শাশ্বত সনাতন

নাসদীয় সূক্ত -অনুবাদ

-শ্রী রাকেশ দাশ

 

নাসদাসীন্নো সদাসীৎ তদানীং নাসীদ্ রজো নো ব্যোমা পরো যৎ।
কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীদ্ গহনং গভীরম্॥১॥

ভাবানুবাদ –

প্রলয়াবস্থায় যখন সমস্ত সৃষ্টি নিজ কারণে লয়প্রাপ্ত হয় তখন অসৎ অর্থাৎ অত্যন্ত অলীক বা শূন্যস্বরূপ কিছু ছিল না, আবার নাম-রূপ বিশিষ্ট অস্তিত্বশীল রূপে প্রতীয়মান এই জগৎও ছিল না। এই লোকসমূহ ছিল না। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুণ ছিল না। আকাশ, বায়ু, অগ্নি প্রভৃতি পঞ্চভূত ছিল না। অন্তরিক্ষ লোক, দ্যুলোক প্রভৃতি অর্থাৎ পাতাল থেকে সত্যলোক পর্যন্ত চতুর্দশ ভুবন ছিল না। এই লোকসমূহাত্মক ব্রহ্মাণ্ডই যখন ছিল না তখন সেই ব্রহ্মাণ্ডের আবরক তত্ত্ব সূক্ষ্মভূত সমূহ কিংবা মহৎ, অহঙ্কারাদি তত্ত্বসমূহও ছিল না। আবরণীয় বস্তুই যদি না থাকে তবে আবরকের প্রয়োজন কী? কোথায়ই বা থাকবে? অর্থাৎ কোন স্থান বা দেশ ছিল না। কার ভোগের জন্য থাকবে? জগতের প্রয়োজন ভোগ, ভোগকর্তার অভাবে ভোগ্যের কী প্রয়োজন? আচ্ছা, সেই সময়ে কি গহন গভীর জল ছিল? কারণ, শ্রুতি তো বলেছেন, ‘আপো বা ইদম্ অগ্রে সলিলম্ আসীৎ’ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ৭/১/৫/১)। সেই কারণ স্বরূপ জলও তখন ছিল না।

ন মৃত্যুরাসীদ্ অমৃতং ন তর্হি ন রাত্র্যা অহ্ন আসীৎ প্রকেতঃ।
আনীদ্ অবাতং স্বধয়া তদ্ একং তস্মাদ্ ধান্যন্ন পরঃ কিং চনাস॥২॥

ভাবানুবাদ –

মৃত্যু ছিল না তখন। জীবনও ছিল না। রাত্রি এবং দিনের বোধ ছিল না। সেই এক অদ্বিতীয় তত্ত্ব নিজ মায়ার সহিত ওতপ্রোত অবস্থায় বায়ু ছাড়াই প্রাণ ধারণ করেছিল। তার থেকে ভিন্ন কিছুই ছিল না, সৃষ্টির পরে দৃশ্যমান এই চরাচর জগৎও ছিল না।

তম আসীৎ তমসা গূঢ়ম্ অগ্রেঽপ্রকেতং সলিলং সর্বমা ইদম্।
তুচ্ছ্যেনাভ্বপিহিতং যদ্ আসীৎ তপসস্তন্মহিনাজায়তৈকম্॥৩॥

ভাবানুবাদ –

সেই প্রলয়কালে অন্ধকারের সমান আবরক মায়ার দ্বারা এই সম্পূর্ণ অন্ধকাররূপী জগৎ আবৃত ছিল। তাদেরকে একের থেকে অপরকে পৃথক ভাবে জানার কোন উপায় ছিল না। সেই জগৎ নিজ কারণ মায়ায় মিশ্রিত অবস্থায় ছিল। নিজ কারণের সহিত অবিভক্ত অবস্থায় বর্তমান, অগ্রে উৎপদ্যমান সেই জগৎ তুচ্ছ মায়ার দ্বারাই আবৃত ছিল। সৃষ্টিসঙ্কল্পময় তপস্যার মহিমায় সে উৎপন্ন হল।

কামস্তদগ্রে সমবর্ততাধি মনসো রেতঃ প্রথমং যদাসীৎ।
সতো বন্ধুমসতি নিরবিন্দন্ হৃদি প্রতীষ্যা কবয়ো মনীষা॥৪॥

ভাবানুবাদ –

সৃষ্টির পূর্ব মুহূর্তে কামনার উদ্রেক হয়েছিল। পূর্ব পূর্ব কল্পে জীবকুল কর্তৃক আচরিত যে কর্মের ফল বাসনা রূপে মায়াতে বিলীন হয়ে প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল। সেই কর্মফলই সৎ রূপে প্রতীয়মান এই সৃষ্টির বন্ধনের কারণ। সেই কর্মফল রূপী বন্ধনের কারণ অসৎ রূপে প্রতীয়মান অব্যাকৃত কারণ রূপী মায়াতে বিলীন আছে বলে যোগীরা নিজেদের হৃদয়ে বুদ্ধির দ্বারা বিচার করে নিশ্চিত ভাবে জেনেছেন।

তিরশ্চীনো বিততো রশ্মিরেষাম্ অধঃ স্বিদ্ আসীদ্ উপরি স্বিদ্ আসীৎ।
রেতোধা আসন্মহিমান আসন্ত্ স্বধা অবস্তাৎ প্রয়তিঃ পরস্তাৎ॥৫॥

ভাবানুবাদ –

সৃষ্টির হেতু স্বরূপ অবিদ্যা, কামনা এবং কর্ম থেকে উৎপন্ন তাদের কার্যভূত সৃষ্টি সূর্যরশ্মির সমান সমস্ত সৃষ্টিতে ব্যাপ্ত হয়েছিল। সেই কার্যস্বরূপ সৃষ্টি কি মধ্যস্থানে ছিল, নাকি নীচে ছিল, নাকি উপরে ছিল? বস্তুতঃ, এরা একই সময়ে সমস্ত দিকে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। সেই উৎপন্ন কার্যবস্তু সমূহের মধ্যে ছিল বীজভূত কর্মের ধারক– অর্থাৎ কর্মের কর্তা এবং ফলের ভোক্তা– জীবসমূহ এবং মহান আকাশ প্রমুখ ভোগ্য বস্তু সকল। এই দুই প্রকার সৃষ্টির মধ্যে ভোগ্য বস্তু সমূহ নিকৃষ্ট এবং ভোক্তা জীব উৎকৃষ্ট।

কো অদ্ধা বেদ ক ইহ প্র বোচৎ কুত আজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ।
অর্বাগ্ দেবা অস্য বিসর্জনেনাথা কো বেদ যত আবভূব॥৬॥

ভাবানুবাদ –

পারমার্থিক ভাবে কোন ব্যক্তি জানে? কে এই সৃষ্টির সম্পর্কে বলতে পারে? কোথা থেকে এই সৃষ্টির উৎপত্তি? কে এর স্রষ্টা? এই জাগতিক ভৌতিক সৃষ্টি দেবতাদের থেকেও প্রাচীন। সেজন্য দেবতারাও এর সম্পর্কে বলতে অক্ষম। ফলে, যার থেকে এই সম্পূর্ণ সৃষ্টি উৎপন্ন হয়েছে, তাকে কে জানতে পারে?

ইয়ং বিসৃষ্টির্যত আবভূব যদি বা দধে যদি বা ন।
যো অস্যাধ্যক্ষঃ পরমে ব্যোমন্ত্সো অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ॥৭॥

ভাবানুবাদ –

যে পরমেশ্বর থেকে এই সৃষ্টির উদ্ভব তিনিই একে ধারণ করে আছেন। তিনি ভিন্ন আর কে-ই বা এই সৃষ্টিকে ধারণ করতে সক্ষম? এই বিবিধ সৃষ্টির যিনি নিয়ন্তা, ঈশ্বর তিনি নিজের উৎকৃষ্ট আকাশের সমান সুনির্মল নিজ প্রকাশে প্রতিষ্ঠিত আছেন। সেই অত্যন্ত প্রসিদ্ধ পরমেশ্বরই এই সৃষ্টিকে জানেন। তিনি ব্যতীত আর কেউ জানতে পারে না।

 

শ্রী রাকেশ দাশ – (অধ্যাপক, সংস্কৃত ও দর্শন বিভাগ
রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ শৈক্ষিক ও গবেষণা সংস্থা)
(মানিত বিশ্ববিদ্যালয়)
বেলুড় মঠ, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ ৭১১২০২)

 

Picture Courtesy – BooksFact 

Comment here