শাশ্বত সনাতন

কিন্নৌর কৈলাশ॥ এক অধুরী কাহানী – ভ্রমণ কাহিনী – ৫

(পূর্বের অংশের পর)

– শ্রী সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

০৫/০৭/২০১৫

আজ ৫ই জুলাই রবিবার, আমরা মোটামুটি ফ্রেশ হয়ে সকাল ৬.৩০ নাগাদ বেরোলাম নেক্সট গনেশ গুম্ফার দিকে। রাস্তা আর শেষ হয়না এত চড়াই চিন্তা করা যায়না। তারমাঝে মোরান বা বরফের ছোট গ্লেসিয়ার, এগুলোকে টপকে যেতে হবে।সে যে কি কঠিন ব্যাপার সেটা যারা না গেছে তাদের লিখে বোঝানো যাবেনা। এটা সিমলা বা কুলু মানালির বরফ খেলা নয়। পাহাড়ের ওপর থেকে যে ধ্বস নামে বরফে সেগুলো ডেখেলে যায়। বরফের ওপর চলতে গিয়ে যদি পা পিছলে যায় তাহলে কত নিচে যে চলে যাবে তার তো ঠিক নেই উলটে কোনো পাথরে ঠুকে গেলে শরীরকে আর দেখতে হবেনা। দু তিনটে ওরকম বরফের নদী আমরা পাথরের ওপর পা দিয়ে পার হলাম কিন্তু ৩য়টা আর উপায় নেই। ছবিলাল এক্সপার্ট লোক, আমি ওর ফুটস্টেপে পা দিয়ে এগিয়ে গেলাম। সিধু আসতে গিয়ে দুবার আছাড় খেলেও সামলে নিয়ে আবার এগিয়ে এসে কভার করে মেন রাস্তায় উঠে আসলো। আমরা রাস্তা বলতে পাকা রাস্তার কথা বলছিনা কিন্তু। এটা কোনো রাস্তাই নয় পায়ে চলা পথ, গুঁড়ো পাথর আর ধুলোয় ভর্তি। পা একবার যদি পিছলায় কোথায় গিয়ে পড়বে তার ঠিক নেই। একধারে ঢাল আর এক দিকে ঘাস পাথরে ঢিপি যাকে ভরসা করা স্রেফ বোকামী। সরু পায়ে চলা রাস্তা কোথাও ৬ইঞ্চি কোথাও এক দেড় ফুট ছোটবড় পাথরে ভর্তি। যাইহোক আমরা গুম্ফাতে পৌঁছলাম প্রায় ১০.৩০ নাগাদ।ওখানে ছবিলাল ম্যাগি বানালো। গরম গরম ম্যাগী স্যুপ খেয়ে শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করে রওনা দেব আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পার্বতী কুণ্ডা।যা টাফ!!!! আমি তো কাল সন্ধ্যের পর থেকে দুটো পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতেই পারছিনা। হাঁটুদুটো গেছে।দুদিনে ফেটে চৌচির।

তখন সাড়ে ১১টাহবে, সেই এক রাস্তা বড় বড় পাথরের বোল্ডার আর বরফের নদী পেরিয়ে এত ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘাম ছুটে গেল। আমরা যখন অবশেষে পার্বতী কুণ্ডতে পৌঁছলাম তখন ৩টে বাজে পুরোটাই বরফের নদী আর গ্লেসিয়ার তার মাঝখানে পাথরে ঘেরা একটা কুণ্ড নীল জল দেখা যাচ্ছে ওপরে ভাসমান বরফের স্তর, ওখান থেকে শিবলিঙ্গ আরও দেড় ঘন্টার রাস্তা। আমরা ভাবলাম যদি আমরা যাই তাহলে আর ফিরতে পারবোনা কারন কুন্ড থেকে লিঙ্গ পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসতে ৩-৪ঘন্টা লাগবে মানে সন্ধ্যে ৭টা বেজে যাবে। ওখান থেকে গুম্ফা আরও ২.৩০ঘন্টা। এত ঠাণ্ডায় স্লিপিং ব্যাগ ছাড়া থাকা যাবেনা যেমন ভাবেই হোক আমাদের আশিকিধারা ফিরতেই হবে, আর দিনের আলোতে আমাদের গ্লেসিয়ারগুলো পাস করতেই হবে।তাই আর না এগিয়ে পার্বতী কুণ্ডে বসেই পুজা করলাম ধুপ আর মিছরি-কাজুর প্রসাদ দিয়ে। ছবিলাল নিচে নেমে কুণ্ডের জল সংগ্রহ করে আনল, আমরা কিছুক্ষন বসে ব্যাক করলাম। আসার সময়টা আমাদের খুব তাড়াতাড়ি আসতে হবে, দিনের আলো থাকতে থাকতে ঐ বরফের গ্লেসিয়ার পার করতে হবে নাহলে খুব রিস্ক হয়ে যাবে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আরও দেড় ঘন্টা হেঁটে শিবলিঙ্গের চরণ ছুঁতে পারলামনা, হয়ত ভগবানের সেই ইচ্ছাই ছিল নয়ত এতটা কষ্ট করে পৌঁছেও আর একটু দয়া কেন হ’লনা? মনটা খুব খারাপ হয়ে ছিল কিন্তু আর বসার উপায় নেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। কষ্ট থাকলেও আমাদের একটাই স্বান্তনা এই যে দেবাদিদেব মহাদেবের শীতকালিন আবাসস্থল কিন্নর কৈলাশের গৃহদ্বার পর্যন্ত আসতে পেরেছি, যে কুণ্ড থেকে পার্বতী স্নান করে জল নিয়ে যান সেই কুণ্ড দর্শন ও জল নিতে পেরেছি।

যাইহোক আমরা তাড়াতাড়ি পা চালালাম কিন্তু রাস্তা সেই এক। আমার হাঁটুতে আস্তে আস্তে ব্যথা শুরু হচ্ছে, মনের জোরে গনেশ গুহার কাছে আস্তে ছবিলাল এগিয়ে গেল ম্যাগি বানানোর জন্য। আমি আর সিধু আস্তে আস্তে গুহায় এসে গরম গরম ম্যাগি স্যুপ খেয়েই বেরিয়ে পরলাম, তখন প্রায় সন্ধে ৬টা বাজে। গ্লেসিয়ারটা পার করতে হবে। নির্দিষ্ট জায়গায় আসতে গ্লেসিয়ারটাকে বিশাল বড় চওড়া মনে হল। ছবিলালের ফুটস্টেপ ফলো করে চলা এবার খুব কষ্টকর হ’লো। দু চারবার পড়ে আছাড় খেয়ে অতি কষ্টে ধারে এলাম, ওদিকে সিধু মাঝখানে আটকে গেছে। দুবার স্লিপ করেছে। ছবিলাল ওকে নিয়ে আসতে গেল। আমি অলরেডী খোঁড়াচ্ছি তাই আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। প্লেন রাস্তায় কষ্ট কম, কিন্তু স্টেপ আর ছড়াইতে হাঁটতেই কষ্ট বেশি হচ্ছে। আকাশে আর আলো নেই, আমরা মোটামুটি রিস্কি জোনগুলো পার হয়ে এসেছি এবার আমরা টর্চ জ্বালিয়ে এগোতে থাকলাম। ওদিকে আশিকিধারে আরও কয়েকজন বোধহয় এসেছে আমাদের টর্চের আলো দেখে ওরাও টর্চের সিগনাল দিতে থাকলো আমরাও প্রত্যুত্তরে আলোর সিগনাল দিলাম।

যত কাছে আসছি ততই টর্চের ব্লিঙ্কিং আর হর হর মহাদেব এর নাম ধ্বনিত হতে লাগল। আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আর ওরা আমাকে মাঝখানে রেখে টর্চ জ্বালিয়ে চলতে লাগলাম অবশেষে রাত সাড়ে ১০টার সময় এসে পৌঁছলাম আশিকিধারে। আসার পর ৩-৪জন আমাদের অভিবাদন করল। ওরা ৫জন এসেছে সিমলা সালোনি থেকে। ২২-২৮ বছরের তরতাজা যুবক গড় উচ্চতা ৫’৮”-৬’, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। আমরা তো পুরো ক্লান্ত শরীরে গিয়ে কোনোক্রমে জুতোতা খুলে আমাদের পাতা ম্যাটে গিয়ে বসলাম। দেখি আরও ১২জন পাঞ্জাব,হরিয়ানা, দিল্লী থেকে এসেছে তার কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ছবিলাল এত দূর থেকে পিঠে ১৫কেজির বোঝা নিয়ে এসেও আমাদের জন্য গরম ম্যাগি করল। আমরা ম্যাগিস্যুপ খেয়ে হাঁটুতে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে একটা পেনকিলার খেয়ে শুলাম।

(লেখক পরিচিতি – বিশিষ্ট জ্যোতিষী; একাগ্র পান্থ)

 

(ক্রমশঃ)

 

Comment here