বিজ্ঞান

হিন্দুধর্ম ও ডারউইন

– শ্রী সম্বুদ্ধ সেনগুপ্ত 

 

প্রথমেই ডারউইনের কথায় আসা যাক। ১৮৩১ সালে H.M.S BEAGLE নামধারী একটি জাহাজে চেপে ডারউইন পাড়ি দেন প্রশান্ত মহাসাগরে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর এই জাহাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত tiera del fuego এবং পাটাগোনিয়ার hydrological survey করা। আশ্চর্যের বিষয় এই যে ডারউইন প্রকৃতিবিদ হিসেবে যে পদে এই জাহাজে অবস্থান করছিলেন তা ছিল অবৈতনিক। ভাবলে অবাক লাগে শুধুমাত্র প্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করতে হবে এই তাড়নাতে পাঁচ বছর বিনা বেতনে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে ছিলেন। বলে রাখা ভালো এই জাহাজের কাজ এতটাই কঠিন ছিল যে জাহাজের প্রথম ক্যাপ্টেন চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করছিলেন।[1] তাই ডারউইনের মতো ব্যক্তি বিখ্যাত হবেন না তো আর কে বিখ্যাত হবেন ?

মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রশান্ত মহাসাগরের গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ অবস্থানকালে ডারউইন জীবজগৎকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ও তার ভিত্তিতেই ডারউইন সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে তার বিখ্যাত থিওরির প্রবর্তন করেছিলেন।

এই দ্বীপে দেখা প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন ফিঞ্চ পাখিদের দেখে। ফিঞ্চ পাখির মূল আঠেরোটি প্রজাতি। তার মধ্যে তেরোটি গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে পাওয়া যায়। প্রজাতিগুলি হলো :
Certhidea olivacea
Certhidea fusca
Geospiza heliobates
Geospiza pallida
Geospiza psittacula
Geospiza pauper
Geospiza parvula
Geospiza magnirostris
Geospiza fortis
Geospiza fuliginosa
Geospiza conirostris
Geospiza scandens
Geospiza difficilis [2]

 

[3]

কোনো এক প্রাগৈতিহাসিক কালে এই তেরোটি প্রজাতির পূর্বপুরুষ গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে এসেছিল। সেই একই প্রজাতি থেকে বিভিন্ন প্রজাতির জন্ম হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে একটা প্রজাতি থাকলেই তো হতো। এতো বিভিন্ন প্রজাতির দরকার কি ?

এর উত্তর শুরু করা যাক সেই আদিম প্রজাতির ফিঞ্চকে দিয়ে যখন সে প্রথম গালাপাগোস দ্বীপে প্রবেশ করেছিল। একা সে আসেনি। সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসেছে। ধরা যাক তারা ঘাসের বীজ খেয়ে অভ্যস্ত। ক্রমে সেই আদিম ফিঞ্চ বংশবিস্তার করতে শুরু করল। সংখ্যা এতটাই বাড়তে লাগল যে ঘাসের বীজ সেই সংখ্যার অনুপাতে অল্প হয়ে গেল। মনে হবে যে এবার বোধহয় পাখির এই প্রজাতি বিলুপ্ত হবে। কিন্তু না। তা হল না। বরঞ্চ সেই ছানাপোনারই এক দল তখন বড় বড় গাছের বীজ খেতে আরম্ভ করল ও তাদের ঠোঁটের আকার আরো মোটা ও বড় হয়ে গিয়ে আলাদা একটা প্রজাতির সৃষ্টি করল। বর্তমানে এই তেরো প্রজাতির গালাপাগোস ফিঞ্চরা সম্পূর্ণ আলাদা খাদ্যভ্যাসে অভ্যস্ত। কেউ মোটা উলম্ব আকারের বীজ খায় (Geospiza magnirostris), কেউ ছোট আকারের বীজ খায়(Geospiza fuliginosa), আবার কেউ সামুদ্রিক পাখির রক্ত চুষে খায় (Geospiza difficilis)। একে ওপরের মধ্যে অনর্থক প্রতিযোগিতা যা সম্পূর্ণ প্রজাতিকে বিলুপ্ত করে দিতে পারে তা থেকে বাঁচার জন্য প্রকৃতির কি অদ্ভুত লীলাখেলা। ডারউইন এর নাম দিয়েছিলেন adaptive radiation। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এদের সবার পূর্বপুরুষ কিন্তু এক।

হিন্দুধর্মের সাথে এর মিল কোথায়? সেটি জানার জন্যে হিন্দুধর্মের একটি প্রধান গ্রন্থে আসা যাক যার নাম মনুস্মৃতি। ভগবান মনুকে প্রণাম জানিয়ে এই মহান গ্রন্থের কিছু শ্লোক উদ্ধৃতি হিসেবে তুলে ধরছি।

লোকানান্তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মূখবাহূরূপাদতঃ।
ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশ্যং শূদ্রঞ্চ নীরবর্ত্তয়ৎ।। ৩১।। [4]

সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ প্রজাপতি ব্রহ্মা আপন মুখ, বাহু, উরু ও পদ হতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চার বর্ণের সৃষ্টি করলেন অর্থাৎ মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য ও পদ থেকে শূদ্রের সৃষ্টি করলেন।

সর্ব্বস্যাস্য তু সর্গস্য গুপ্তর্থ্যং স মহাদ্যুতিঃ।
মুখবাহূরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্ম্মাণ্যকল্পয়ৎ।। ৮৭।।
অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।
দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণামকল্পয়ৎ।। ৮৮।।
প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নেব চ।
                বিষয়েষ্বপ্রসক্তিঞ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ।। ৮১।।             [4]

 

পশুনাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নেব চ।
বণিকপথং কুসীদঞ্চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ।। ৯০।।
একমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম্ম সমাদিশৎ।
এতষামেব বর্ণানাং শুশ্রূষামনসূয়য়া।। ৯১।।
ঊর্দ্ধং নাভেমের্ধ্যতরঃ পুরুষঃ পরিকীর্ত্তিতঃ।
তস্মান্মেধ্যতমং ত্বস্য মুখমুক্তং স্বয়ম্ভূবা।। ৯২।।
উত্তমাঙ্গোদ্ভবাজ্জৈষ্ঠাদব্রহ্মণশ্চৈব ধারণাৎ।   [4]

মহাতেজস্বী সেই স্বয়ম্ভূ সমস্ত সৃষ্টির পরিপালন জন্য মুখজাত ব্রাহ্মণ, বাহুজাত ক্ষত্রিয়, উরুজাত বৈশ্য ও পাদজাত শূদ্রদিগের পৃথক পৃথক কর্মসকল কল্পনা করে দিলেন। [4]

তিনি ব্রাহ্মণদিগকে অধ্যয়ন, অধ্যাপন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ এই ছয় প্রকার কর্ম কল্পনা করলেন।[4]

ক্ষত্রিয়দিগের প্রজাপতিপালন, দান, অধ্যয়ন, যজ্ঞ ও স্রকচন্দন-বনিতাদির অনবরত অসেবন সংক্ষেপে কল্পনা করলেন। [4]
বৈশ্যদিগের পশুপালন, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, জলপথে ও স্থলপথে বাণিজ্য, কৃষিকর্ম ও এবং বৃদ্ধির জন্য ধনপ্রয়োগ কল্পনা করলেন। [4]
ভগবান প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রদিগের পক্ষে এই কর্মের ভার সমর্পন করলেন যে তারা অসুয়াবিহীন হয়ে প্রাধান্যরূপে এই বর্ণক্রয়ের সেবা-শুশ্রুষা করবে। [4]

উপরে উদ্ধৃত শ্লোক থেকে এই সিদ্ধান্ত আসা গেল যে ফিঞ্চ পাখির মত মানুষের সৃষ্টিও একই পূর্বপুরুষ অর্থাৎ ভগবান ব্রহ্মার থেকে। সেখান থেকেই চার বর্ণের আবির্ভাব। অর্থাৎ সর্বপ্রথম যে মানব সম্প্রদায় তারা সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য নিজেদেরকে চারটি বর্ণে ভাগ করেছিলেন। প্রত্যেক বর্ণের কর্তব্য ভিন্ন ও সমাজের প্রতি তারা দায়বদ্ধ। প্রত্যেক মানুষ যদি একই কর্ম করত তাহলে সমাজে প্রবল অসন্তোষ ও অহেতুক প্রতিযোগিতা আরম্ভ হতো যা মানবপ্রজাতিকে বিলুপ্তির পথে নিয়ে যেত। প্রত্যেক বর্ণের মানুষ যদি নিজেদের কর্তব্য ঠিকঠাক পালন করেন তাহলে class struggle বা শ্রেণীসংগ্রামের কোনো প্রশ্নই ওঠেনা। ফিঞ্চ পাখিরাও একে অন্যের খাদ্যতে ভাগ বসায় না কারণ তাদের খাদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ আলাদা। তাই খাদ্য নিয়ে একে ওপরের সাথে সংগ্রামের প্রশ্নই ওঠে না।

তাই আদর্শ সমাজব্যবস্থা একমাত্র হিন্দুধর্মের আশ্রয়তেই করা সম্ভব। এর নিদান স্বয়ং প্রকৃতি ও তা মহান বিজ্ঞানী ডারউইনের মতামতের সাদৃশ।বর্তমানে না আমরা আমাদের ধর্মের সঠিকভাবে অধ্যয়ন করি, না তা পালন করি। হিন্দুরা হলো ধর্মভ্রষ্ট। কিছু শতাব্দী ধরে হিন্দুধর্মের ব্যবহারিক মার্গের সমস্ত প্রথা ছেড়ে শুধুমাত্র মোক্ষমার্গের দিকে তাকে পরিচালনা করা হয়েছে। এর কারণে তৈরী হয়েছে এমন এক সমাজ যার গৃহস্থাশ্রমে কোনো উচ্চ আদর্শ নেই ও মোক্ষ থেকেও সে সরে গেছে বহুদূর। আমাদের অর্থাৎ হিন্দুধর্মের এই নবপ্রজন্মের উচিত এই ভুলগুলিকে সংশোধন করা ও ধর্মকে গার্হস্থ্যের দিকে প্রবলভাবে চালিত করা।

References-
1) Brian K. Hall, Benedikt Hallgrimsson. Strickberger’s Evolution. Edition 5.
2) Darwin’s finches – Galapagos Conservation Trust
3) Darwin’s Finches – an overview | ScienceDirect Topics
4) মনুসংহিতা, মেধাতিথি ভাষ্য, শ্রী উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত সরল বঙ্গানুবাদ, প্রথমোহধ্যায়ঃ

 

(লেখক পরিচিতি – সদ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জৈব-রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্ত)

Comment here