আমার ইতিহাসসাদাকালো রঙমাখা

“সেন শাসক কর্তৃক বাঙলা ভাষার চর্চা বন্ধ ” – সত্য না অতিকথা?

– শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার

 

বর্তমান অন্তর্জালের যুগে বাংলাদেশের একটি বিশেষ গোষ্ঠী ‘সেনরা বাঙলা ভাষার চর্চা বন্ধ করেছিল’ এই তত্ত্ব প্রচার করছে।
তার উৎস রূপে শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেনের ‘সরল বাঙ্গালা সাহিত্যে’র একটি বিশেষ উদ্ধৃতি ব্যৱহৃত হচ্ছে ।

সময় হল বিষয়বস্তুর অভ্যন্তরে প্রবেশের।

প্রথম দাবি, পাল রাজসভায় বাঙলা ব্যবহার হতো সেনারা সংস্কৃতকে রাজভাষা করে।
যেটা সর্বেব ভুল ধারণা। কারণ কোন পাল শিলালিপি বা তাম্রপত্রে বাঙলা নেই।

দ্বিতীয় দাবি, পালরা চর্যাপদ লিখিয়েছিল ও বাঙলা ভাষার চর্চা করত। সর্বৈব ভুল পাল রাজসভায় চর্যাপদ লেখা হয়নি।পাল রাজসভায় লেখা প্রতিটি গ্রন্থ সংস্কৃতে লেখা।

এবং চর্যাপদের ভাষাকেউ পুরোপুরি বাঙলা বলা চলে না।তবে প্রোটো বাঙলা বলা যায় বটে।

তৃতীয় দাবি ,

“অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য
চরিতানি চ।
ভাষায়াং মানবঃ শুত্ব।
রৌরবং নরকং গচ্ছেৎ ॥”

দীনেশ চন্দ্র সেনের দাবি –

এটাতে নাকি বলা হয়েছে বাঙলা ভাষা শুনলে কেউ নরকে যাবে এবং এটা সেন রাজাদের কতৃক প্রদত্ত।

দীনেশ চন্দ্র সেন বাঙলা ভাষার প্রসঙ্গে এই শ্লোকটি ব্যবহার করেছেন।

অনুবাদ –

এবার এই শ্লোকের উদ্ধৃতির অনুবাদ হল

অস্টাদশ পুরাণ ও রামচরিতের ভাষ্য কেউ শুনলে তিনি রৌরব বা নরকে গমন করবেন।

এবার এই শ্লোকে বাঙলা ভাষার উল্লেখ কোথায়?

এখানে একটি হাস্যকর প্রশ্ন রয়ে যায় দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর অনেকগুলি গ্রন্থে এই শ্লোকটি ব্যবহার করেছেন কিন্তু উৎস উল্লেখ করেননি।

এমনকি লক্ষণ সেনের শাসনকালে লিখিত কোন সাহিত্য বা তাম্রলিপিতে সেভাবে ‘বঙ্গাল’ শব্দের ব্যবহার হয়নি। সেন শাসনকালে গৌড় শব্দটির ব্যবহার হত।কেবলমাত্র একটা জায়গায় উল্লেখ রয়েছে – সেটা সদুক্তিকর্ণামৃত ।

“ঘনরসময়ী গভীরা বক্রিম-সুভগোপজীবিত।
কবিভিঃ অবগাঢ়া চ পুনীতে গঙ্গা বঙ্গাল-বাণী চ । -বঙ্গালস্য।”

সদুক্তিকর্ণামৃত শ্রীধর দাস

সুতরাং তাঁর এই দাবি ভিত্তিহীন

চতুর্থ দাবি , কৃত্তিবাসী রামায়ণ লেখা বাঙলা ভাষাতে তাই ঐ শ্লোকটিতে রামচরিতের ভাষা বলতে বাঙলা ভাষা বলা হয়েছে।
১) ভাষা না রামচরিতের ভাষ্যর কথা বলা হয়েছে।
২) যদি তাও মানি কৃত্তিবাসী রামায়ণ তো ১৪০০ র পরে লেখা।সেন শাসকরা আসে কিভাবে?
অর্থাৎ ১৪০০ র পরবর্তী লেখা শ্লোক সেন শাসকরা লেখায় কিভাবে?
৩) রামচরিত মানস আর রাম পাঁচালী এক নয় ।
রামচরিত তুলসীদাসের লেখা কৃত্তিবাসের না । তাহলে পুরো শ্লোকটার ব্যক্ষাটাই ভুল।

পঞ্চম দাবি , কোন একটি প্রবাদ বাক্য যেটা দাবি করা হচ্ছে বাঙলা ভাষা নিয়ে করা।“কৃত্তিবেসে, কাশীদেশে আর বামুন ঘেষে, এই তিন সৰ্ব্বনেশে ।”

এখান থেকে বলা হচ্ছে রামায়ণের বঙ্গানুবাদ করায় এটা বলা হয়েছে।

১)প্রবাদ যদিওবা প্রাথমিক উৎস হতে পারে না।তথাপি প্রবাদের কোন সুনির্দিষ্ট উৎসও হয় না। এমনকি এই প্রবাদটি এই প্রজন্মের কেউ জানে না।
২)প্রবাদ কোন একটি প্রজন্মে শুরু হয় আবার কয়েক প্রজন্মের মধ্যে অবলুপ্তোও হয়ে যায়।
সেক্ষেত্রে ভট্টাচার্যরা এটা রচনা কয়েছে এটা কথাটার সত্যতা কতটুকু আমার জানা নেই।
৩) ভিন্ন এলাকা ভিত্তিক বিভিন্ন প্রবাদ হয় তার অর্থোও পৃথক হয়
“কৃত্তিবেসে, কাশীদেশে আর বামুন ঘেষে, এই তিন সৰ্ব্বনেশে ।”
এর সাধারণ অর্থ তো আমার সামান্য বুদ্ধিতে একটুই যে…

কাশিদাসী কৃত্তিবাসী মহাভারত ও ব্রাহ্মণ ঘেঁষা ব্যক্তি বিপজ্জনক। যেখানে এই প্রবাদে খোলাখুলি ব্রাহ্মণ ও কৃত্তিবাসী কাশীদাসী সাহিত্যকে একযোগে আক্রমণ করা হচ্ছে। সেখানে ব্রাহ্মণরা বিরোধিতা কিভাবে করে বলে আমার বুদ্ধির অতীত। সর্বোপরি পৃষ্ঠার সম্পূর্ণটা ইনারা দেন না চালাকি করে । দীনেশ চন্দ্র সেন সেন একটা অনুমানভিত্তিক নিজের মতামত দিয়ে অনুচ্ছেদ শেষ করছেন ও পরবর্তী প্যারায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ নিয়ে একটি তত্ত্বের অবতারণা করছেন ।

কৃত্তিবাসী রামায়ণের বিরুদ্ধে সেন রাজারা ফরমান জারি করেছেন এই হাস্যকর দাবি দীনেশ চন্দ্র সেন করেননি।

অন্তিমে একটি কথা বলা যায় দীনেশ চন্দ্র সেন যে বৌদ্ধ বনাম বৈদিক ধর্ম ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই থিওরিটি সর্বত্র প্রচার করেছেন এটিও সর্বৈব ভুল বহু পাল শাসক শিলালিপিতে নিজেদের পরমমাহেশ্বর বা পরম ভাগবত লিখতেন।

( বীরভূমের মাখদুম পীরের মামারে – উদ্ধার হওয়া নয়পালের শিলালিপিতে উনাকে বলা হয়েছে পরম ভাগবত)

শৈব ও বৈষ্ণব মঠকে পাল রাজারা দান দিতেন এমনকি বৌদ্ধগয়ায় চতুর্মুখী শিবলিঙ্গ স্থাপনো করেছেন এমন উল্লেখ পাওয়া যায় লামা তারানাথের বর্ণনায়। [ Dynastic History of Magadha, 450-1200 A.D ; B P Sinha pp 184]

সেনরাও বৌদ্ধ বিদ্বেষী ছিলেন না; মহারাজা লক্ষণ সেনের রাজসভায় শ্রমণ পুরুষোত্তমকে আমন্ত্রণ জানিয়ে লঘু বৃত্তি নামক গৌড়ীয় ব্যাকরণ রচনা করানো হয় । পরবর্তীতে মধু সেন , লব সেন , বুদ্ধ সেন, বা সাভারের সেন বংশের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের উল্লেখ পাওয়া যায়। এবং লামা তারানাথ তো এও বলেন গৌড়েশ্বর মধু সেন পরমসৌগত উপাধি ব্যবহার করতেন।

বর্তমান সময়ে পালরা বৌদ্ধ ও সেনরা ব্রাহ্মণ্য পৃষ্ঠপোষক এই প্রাগৈতিহাসিক Monolinear ধারণাটি রাখার কোন কারণ অবশিষ্ট নেই।

 

(লেখক পরিচিতি: B. Tech in Ceramic Technology)

Comment here