বসুধাসাদাকালো রঙমাখা

৩০০০ খ্রিস্টপূর্বেও পুতুলের গলায় ক্রস, মুদ্রায় আইডল অফ পমোস –

– শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 

পশ্চিম এশিয়ার ছোট্ট দ্বীপ, সিরিয়া থেকে আরেকটু পশ্চিমে। ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে অর্থনীতি, সবেতেই এই দেশ একেবারে ইউরোপীয়। গ্রিক ভাষার পাশাপাশি এখানে তুরস্কের ভাষা সমানভাবে চলে ঠিকই, তবে ইউরো-জোনের অংশ হতে চেয়ে তুরস্কের আবেদন-নিবেদন এখনও পর্যন্ত কার্যকর না হলেও ২০০৮ সাল থেকেই ছোট্ট এই দ্বীপে চালু হয়ে গেছে ইউরো নামের মুদ্রা। সেই অর্থে মুদ্রায় সভ্যতা নিয়ে এই ধরাবাহিকে এই প্রথম এমন কোনও দেশ নিয়ে লেখা যেদেশের অবস্থান ইউরো জোনে। এই দেশের জাতীয় পতাকাটি অনন্য। সাদার উপরে কমলা রঙে দেশের মানচিত্র , তার নীচে সবুজ পাতা।

এই দেশের ইউরো মুদ্রায় একটি ছবি দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। চালকোলিথিক যুগের একটি পুতুল, তার গলায় যে হার রয়েছে সেটিতে একটি যোগচিহ্ন, মানে ক্রস। যিশুখ্রিস্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগেও তাহলে ক্রস চালু ছিল! কেমন ভাবে ছিল? স্বভাবতই জানতে ইচ্ছে করে কী ছিল সেই দ্বীপের ভাষা, কী ছিল তাঁদের ধর্ম? আজ সাইপ্রাসের প্যাফস জেলার পমোস থেকে পাওয়া একটা পুতুলের কথা, তার আলোকে যে সময়ে এই পুতুল তৈরি সেই সময়কে ফিরে দেখা।

৩০০০ খ্রিস্টপূর্বে চালকোলিথিক পিরিয়ডের যে নিদর্শনটি এই দ্বীপের ঐতিহ্য ও সভ্যতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেটির মূর্তি এই দেশে বসানো হয়েছে। ১ ইউরো মুদ্রাতেও এই নিদর্শনের ছবি আছে। এটির নাম আইডল অফ পমোস। মূর্তিটি দেখতে যোগ চিহ্নের মতো, এর গলাতেও একটি ক্রস চিহ্নযুক্ত লকেটওয়ালা হার রয়েছে। বুকের অংশ সামান্য স্ফীত, যা থেকে পুরাবিদরা মনে করেন, এই মূর্তি আসলে নারীমূর্তি। ক্রস চিহ্নও তো নারীত্বেরই প্রতীক। বিজ্ঞান বইয়ে যোগচিহ্নের মাথায় গোল এঁকে স্ত্রীলিঙ্গ বোঝানো হয়। এই চিহ্নের উৎস হল প্রাচীন মিশর। দেবী আন্‌খের প্রতীক সেই চিহ্ন। হায়রোগ্লিফিকেও এই চিহ্ন (𓋹)দেখা যায়। কোথাও এই চিহ্ন জীবনেরও প্রতীক। ল্যুভর মিউজিয়ামে মিশরের একটি খোদাই করা প্রাচীন প্রস্তরখণ্ড রয়েছে যেখানে দেবতা হোরাস এই চিহ্নটি দিচ্ছেন ফারাও দ্বিতীয় রামেসেসকে (জন্ম ১৩০৩ খ্রিস্টপূর্ব, মৃত্যু ১২১৩ খ্রিস্টপূর্ব)। মনে করা হয়, এটির অর্থ হল ঈশ্বর জীবন উপহার দিচ্ছেন ফারাওকে।

সাইপ্রাসের ইতিহাস খোঁজা হলে দেখা যাবে নব্যপ্রস্তর যুগ বা আজ থেকে মোটামুটি এগারো হাজার বছর আগে এখানে সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে চতুর্থ শতকের মধ্যে এখানে আসিরিয়া, মিশর ও পারস্য থেকে মানুষ এসেছেন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে এই দেশকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করেন রাজা ইভাগোরাস। তখন গ্রিক সংস্কৃতিক অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে এই দ্বীপ। আরও পরে তাই ম্যাসিডোনিয়ার রাজা আলেকজান্ডারকে এই দ্বীপ স্বাগত জানিয়েছিল হয়ত সাংস্কৃতিক মিল থাকার জন্যই। পরে পশ্চিম এশিয়ার সাম্রাজ্যের অধীনে দ্বীপটি চলে যায়, ভাষাগত বৈচিত্র্য যোগ হয়, কিন্তু তা গ্রিক সংস্কৃতির আধারে।

যে সময়ের কথা আমরা আলোচনা করছি, মানে খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে, সেই সময়ে সাইপ্রাসে ষাঁড়ের পুজো হত বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এই প্রভাব এসেছিল আনাতোলিয়া থেকে। গ্রিক ভাষায় আনাতোলিয়া মানে পূর্বের দেশ, অর্থাৎ এক্ষেত্রে আনাতোলিয়া হল অধুনা তুরস্ক। আরও পরে এখানে সাপের পুজো শুরু হয়। তারও পরে মিশরের ভালোবাসার দেবী ইনান্নার উপাসনা। আরও পরে এখানে প্রবেশ করে খ্রিস্টধর্ম।

সাইপ্রাসের সংস্কৃতির সঙ্গে আইডল অফ পমোস ওতপ্রতোভাবে জড়িত। দেশের নানা অনুষ্ঠানে এই চিহ্ন নানা আঙ্গিকে ব্যবহার করা হয়। ঘর সাজাতে, এমনকি হারের লকেটেও এই চিহ্নের বহুল ব্যবহার রয়েছে আজও। সমুদ্রের ধারে পর্যটন কেন্দ্রে এই ছোট পুতুলের আদলে বিশাল মূর্তি বা স্ট্যাচুও দেখা যায়। এখন স্থান পেয়েছে মুদ্রায়। মানে বিগত পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এই পুতুল গুরুত্ব হারায়নি আজও।

 

 

(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)

Comment here