(প্রথম পর্বের পর)
অতঃপর ১৪ই জানুয়ারি ১৭৬১ … ভারতবর্ষের ইতিহাসের মোড় ঘোরানো যুদ্ধের দিন আগত হলো। একদিকে মারাঠা সৈন্য আরেকদিকে আফগান ফৌজ।
মারাঠি সেনার নেতৃত্বে সদাশিব রাও ভাউ, তার সঙ্গেই যুদ্ধভূমি তে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তরুণ বিশ্বাস রাও। এছাড়াও সিন্ধিয়া পরিবারের প্রায় সকলেই হাজির ছিলেন পানিপথের ময়দানে।
তোপ চালানোর নেতৃত্বে ছিলেন ইব্রাহিম খাঁ গার্দি । অন্যদিকে আরো বিভিন্ন মারাঠা সর্দার রা তো ছিলেন ই। কথিত আছে,তৎকালীন মারাঠা সাম্রাজ্যে হেন পরিবার ছিল না যেই পরিবারের কেউ পানিপথের যুদ্ধে বীরগতি প্রাপ্ত হননি।
যুদ্ধের ময়দানের কিছু দূরে মারাঠা সর্দার দের স্ত্রী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের পাহারায় ছিল বেশ কিছু মারাঠা সৈনিক । যুদ্ধে মারাঠা বাহিনীর পরাজয় ঘটলে তাদের যেন সুরক্ষিত ভাবে পুনা পৌছে দেওয়া যায়, সেই ব্যবস্থার ভার দেওয়া হয়েছিল ইন্দোরের হোলকরদের হাতে।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে মর্নিং শোজ দি ডে।অবশ্য এ কথাটা সবসময় যে সত্যি হয়ে ওঠে না প্রত্যক্ষ প্রমান বোধহয় পানিপথের যুদ্ধ।
যুদ্ধের শুরুটা মারাঠাদের রণনৈপুন্যের অন্যতম নিদর্শন বলা চলে। ইব্রাহিম খাঁ গার্দির নেতৃত্বে মারাঠা তোপ আফগান বাহিনী কে পর্যুদস্ত করে দেয়, অবস্থা এমন ই হয় যে আফগান বাহিনী পলায়ন করতে শুরু করে দেয়…পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় স্বয়ং আবদালিকে। লোভ দেখিয়ে হোক কিংবা ভয় দেখিয়ে , আবদালি আফগান ফৌজ কে একত্রিত করতে সক্ষম হন। পুনরায় চলে যুদ্ধ। কিন্তু আফগান ফৌজ দুর্ধর্ষ মারাঠাদের বিরুদ্ধে বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারে না, বেলা তখন দ্বিপ্রহর.. আফগান বাহিনী তখন পিছু হঠছে … মারাঠাদের ওই গৈরিক ধ্বজ পানিপথের ময়দানে সগৌরবে উড্ডীন.. আরো একটা পালক বোধহয় আজ যোগ হবে মারাঠা সাম্রাজ্যের মুকুটে. … এক ই সঙ্গে ভারতের শাসন ক্ষমতা পুরোপুরি ভাবে দীর্ঘকালের জন্য বোধহয় আবার যাবে কোনো হিন্দু রাজার হাতে৷ পৃথ্বীরাজ চৌহানের সাথে মুহম্মদ ঘোরীর তরাইনের সেই যে যুদ্ধ! তার বৃত্ত বোধহয় আজ এই পানিপথের ময়দানে সম্পুর্ন হতে চলেছে।
বেলা গড়িয়ে চলেছে… সূর্য একটু একটু করে ম্লান হচ্ছে.. আফগান বাহিনী তখনো পিছু হঠছে… হঠাৎ দুই মারাঠা সর্দার- দামাজি গায়কোয়াড় আর বিট্ঠল দেবের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো.. পানিপথের যুদ্ধ জয়ের জন্য ইতিহাসে কি শুধু গার্দি আর ভাউয়ের নাম থাকবে! তারা কিনা সমগ্র ভারতের তথা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনীর সর্দার.. তারা কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ জিনিস দেখবে! নাঃ যতোই সেনাপতি সদাশিব ভাউ তাদের বলে থাকুন বাহিনী নিয়ে গার্দি ও তার তোপচি দের লক্ষ্য করে করা যে কোনো আফগান ফৌজের আক্রমন প্রতিহত করতে….. সময় এসেছে এগিয়ে যাওয়ার… আফগানদের সমস্ত “ডিফেন্স” মারাঠা বর্গি বাহিনী দিয়ে ভেঙে তছনছ করে দেওয়ার। যেমন ভাবা তেমনি কাজ.. দামাজি গায়কোয়াড় আর বিট্ঠল ভিনকচুড়কর সঙ্গে এগিয়ে গেল বর্গি বাহিনী ..আফগান দের তাড়া করে, কিন্তু একি ! পিছন থেমে সমস্ত তোপ থেমে গেল কেন! কিছুক্ষন পরেই বর্গীরা বুঝলো যে তারা মৃত্যুফাঁদে পা দিয়েছে। আফগান দের আক্রমন করতে গিয়ে খেয়াল ই করেনি যে তারা আফগানদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বর্ষণ করে চলা তোপগুলির সামনে আফগানদের জন্য রক্ষাকবচ বানিয়ে দিয়েছে.. নিজেদের সৈন্য সামনে এসে যাওয়াতে তোপ গেছে স্তব্ধ হয়ে…অন্যদিকে তোপ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আফগান রা মরন কামড় দিয়েছে , বর্গীদের যে শুধু দফারফা করেছে তাই নয় এগিয়ে গিয়ে গার্দিকেও নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে।মারাঠা দের অধিকাংশ তোপ গেছে বন্ধ হয়ে। কিন্তু আফগান দের তুলনামূলক ভাবে অনেক হালকা ছোট তোপ যাকে আফগান রা জাম্বুরাক বলে, সেই তোপ কিন্তু উটের পিঠে চাপিয়ে জায়গা বদলে বদলে ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করছে মারাঠা সৈন্য দের ওপরে।
একদিকে যখন এই ঘটনা ঘটছে অন্যদিকে চরম বীরত্বের সাথে লড়ছেন ভাউ, আর সিন্ধিয়া রা রোহিল্লা আফগান দের প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করেছে। ভাউ এর আক্রমনের তীব্রতায় পিছু হঠতে থাকে আফগান সেনা, পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক হয়ে দাঁড়ায় যে, আবদালি নিজের ফৌজের পলায়নরত সৈন্য দের গুলি করার হুকুম দেয়… বিজয়শ্রী তখন মারাঠাদের হাতের মুঠোয় প্রায়, কিন্তু এখানেই বড় আরেকটা ভুল হয়ে গেছিল মারাঠাদের, একে তারা যুদ্ধে নেমেছিল আধপেটা খেয়ে.. সুতরাং বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কাহিল হয়ে পড়তে শুরু করে সৈন্য রা । অন্যদিকে আফগান রা প্রায় ১৫০০০ সৈন্যকে “রিজার্ভ ফোর্স” হিসেবে রেখে দেয়। বেলা তখন পড়ে আসছে..শীতকালের সূর্যের তেজ কমে এসেছে…তখনো বোঝা যায়নি যে এই সূর্যাস্তই সমগ্র ভারতে হিন্দু সাম্রাজ্যের সূর্যাস্তের বার্তা বয়ে আনবে।
ভাউ তখন ঘোর যুদ্ধে মগ্ন.. হঠাৎ তার খেয়াল হলো বিশ্বাস রাও কে কোথায় দেখা যাচ্ছে না…কোথায় গেল সে! তাহলে কি আফগান দের হাতে বন্দি হলো? বিশ্বাস রাও এর ক্ষতি হওয়ার অর্থ ভবিষ্যৎ মারাঠা সাম্রাজ্যের চরম ক্ষতি হওয়া, মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্তরসূরিকে যে ভাবেই হোক উদ্ধার করতে হবেই যে। ভাউ দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে নেমে পড়লেন হাতির পিঠ থেকে। এর ফল হলো মারাত্মক… সেনাপতি কে হাতির পিঠে না দেখতে পেয়ে মারাঠা বাহিনীকে গ্রাস করলো ভীতি.. বহু সেনা নিজেদের জায়গা ছেড়ে পিছিয়ে যেতে লাগলো.. আফগান দের জমি ছেড়ে দেওয়ার ফলে এবার মারাঠা বাহিনী প্রথমবার ব্যাকফুটে যেতে বাধ্য হলো…অন্যদিকে গার্দির ও তার তোপচি দলের ভাগ্য বিপর্যয়ের ঘটনা তো আগেই লিখেছি। বিস্বাস রাও নিহত হয়েছেন , ভাউসাহেব তখন প্রায় কয়েকশ আফগান সেনার মাঝখানে যুদ্ধ করছেন প্রবল পরাক্রমে …. পরাক্রম দ্বারা হয়তো আফগানদের হারানো সম্ভব কিন্তু নিয়তিকে?নাঃ.. কখনো না। ভাগ্যদেবী মারাঠা দের থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। বিকেল তখন চারটে বোধহয়… অস্তসূর্যের শেষ রক্তিম আভা পানিপথের ময়দানকে রাঙিয়ে দিচ্ছে..মারাঠা সৈন্য দের রক্তে ভেসে যাচ্ছে পানিপথের ময়দান.. আজ এখানেই ভারতবর্ষের হিন্দু পদপদশাহির স্বপ্নেরও অপমৃত্যু ঘটলো বোধহয়।
কটক থেকে আটক অবধি যেই সাম্রাজ্য ছিল অপ্রতিরোধ্য , যাদের বর্গি বাহিনীর ( বাংলার বর্গি আক্রমণের সাথে কোনরূপ সম্বন্ধ নেই, মারাঠা ক্যাভালরি কে বর্গি বলা হত) নাম শুনলে শত্রুদের হাড় হিম হয়ে আসতো.. সেই বর্গি রা , সেই মারাঠা রা পানিপথের ময়দানে হেরে গেল।
যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্বে তখন আফগানদের হাতে মারাঠা সেনারা যাকে ইংরেজিতে বলে “স্লটার” হচ্ছে , সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ মারাঠা সর্দার হয় ততক্ষনে নিহত নয়তো আহত , তখন ই মারাঠাদের অন্যতম প্রবীণ সর্দার মলহার রাও হোলকর পার্বতী বাই ও অন্যান্য মারাঠা সর্দারের পরিবার কে নিয়ে গোয়ালিওরের দিকে পাড়ি দিলেন। তুকোজি সিন্ধিয়া আফগানদের হাতে বন্দি… বেঁচে আছেন কেবল মাহাদজি সিন্ধিয়া…ভয়ঙ্কর রকমের আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। ভাউ এর মৃতদেহ শনাক্ত করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল… অনেক খোঁজার পর একটি ধড়বিহীন মৃতদেহ কে ভাউসাহেব হিসেবে শনাক্ত করা হয়.. আশেপাশে প্রায় জনা ত্রিশেক আফগান সৈন্যের লাশ ও পাওয়া গিয়েছিল .. সহজেই অনুমেয় যে ভাউ যুদ্ধে কি প্রবল বিক্রম দেখিয়েছিলেন।
মারাঠাদের পানিপথে একটি “ম্যাসাকার ” হয়েছিল… প্রায় ৫০০০০ মারাঠি সৈনিক ও তীর্থযাত্রী প্রাণ দেন আফগানদের হাতে..এ ছাড়াও বহু মানুষ নিখোঁজ ছিলেন ,আফগান রা বহু মারাঠি কে দাস হিসেবে আফগানিস্তান নিয়েও যায়। মারাঠিরা বলে “সংক্রান্ত কোসাললা”
অর্থাৎ “সংক্রান্তির অভিশাপ”। বলা হয় পুনা তে যেন পরিবার ছিল না যেই পরিবারের কেউ পানিপথে বীরগতি প্রাপ্ত হয়নি… এমনই ভয়ঙ্কর ছিল সেই যুদ্ধ… ।
তবে আহমেদ শাহ আবদালির ক্ষতি ও নেহাত কম হয়নি মারাঠাদের সাথে যুদ্ধে তার সৈন্য বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি হয় মারাত্মক…আর কোনো যুদ্ধে না গিয়ে পত্রপাঠ বিদায় নেন ভারতবর্ষ থেকে…যাওয়ার আগে একটি চিঠি দিয়ে যান পেশোয়া কে ….
কিছুটা অংশ এখানে তুলে দিলাম।
“There is no reason to have animosity amongst us. Your son Vishwasrao and your brother Sadashivrao died in battle, was unfortunate. Bhau started the battle, so I had to fight back unwillingly. Yet I feel sorry for his death. Please continue your guardianship of Delhi as before, to that I have no opposition. Only let Punjab until Sutlaj remain with us. Reinstate Shah Alam on Delhi’s throne as you did before and let there be peace and friendship between us, this is my ardent desire. Grant me that desire.”…….জি এস সরদেশাই এর ” মারাঠি রিয়াসৎ” ( দ্বিতীয় ভাগ), সেজওয়ালকরের “পানিপথ”,(৯৯ নং পৃষ্ঠা) মরোপন্থ এর জবানি।
(ক্রমশ)
ভারতীয় ইতিহাস অনুরাগী
[…] পর্বের […]