আঙিনাশাশ্বত সনাতনসংস্কৃতি

একটি ধানের শীষের উপরে – ৬

 

“রথযাত্রা লোকারণ্য, মহাধুমধাম-
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম,
রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি-
মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসেন অন্তর্যামী!”

হ্যাঁ এবার যে জগতের নাথ, বলভদ্র আর সুভদ্রার রথযাত্রার শুভক্ষণ, এবং আজ উল্টোরথ তথা বহূধাযাত্রাও বটে। উল্টো কেন? এইযে সোজারথ থেকে একসপ্তাহ জগন্নাথ দেব তাঁর ভাইবোনসমেত মাসিরবাড়ি কাটালেন এবার যে একই পথে রথের চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে বাড়ি ফেরার পালা। মূলত পাঁচঘরায় রথযাত্রার মহাসমাবেশে উৎসব তেমন নেই তবে ১০ বছর হল নিষ্ঠাভরে গ্রামের বাসিন্দা শ্রী নিমাই আদক মহাশয় নিজ তৎপরতায় কাঠের টানারথ নিয়ে পদব্রজে যাত্রা করে মাসীর বাড়ী নিয়ে গিয়ে পালন করেন রথযাত্রা, তাতে কম করে হলেও গাঁয়ের মানুষ সামিল হন। এবং আছে বাড়ির ছোটছোট খোকাখুকুর বায়নাক্কায় কেনা কাঠের খেলনারথ, তা সাজিয়ে নিয়ে সারা গাঁ ছোটবন্ধুরা মিলে কাঁসরঘন্টা নিয়ে হেঁটে বেড়ানোর হুল্লোড়। এই চিত্র দেখে বড্ড মনে হয় যেন ছোটছোট পায়ে ওই সারল্যে ভরা শিশুগুলো বহূদূর শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে যেতে পারেনা বলেই, তাদের সরলমন দিয়ে সাজানো ছোট্ট কাঠের রথে বুঝি ঈশ্বর এসে ধরা দেন। তাঁর লীলা বোঝা যে বড়ই দায়, কোনখানে কোনরুপে যে ধরা দেয়।।

এইযে রথ নিয়ে এতো বললাম এবার তো পুরীর পর যার স্থান রথযাত্রায় ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেই শ্রীরামপুর মাহেশের রথযাত্রার কথা উল্লেখ করতেই হয়, সাথে বলা উচিত এগাঁয়ের কতিপয় মানুষও উৎসব দেখতে মাহেশেই যান, যার কারণেই এভাবে বলা। আগেই বলেছি গাঁ থেকে শ্রীরামপুরের দূরত্ব কম নয় তবে উৎসবের রেশ‌ পেতে পৌঁছতে হবে সেখানেই, যেখানে দশমবর্ষীয়া আলুথালু বেশের এক বঙ্কিমনায়িকা অসুস্থ মায়ের ওষুধ-পথ্যের জোগাড়ে অপটু হাতে বনফুলের মালা গেঁথে বেচতে গিয়েছিলো এই রথের মেলায়। সে অভাগী প্রবল বর্ষণে মালাবিক্রয়ে অসমর্থ হলেও লেখক দেখা করিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গী রুক্মিণী কুমারের সঙ্গে!! এমনভাবেই দেখা হোক উৎসবের রেশে, মেতে থাকুক পাব্বণের ছটায় ,‌ উজ্জ্বল হয়ে থাকুক মাটিমাখা বাংলার এ রীতিনীতি, আবেগের আহ্লাদের পাব্বণ। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা মঙ্গলকামনায় সকলে মিলে যখন এহেন পার্বণের উদযাপন করেন, বলতেই হয় তাতে মানুষের মধ্যে একজনের অপরের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকা, একান্নবর্তী হয়ে থাকার সহজ সংস্কারটা ভোরের সূর্যকিরণের মতোই উজ্জ্বলভাবে রয়ে আছে।

শ্রাবণ মানেই শিবের মাস, শিবপুরাণ অনুযায়ী শিবের জন্মমাস শ্রাবণের ভূমিকা প্রতি শিবালয়ে অনস্বীকার্য পাঁচঘরা থেকে কয়েক কিমি দূরেই মহাদেবের মহাধাম তারকেশ্বরে ভক্তদের খালিপায়ে সারাদিন,সারারাত গঙ্গা নদীর জল কাঁধে অনেকটা রাস্তা হেঁটে মহাদেবকে জলসমর্পণ করার সমারোহ-ওফ্ , চাক্ষুষ না হলে বোধেরও বাইরে রইবে জলযাত্রার এত উন্মাদনা, শুধু তাই তো নয়- শিবের তুল্য নানান গণেশ মূর্তি-ইয়াব্বড় ত্রিশূল-কখনও শিবভক্ত হনুমান-আবার রামায়ণের এক দৃশ্য শোলা দিয়ে, থার্মোকল দিয়ে দৃষ্টিসুখের মূর্তি তৈরি করে দূরের কোনো গ্রাম-শহর থেকে কাঁধে নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে আসা- নিছক পাগলামী হতে পারে না অদৃশ্যপটের নিকট ইতিবাচকতার বিশ্বাস-আত্মসমর্পণ জলযাত্রাও যে উৎসব-তার আস্বাদ শ্রাবণ মাসে তারকেশ্বর সংলগ্ন রাস্তায় রাস্তায় পাওয়া যায় ।।

এছাড়াও শিবলিঙ্গের স্থাপনা করে অনেকে নিজ গৃহেই শ্রাবণের সোমবারে উপবাস থেকে পঞ্চামৃত সহযোগে উপাসনা করেন মনোরথ পূরণের জন্য। এ গ্রামের প্রতিষ্ঠিত শিবতলা বিশেষ ভূমিকায় থাকে এ সময়। নারীপুরুষ নির্বিশেষে নির্জলা অথবা একবেলা ফলাহার করে নিষ্ঠাভরে পূজার্ঘ্য সমেত যান শিবতলা এবং কিছুজন গ্রামেরই সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির প্রাঙ্গণে। বিশ্বাস-নিষ্ঠা-ভক্তি এভাবেই তো প্রকট হয় “সত্যম্-শিবম্-সুন্দরম্”

এবার এ মাসের একটি ব্রতের কথা না বললেই নয়, “লোটন-ষষ্ঠী ব্রত”। শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে মায়েরা সন্তানের মঙ্গলকামনায় পুরোহিত এর সাহায্যে এই ব্রত পালন করেন। ঘি-আখের গুড়, মরসুমি ফল, নানান মিষ্টি ও ডাবসমেত এই ব্রতের পূজাপাঠ সম্পন্ন করে রাত্রিকালে স্বল্প আহারাদি ‌সেরে সেদিন কাটান। “লোটন” নামটি কেন এলো? লুন্ঠনের অপভ্রংশ থেকে। অর্থাৎ কিনা শ্রাবণের এই ষষ্ঠীপুজোয় কথিত আছে পুজোর সামগ্রী লুঠ হয়েছিল কোনও এক বামনীর ঘর থেকে , পরক্ষণে সে দ্রব্য দৈববাণীতে যে লুঠ করেছিলেন সে ফেরত দেন, এরপর হতে এ ষষ্ঠীপুজোর নাম হয় লোটন ষষ্ঠী অর্থাৎ “লুন্ঠন-ষষ্ঠী”!

আসব, আবার পরের পর্বে, ততক্ষণে সকলে জগন্নাথ বলভদ্র এবং সুভদ্রার উল্টো রথযাত্রার শুভেচ্ছা নিন, উদযাপন করুন।

Comment here