“পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি– তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু ক’রে আর রাখিয়ো না ধরে।”
(২৬ চৈত্র, ১৩০২)
১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার এই আহ্বান পরবর্তীকালে শ্রীঅরবিন্দের কাছেও ‘শিকল ছেঁড়ার ডাক’ হিসাবে প্রতিভাত হয়েছিল; যেমনভাবে আবিষ্ট হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের উদাত্ত আহ্বানে। এই বছরই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের রাজনৈতিক মত প্রতিষ্ঠার সংগঠন্ হিসাবে বোম্বাইয়ের গোকুলদাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজে আত্মপ্রকাশ করেছিল। রবীন্দ্রনাথও সময়ের দাবিকে তাঁর কবিতায় এভাবেই তুলে ধরেন। অনেকেই রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীঅরবিন্দের দৃষ্টিভঙ্গিগত মতের অমিল বিষয়ে নানান কাটাছেঁড়া করেছেন। এরমধ্যে ইতিহাসকাররা যেমন আছেন, আছেন নানান সাহিত্যিক-ও। তাঁদের স্ব-কপোলকল্পিত কল্পনার রঙে রাঙিয়ে এই দুই মহান বঙ্গসন্তানের ভিন্নমুখী প্রবণতাকে আপন আপন চিন্তার স্তরে সামিল করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। আর যে ঢেকুর তাঁরা তুলেছেন, তাতে উভয়েরই মর্যাদা কিয়ৎ পরিমাণে হলেও ক্ষুণ্ন হয়ছে বৈকি। এই বিষয়ে শেষ কথা তো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ-ই বলেছেন; ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী যতই বলুন না কেন যে ইতিহাসে ‘শেষ কথা’ বলার কোন সুযোগ নেই!
শ্রীঅরবিন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধাঞ্জলি ধরা পড়ে ‘নমস্কার’ কবিতায় কবির বিনম্র প্রণতি জ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে। কয়েকটি লাইন উল্লেখ করলেই তা আমাদের গোচরে আসবে:
“অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহো নমস্কার।
হে বন্ধু, হে দেশবন্ধু, স্বদেশ-আত্মার
বাণীমূর্তি তুমি। তোমা লাগি নহে মান,
নহে ধন, নহে সুখ; কোনো ক্ষুদ্র দান
চাহ নাই কোনো ক্ষুদ্র কৃপা; ভিক্ষা লাগি
বাড়াওনি আতুর অঞ্জলি। আছ জাগি
পরিপূর্ণতার তরে সর্ববাধাহীন–
যার লাগি নরদেব চিররাত্রিদিন
তপোমগ্ন, যার লাগি কবি বজ্ররবে
গেয়েছেন মহাগীত, মহাবীর সবে
গিয়েছেন সংকটযাত্রায়, যার কাছে
আরাম লজ্জিত শির নত করিয়াছে,
মৃত্যু ভুলিয়াছে ভয়–সেই বিধাতার
শ্রেষ্ঠ দান আপনার পূর্ণ অধিকার
চেয়েছ দেশের হয়ে অকুন্ঠ আশায়
সত্যের গৌরবদৃপ্ত প্রদীপ্ত ভাষায়
অখণ্ড বিশ্বাসে।………….,………”
( উৎস: সঞ্চয়িতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা, ১৪১৬, পৃষ্ঠা-৪৮৪, ভাদ্র-১৩১৪, আগষ্ট,১৯০৭)
আবার প্রৌঢ় বয়সে এসে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং লিখেছেন,” প্রথম তপোবনে শকুন্তলার উদ্বোধন হয়েছিল যৌবনের অভিঘাতে প্রাণের চাঞ্চল্যে। দ্বিতীয় তপোবনে তাঁর বিকাশ হয়েছিল আত্মার শান্তিতে। অরবিন্দকে তাঁর যৌবনের মুখে ক্ষুব্ধ আন্দোলনের মধ্যে যে তপস্যার আসনে দেখেছিলুম, সেখানে তাঁকে জানিয়েছি–
অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহো নমস্কার।
আজ তাঁকে দেখলুম তাঁর দ্বিতীয় তপস্যার আসনে, অপ্রগল্ ভ স্তব্ধতায়– আজও তাঁকে মনে মনে বলে এলুম —
অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহো নমস্কার।” (উৎস: প্রবাসী, শ্রাবণ, ১৩৩৫, জুলাই, ১৯২৮)
‘প্রবাসী’ পত্রিকায় কবির স্বয়ং স্বীকারোক্তি নিশ্চিতরূপে উভয়ের মতপার্থক্য বিষয়ে কল্পকথার অবসান ঘটানোর অভ্রান্ত দলিল রূপে বিবেচিত হবে। অথচ স্বদেশী আন্দোলনের যুগে(১৯০৫-১৯১০) আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ও রূপরেখা বিষয়ে এমনভাবে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে, যাতে মনে হবে রবীন্দ্রনাথ, শ্রীঅরবিন্দের আদর্শের পরিপন্থী ছিলেন। একথা ঠিকই যে, ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ জমিদার নিখিলেশের মুখ দিয়ে ছোট ছোট গরীব ব্যবসাদারদের দ্রব্য ছিনিয়ে নিয়ে অগ্নি সংযোগ করার বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছিলেন। উপন্যাসের নিজস্ব গতিধারায় ‘দেশসেবক’ সন্দীপের চরিত্র উদঘাটনের তাগিদ এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে থাকতেও পারে। কিন্তু কিছু মানুষ উপন্যাসের ঐ ঘটনাকে ইতিহাস বলে চালিয়ে দিলেন! পাশাপাশি একথা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ হবে যে, ঐ সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে অগ্নিসংযোগ সহকারে বিদেশী দ্রব্য পুড়িয়ে ফেলার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যা আন্দোলনের ঘোষিত কর্মসূচীর অঙ্গীভূত ছিল। সবক্ষেত্রে আন্দোলনের রাশ জাতীয় নেতৃত্বের হাতেও ছিল না। কিন্তু ব্যাখ্যা করা হতে থাকলো, রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলনে ভিন্ন চিন্তার দিশারী ছিলেন। তাহলে পরিণত বয়সে এসে কবি, শ্রীঅরবিন্দের যৌবনের আন্দোলনকে ‘তপস্যা’-র আখ্যা দিতেন না। তাহলে কোনটা হবে মানদণ্ড? উপন্যাসের নিখিলেশ চরিত্রের নাটকীয় সংলাপ, নাকি ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় পরিণত বয়সের কবির স্বীকারোক্তি? ইতিহাসের বিচারে দ্বিতীয়টিই অধিকতর গ্রহনযোগ্য।
শ্রীঅরবিন্দ বিলেতে থাকা অবস্থাতেও বাংলার ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী প্রবণতাগুলোর হাল হকিকত সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে বরোদা এস্টেটে প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত হন। কিন্তু আদ্যন্ত শিক্ষাবিদ শ্রীঅরবিন্দের সেই কাজ ছিল না-পসন্দ। এই জন্যই তো তিনি আমলার পদে নিযুক্ত না হওয়ার জন্য অশ্বারোহণ পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন। শিক্ষার কমলবনে বিচরণ করাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল। তাই ১৯০০সালে বরোদা কলেজে ইংরাজীর অধ্যাপক পদে যোগদান করেন এবং ঐ কলেজেই ১৯০৪ সালে অধ্যক্ষের পদ অলংকার করেন। তিনি শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের চেষ্টায় সদা চিন্তিত ছিলেন। বরোদাতেও গুপ্ত সমিতির সংস্পর্শে আসেন। এই সময় তাঁর ভ্রাতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষ বরোদাতে অরবিন্দের সান্নিধ্যে ছিলেন। শ্রীঅরবিন্দ বারীনকে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত করে বাংলার রাজনীতিতে মনোনিবেশ করার জন্য প্রেরণ করেন এবং স্বয়ং অনতিবিলম্বে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করে একদিকে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের হাল ধরেন, পাশাপাশি তরুণ যুবাদের প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯০৬ সালে কলকাতার জাতীয় কলেজ(পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)-এর প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন বাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রটিতে শিক্ষিত তরুণদলের মনে জাতিয়তাবাদী চেতনা সঞ্চারের স্থির লক্ষ্য নিয়ে।
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখের লোভ সংবরণ করা গেল না। যখন শ্রীঅরবিন্দকে আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল, সেই সময় তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে একটি পত্র লেখেন। মামলার ট্রায়ালের সময় দেশবন্ধু বিচারকের সামনে খোলা এজলাসে তা পাঠ করেন। পত্রটি উদ্ধৃত করা হোল:
“It is suggested that I preached the idea of freedom for my country and this is against the law, I plead guilty to the charge. If that is the law here I say I have done that and I request you to convict me, but do not impute to me crimes. I am not guilty of, deeds against which my whole nature revolts and which, having regard to my mental capacity, is something which could never have been perpetrated by me. If it is an offence to preach the ideal of freedom, I admit having done it. I have never disputed it. It is for this I have given up all the prospects of my life. It is for this that I came to Calcutta, to live for it and labour for it. It has been the one thought of my waking hours, the dream of my sleep. If that is my offence, there is no necessity of bringing witness to bring into the box to dispose different things in connection with that. Here am I and I admit it…. If that is my fault you can chain me, imprison me, but you will never get out of me a denial of that charge.”
কি অসাধারণ দৃঢ়চেতা ও অসীম শৌর্য-বীর্যের অধিকারী ছিলেন, তা উল্লিখিত বক্তব্যের প্রতিটি শব্দবন্ধ থেকে আমরা ধারনা করতে পারি। “স্বাধীনতার আদর্শের প্রচার যদি অপরাধ হয়, তাহলে আমি অপরাধী”–তাঁর এই বাণী বিদ্যুতবহ্নির মতো বাংলার সীমানা অতিক্রম করে অবশিষ্ট ভারতে বিপ্লবী চেতনার এক নবরূপ দান করে। এই জন্যই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে ‘নমস্কার’ কবিতার দ্বারা আপন শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ বঙ্গমাতার দুঃখগাথার শরিক হয়ে যখন উদাত্ত আহ্বান করছেন, দুখিনী মাতার অশ্রু নিবারণের জন্য তাঁর সন্তানদের শিশুত্ব থেকে পুরুষত্বে উত্তরণের জন্য ‘মানুষ’ হবার ডাক দিচ্ছেন; তখন সেই আহ্বানে শ্রীঅরবিন্দও শরিক হন। কবি স্বদেশবাসীর সাহায্যে ‘স্বদেশীভাণ্ডার'(১৮৯৭) নির্মাণ করে আত্মনির্ভরতার পাঠ দিচ্ছেন। আর শ্রীঅরবিন্দ ভারতমাতার সার্বিক বিকাশের অসীম সম্ভাবনাময় স্বপ্নের বীজ তরুণ যুবাদের মনে বপন করছেন। এই মণিকাঞ্চন যোগেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের মজবুত পিলার তীব্রভাবে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। তাই রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীঅরবিন্দ–ছিলেন একে অপরের পরিপূরক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল। সেই কারণে উভয়ের মতপার্থক্যের কষ্টকল্পনার কাহিনীর নিমপাচন গলাধকরণের প্রচেষ্টা সর্বৈব অতিরঞ্জিত ও বিরক্তিকর।
ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায় – ইতিহাসের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক, বর্তমানে যুক্ত আছেন পুরুলিয়ায় অবস্থিত সিধো-কানো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে।
Comment here