন্তু সেগুলো কেন করব তার কোনো উত্তর নেই।

একটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে বহু লোক মারা যাচ্ছে। সেই রোগ সম্বন্ধে জানতে বা সেই রোগের ওষুধ তৈরী করতে যে মহাপ্রাণ আগ্রহী হবেন তিনি আপনা আপনিই ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী হবেন। তাকে আলাদা করে আর সেগুলো মুখস্থ করতে প্রত্যেকদিন রাতে বসতে হবে না। এটি তখন তার জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে।

মানুষের মস্তিস্ক কত উন্নত একবার পাঠকরা ভেবে দেখবেন। এক বাচ্চা ছেলের দিকে একটি বল ছুড়ে দেওয়া হল। বালক যেখানে দাঁড়িয়ে আছে বল তার থেকে অনেক দূরে এসে পড়বে। বালক অবলীলাক্রমে দৌড়ে গিয়ে বলতে ধরে আনল। অর্থাৎ যেই projectile motion এর অংকগুলো করতে গিয়ে এগারো ক্লাসের ছাত্ররা হিমশিম খায় তা মানুষের মস্তিস্ক অনায়াসে ব্যবহারিক জীবনে করে দেখাতে সম্ভব। \

তাহলে শিক্ষকের কাজ কি ? মানুষ মাত্রই একটি বীজের মতো। তার মধ্যে এক বিরাট বটগাছ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। শিক্ষকের কাজ হল সেই বীজকে জল ও আলোর বন্দোবস্ত করে দেওয়া। বাকি বীজ নিজের জোরেই বড় হয়ে উঠে মহীরুহে পরিণত হবে। অর্থাৎ শিক্ষকের কাজ হল তার ছাত্রদের মধ্যে যে চিন্তাগুলো অব্যক্ত ভাবে আছে সেগুলোকে ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগানোর জন্য তাদের সাহায্য করা। ঘোড়া বা গাধা পিটিয়ে তাতে বসার জন্য যেন ছাত্রদের জীবনটা ব্যবহার করা না হয়।

আরেকটি কথা। তথাকথিত স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও একটি বিদেশী ভাষার ওপর আমাদের এত নির্ভর করতে হবে কেন ? বিজ্ঞান শিখতে যা সময় যায় সেই একই সময় যদি একটা ভাষা শিখতে চলে যায় তো তার নিটফল শূন্য। অন্য ভাষা নিয়ে একেবারেই চিন্তিত নই কিন্তু অবিলম্বে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা আরম্ভ করতে হবে। যে ভাষায় লোকে কথা বলছে, চিন্তা করছে সেই ভাষাতেই যদি সে গবেষণাপত্র না লেখে তাহলে সেই গবেষণার মান আর সেই উৎকর্ষের পর্যায় থাকে না।

তাই এরপর চতুর্দিকে উৎকর্ষের আরাধনা আরম্ভ হোক এই কাম্য। আমরা নাহয় একপ্রকার দাস হয়ে জন্মেছি কিন্তু আমাদের সন্তানসন্ততিরা যেন মালিক হতে পারে সেই আশায় রাখি।