শাশ্বত সনাতনস্বভূমি ও সমকাল

“হিন্দু সনাতন ধর্মে দেবতার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে শাস্ত্রীয় ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও তার প্রমাণ”

 

– শ্রী প্রণবানন্দ কর

 

বেশ কিছুদিন ধরেই একটা জিনিস আমরা লক্ষ্য করছি। সেটা হলো সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে নাস্তিক, চার্বাক দর্শন মতবাদ প্রচারকারী এবং সনাতন ধর্ম বিদ্বেষী, সাম্যবাদী কিছু মানুষ সনাতন ধর্মাবম্বী এবং বিগ্রহ পূজার বিশ্বাসী মানুষদের দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে আর সেটা হলো “যে সনাতন ধর্মে দেবতার বিগ্রহের মধ্যে পুরোহিত, তান্ত্রিক এবং সাধকগণ এনারা কিভাবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন? একজন সাধারণ মানুষ ঈশ্বরের প্রাণ কে কিভাবে একটা পাথর কিংবা মাটির মূর্তির ভিতর আবাহন করতে পারেন? আর তাই যদি করেন তাহলে সেই মূর্তি কথা বলে না কেনো? তাদের মতে এগুলো ব্রাহ্মণ্যবাদের এবং তান্ত্রিক পন্থীদের ভাঁওতাবাজি। লোক ঠকানোর একটা পন্থা… আসুন তাহলে আজকে জেনেনি সনাতন ধর্মে প্রাণপ্রতিষ্ঠা কতটা যুক্তিযুক্ত এবং সত্যিই কি এর কোনো মাহাত্ম্য আছে কিনা?

কথায় আছে “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর” কাজেই বিশ্বাস থাকলে অসাধ্য সাধন হতেও বেশি সময় লাগে না। কিন্তু যারা নাস্তিক সমো , যাদের উদ্দেশ্যই সনাতন ধর্মের রীতিনীতিকে ছোটো করা তাদের কে বুঝিয়ে যে লাভ হবে না সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করি না। “সনাতন” শব্দের অর্থ যা আগে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কাজেই এর থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায় যে সনাতন ধর্মের রীতিনীতি ও আগে ছিল এখনও আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবে। আমরা যদি হিন্দু ধর্মের পুরাণ শাস্ত্র, তন্ত্র শাস্ত্র এবং বিভিন্ন তন্ত্রক্ত রহস্য পুজার গ্রন্থগুলোতে আলোকপাত করি তাহলে আমরা দেখতে পাবো ন্যাস, প্রাণ প্রতিষ্ঠা, চক্ষুদান ইত্যাদি এই পর্ব গুলিকে প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ মানা হয়। আমি চাইলে বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা এবং চক্ষুদান সহ আরো পূজা বিধির বিভিন্ন পর্বের শ্লোক গুলি অর্থ সহ উল্লেখ করতেই পারি কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হবে না কারণ শাস্ত্রকে মান্যতা দেয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র এই চার বর্ণ অর্থাৎ যারা ধর্মকে মেনে চলে। কোনো ম্লেচ্ছরা নয়।

ওদের প্রয়োজন হল বৈজ্ঞানিক প্রমাণ। যদিও আমি আমার এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে চেষ্টা করবো প্রাণ প্রতিষ্ঠা ব্যাপারটার দুটো দিককেই তুলে ধরার। সর্বপ্রথম আমাদেরকে জানতে হবে দেবতার মূর্তি এবং প্রাণপ্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রাথমিক কিছু বিষয়। মূলত হিন্দু ধর্মে মূর্তি কে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে যথা বিগ্রহ অর্থাৎ দেব মূর্তি এবং ভাস্কর্য মূর্তি। ভাস্কর্য মূর্তি মন্দির বা স্থাপত্যের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য যেকোনো উপাদান দিয়ে তৈরি করা গেলেও দেব বিগ্রহ কে তৈরি করার নির্দিষ্ট কিছু উপাদানের কথা উল্লেখ রয়েছে হিন্দু শাস্ত্রে। এবং এও বলা হয়েছে যদি সে শাস্ত্রে বর্ণিত উপাদান ব্যাতিত অন্য কোনো বস্তু দিয়ে দেবতার মূর্তির নির্মাণ করা হয় তবে তা পূজা যোগ্য হবে না।

দেবী ভাগবত পুরাণে বর্ণিত রয়েছে

…..”মণিমৌক্তিক-বৈদূর্য্যকাষ্ঠচন্দনবন্দনাঃ।মধূকপার্থবিল্বা অশোকতিন্দুকশিংশপা।। শৈলপার্থিবহেমোত্থাস্তাবদ্ধাতু শুভপ্রদা ।
তদ্বদ্দৈর্ঘিটিতা বৎস তদ্বেদিভিঃ প্রতিষ্ঠাতাঃ।।…..”

অর্থাৎ, মণি মুক্তা বৈদূর্য্য প্রভৃতি রত্ন অথবা চন্দন, মধূক, বিল্ব, অশোক, তিন্দুক এবং শিংশপা প্রভৃতি কাঠ অথবা পাষাণ, মৃত্তিকা এবং স্বর্ণাদি দ্বারা দেবীর মূর্ত্তি নির্মাণ করলে শুভপ্রদ হয়।

এছাড়াও মৎস্য পুরাণে খুবই স্পষ্ট ভাবে বর্ণিত আছে

…..সৌবর্ণী রাজতী বাপি তাম্রী রত্নময়ী শুভা।
শৈলদারুময়ী বাপি লৌহসীসময়ী তথা।।
রীতিকা ধাতুযুক্তা বা তাম্রকাংশ্যময়ী তথা।
শুভদারুময়ী বাপি দেবতার্চ্চা প্রশস্যতে।।..

অর্থাৎ এই শ্লোককে বাংলায় অনুবাদ করলে যা অর্থ দাঁড়ায় তা হলো এই যে – “সোনা, রূপা, তামা, লোহা, সীসা, কাঁসা, পিতল প্রভৃতি ধাতব উপাদান এবং রত্ন,কাষ্ঠ ও প্রস্তর দ্বারা সুন্দর দেবপ্রতিমা নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠাপূর্ব্বক পূজা করা প্রশস্ত।”

তাহলে উপরিউক্ত দুটি শ্লোক থেকে আমরা বুঝতে পারি যে দেব/ দেবীর বিগ্রহ উপরিউক্ত বস্তু ব্যতীত অন্য কোনো বস্তু যেমন প্লাস্টিক, সিমেন্ট, মোম, স্টিল ইত্যাদি বস্তু দ্বারা তৈরী বিগ্রহ শাস্ত্র সম্মত ভাবে পূজ্য নয় বা তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার বিধান নেই। আবার একই সাথে শুধু শাস্ত্র সম্মত বস্তু দ্বারা তৈরী নিজের মর্জি মতো দেব/ দেবীর বিগ্রহ নির্মাণ করলেও তা দেবতার প্রাণ প্রতিষ্ঠার যোগ্য নয়। সম্প্রতি আমরা বিভিন্ন নিউজ চ্যানেল এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা দেখতে পাই আধুনিকতা এবং থিমের প্রতিযোগীতা করতে গিয়ে যে যেমন খুশি দেব মূর্তি গড়ে তোলে। যেমন স্কুটিতে চেপে মা সরস্বতী বসে আছেন, দেবী দুর্গার পদ তলে দুখানি মহা সিংহ।, দেবী লক্ষ্মীর চোখে সানগ্লাস, বাবা মহাদেব বাইকের ওপর চেপে পিছনে নন্দী মহারাজ ইত্যাদি। সত্যি কথা বলতে আরো কতো কি যে শাস্ত্র বিরুদ্ধ কাজ হয় তার হিসেব নেই। আক্ষরিক অর্থে এগুলো কোনোটাই আর দেব বিগ্রহের যোগ্য থাকেন না। আমাদের এই আধুনিকতার চক্করে এই মূর্তি গুলো পরিণত হয় খেলার পুতুলে। আর এই সবের কারণেই নব্য বৌদ্ধ সহ আরো অন্যান্য সনাতন বিদ্বেষীদের কাছে আমাদের ধর্ম হয়ে ওঠে ঠাট্টা তামাশার পাত্র। আমরা যদি শাস্ত্র গ্রন্থ সহ আরো বিভিন্ন পূজা-পাঠের গ্রন্থ গুলির উপর একটু দৃষ্টি বর্ষণ করি তাহলে আমরা দেখতে পাবো “ধ্যান” নামক একটি পর্ব। এটি মূলত সমস্ত দেবদেবীর আকার সম্পর্কে বর্ণনা করে।

যেমন একটি ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে বলি
দেবী সরস্বতীর ধ্যান মন্ত্র হলো

ওঁ তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ
কুচভরনমিতাঙ্গী সন্নিষন্না সিতাব্জে ।
নিজকরকমলোদ্যল্লেখনীপুস্তকশ্রীঃ
সকলবিভবসিন্ধ্যৈ পাতু বাগদেবতা নমঃ ।।

এর অর্থ হলো – চন্দ্রের তরুণ অংশের ন্যায় যাঁর কান্তি শুভ্র, যিনি কুচভরে অবনতাঙ্গী, যিনি শ্বেত পদ্মাস্থনা , যার নিজ কর কমলে উদ্যত লেখনী ও পুস্তক শোভিত , সকল ঐশ্বর্য সিদ্ধির নিমিত্ত সেই বাগদেবী আমাদিগকে রক্ষা করুন । আবার আরো একটি মন্ত্র উল্লেখ করা রয়েছে যেটি দেবী সরস্বতীর ধ্যান মন্ত্র না হলেও তাতেও দেবীর শারীরিক বর্ণনার কথা উল্লেখ পাই। যথা:-

ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে। বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।

অর্থাৎ : তোমার জয় হউক দেবী ,তুমি এই চরাচর জগতের মূল ,তোমার স্তনদ্বয় মুক্তার মালায় সুশোভিত ।তোমার দুই করপল্লবে বীণা ও পুঁথি শোভা পাচ্ছে ,ভগবতী, ভারতী দেবী তোমায় প্রণাম।

কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি দেবী সরস্বতীর ধ্যানে দেবীর বর্ণনাতে বলা হয়েছে শ্বেত শুভ্র বস্ত্র পরিহিতা একজন অপরূপ সুন্দরী দেবী যিনি পদ্মের উপর বসে আছেন। এছাড়াও তার হাতে কখনো শোভা পাচ্ছে বীণা, কখনো পুস্তক কখনো বা লেখনী। কাজেই উপরিউক্ত দুই মন্ত্র দ্বারা আমরা বুঝতে পারছি যে দেবীর শারীরিক কাঠামো কেমন হবে। এরকম প্রতিটা দেব/ দেবীর ই ধ্যান মন্ত্রের উল্লেখ আছে এবং শাস্ত্রে এও বলা আছে যে ধ্যান মন্ত্র অনুসারেই দৈব বিগ্রহের নির্মাণ করতে হবে। যদি তা না হয় তবে সেটা সেই শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করার উপযুক্ত অধার হলো না অর্থাৎ অশাস্ত্রীয় মত অনুযায়ী তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে না। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে… নাস্তিকদের প্রশ্ন মূর্তিতে যদি প্রাণ চলে আসে তবে সে কথা বলে না কেনো? হাঁটতে পারে না কেনো? খায়না কেনো?

এই বিষয়ে সর্ব প্রথম আমাদের একটা জিনিস পরিষ্কার করে বুঝতে হবে। যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা আর কোনো প্রাণী কে জন্ম দেওয়া এক জিনিস নয়। হিন্দু সনাতন ধর্মে একজন সাধক বা পূজারী দেবতার বিগ্রহে তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছে। দেবতা কে জন্ম দিচ্ছে না। ভারতীয় আস্তিক দর্শনে জীবের জীবআত্মা কে পরমাত্মার শক্তির একটি অংশ বিশেষ মানা হয়। এবং শুধু তাই নয় সনাতন ধর্মের দার্শনিক মত এবং শাস্ত্রীয় মত এটাই বলে যে শুধু জীব নয় এই অখিল ব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু আছে সব কিছুর মধ্যেই সেই পরমাত্মার শক্তির বাস আবার বৈজ্ঞানিক ভাবে দেখলেও আমরা দেখি যে সব কিছুই মূলত দুটি জিনিস দ্বারা গঠিত যথা:- অনু এবং পরমাণু। এই অণুকে ভাঙলে পরমাণু এবং পরমাণুকে ভাঙলে পাওয়া যায় তিনটি জিনিস। ইলেক্ট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন এবং সেই ইলেক্ট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন কে ভাঙলে পাওয়া যায় (Energy) বা শক্তি। এবং শক্তি যে নিজে নিজে সক্রিয় হয় না সেটা আমরা সকলেই জানি। তার জন্য তৈরি করার আধার প্রয়োজন এবং সেই আধারেই সেই শক্তিকে আবাহন বা জাগাতে হয়। এই শক্তি প্রসঙ্গে মাঝখানে একটি কথা বলে রাখি হিন্দু ধর্মে শাক্ত মত বলে একটি উপাসনা মার্গ রয়েছে যারা মূলত শক্তির উপাসনা করেন। এবং এই শক্তিরই প্রতিকৃতি স্বরূপ হলেন সাক্ষাৎ দেবী মহামায়া বা কালী। যিনি সমস্ত কিছুর মধ্যে শক্তি হয়ে বিরাজ করছেন এমনকি পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এর ও শক্তি হলেন স্বয়ং দেবী। এবং এই শক্তি বিনা সমস্ত জীবই শব এবং স্বয়ং শিব নিজেও। এক্ষেত্রে শিবের প্রসঙ্গ আপাতত বাদ দিলেও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে এটা কিন্তু প্রমাণিত যে সব কিছুর মূলে কিন্তু শক্তি। আর এই শক্তিকেই জাগরণ করা হয় দৈব বিগ্রহে।

এবার প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে মূর্তিটা নড়াচড়া করে না কেনো?

আমি প্রথমেই বলেছি প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা আর প্রাণী কে জন্ম দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। এ বিষয়েও একটি ছোট্ট দৃষ্টান্ত পেশ করে ব্যাপার টা বোঝানোর চেষ্টা করছি। দেব বিগ্রহ হচ্ছে ব্যাটারি, চার্জার হচ্ছে পূজা, মন্ত্র, যজ্ঞ এবং বিদ্যুৎ হচ্ছে শক্তি/ প্রাণ। একটি চার্জারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কে সরবরহ করে ব্যাটারী তে চার্জ করে সেই ব্যাটারী টা কে সচল করে ঠিক সেরকম একজন পূজারী বা সাধক সঠিক বিধি, মন্ত্র এবং যজ্ঞের আহুতি প্রয়োগের মাধ্যমে দৈব বিগ্রহের মধ্যে শক্তির সঞ্চার ঘটিয়ে অচল মূর্তি কে সচল করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত দেখেছেন কোনো ব্যাটারী কে নড়া-চড়া করতে? তথাপি এটা আমরা প্রত্যক্ষ ভাবে দেখি সেই ব্যাটারী কিন্তু ক্রিয়াশীল। ঠিক তেমনই দেব বিগ্রহ হাঁটা চলা না করলেও তার মধ্যে থাকা শক্তি ক্রিয়াশীল হয়। জ্বলন্ত আলো যেমন জ্বলে উঠলে পতঙ্গের দল ছুটে আসে ঠিক তেমনি শক্তি প্রজ্জ্বলিত হলে দিকে দিকে মানুষ ছুটে আসে সেই পরম শক্তির নিকট নিজের মনস্কামনা পূরণের জন্য।

এই প্রসঙ্গে আমার রাজস্থানের জয়পুরের গোপীনাথ মন্দিরে ঘটনার কথা মনে পরলো। রাজস্থানের জয়পুরের গোপীনাথ মন্দিরে যে গোপীনাথ জিউর বিগ্রহ আছে সেটি বলা হয় এক্কেবারে জীবন্ত এবং প্রাণবন্ত। তো একবার এই কথা শুনে একজন ইংরেজ তা একেবারেই মানতে চাইনি। তার মতে একটা মূর্তিতে কিভাবে প্রাণ থাকতে পারে। অনেকেই এই একই কথা বলাই তিনি মনস্থির করেন যে তিনি নিজের চোখে প্রত্যক্ষ ভাবে না দেখে সে কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না। এবং সেই ইংরেজ গোপীনাথ জিউর সচল বিগ্রহের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য তিনি ( ইংরেজ) গোপীনাথ জিউর বিগ্রহের কব্জিতে একখানা ঘড়ি পড়িয়ে দেন। যেটি কোনো ব্যাটারী বা চার্জের মাধ্যমে চলতো না। চলতো একমাত্র শরীরের নার্ভ চলাচলের মাধ্যমে। অর্থাৎ একমাত্র কোনো স্নায়ু সচল দেহের সাথে লেগে থাকলেই সেই ঘড়ি চলবে। তো সেই ইংরেজ দেখে অবাক হয়ে যাই যে গোপীনাথ জিউর হাতে সেই ঘড়ির কাঁটা টিক টিক টিক করে চলছে। এবং সেই ঘড়ি আজও রাজস্থানের গোপীনাথ জিউর হাতে বিদ্যমান এবং আজও সচল। এর থেকে এটাই প্রমাণিত হয় সঠিক বিধি, মন্ত্র এবং ভক্তিভাব সহকারে পূজার মাধ্যমে সেই বিগ্রহের মাধ্যমে প্রবল ভাবে শক্তি সঞ্চয় হয়েছে।

সম্পূর্ণ অভূতপূর্ব জগৎ পরমেশ্বরের নিয়ন্ত্রণে। সম্পূর্ণ প্রেম ও ভক্তি সহকারে তাঁর পবিত্র নাম উচ্চারণের মাধ্যমে তিনি নিজেই নিয়ন্ত্রিত হতে পারেন। ঈশ্বরের এই নামগুলি পরম ভক্তদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে (বা এই মন্ত্রগুলি কেবলমাত্র ফলাফল দেয়, যদি বিশুদ্ধ গোপনীয় প্রেমময় ভক্তির অধিকারী নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের দ্বারা উচ্চারণ করা হয়। আরো একটা বিষয় যেটা না বললেই নয় অনেকেই বলে হিন্দুরা মূর্তি পূজা করে কেনো? কিন্তু আসল সত্য হলো এই যে হিন্দুরা মূর্তির পূজা করে না হিন্দুরা বিগ্রহের মাধ্যমে ঈশ্বরের পূজা করে। এবং শুধু মূর্তির মাধ্যমে নয় নদীর মাধ্যমে পূজা করে, পাহাড়- পর্বতের মাধ্যমে পূজা করে, অগ্নির মাধ্যমে পূজা করে, সূর্যের মাধ্যমে পূজা করে, শিলার মাধ্যমে পূজা করে। কারণ সনাতন ধর্মের আদর্শ হলো এই যে ঈশ্বরের থেকে সব কিছু সৃষ্টি এবং সব কিছুর মধ্যে ঈশ্বর আছেন। তাই কেউ সরাসরি ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং কেউ বিগ্রহের মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন এবং আধ্যাত্মিক বিশেষজ্ঞদের এটাই মতামত যে সরাসরি নিরাকার রূপে ঈশ্বরের সাথে যোগ স্থাপন করার চেয়েও কোনো বিগ্রহ কে মাধ্যম করে যোগ স্থাপন করলে তা অতি দ্রুত ফলপ্রদ হয়। যেমন করে কোনো ব্যক্তি সরাসরি তমঃ গুণ থেকে সত্তঃ গুণে পৌঁছাতে পারে না তাকে অবশ্যই আগে রাজসিক হতে হয় এবং তারপর সাত্ত্বিক গুণ কে অবলম্বন করতে হয় ঠিক তেমনি কোনো সাধারণ ব্যক্তি সরাসরি ঈশ্বরের সাথে যোগ স্থাপন করতে পারে না। তাকে সবার আগে বিগ্রহের মাধ্যমে ঈশ্বরের উপস্থিতির অনুভূতি কে অনুভব করতে হয় এবং একটা সময়ের পর সেই ব্যক্তি যখন চূড়ান্ত আধ্যাতিক স্তরে পৌঁছায় তখনই সেই সারসরি ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে তার দর্শন লাভ করে।

 

(লেখক পরিচিতি: প্রথম বর্ষ; সংস্কৃত কলেজ, বোলপুর)

Comment here