তর্পণে প্রণত মসীশাশ্বত সনাতনস্বভূমি ও সমকাল

|| দেব রাজবংশের হিন্দু প্রতিরোধ, রাজা দনুজমর্দনদেব ও বাঙ্গালী জাতিস্বত্ত্বার নির্মাণ || – ২

(পূর্বের অংশ)

 – স্নেহাংশু মজুমদার

●⚔️ দিয়ার-ই-বাঙ্গালাহ’র যুদ্ধ :

রাজা দনুজ রায়ের সাথে সুলতান বলবনের চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও বলবনের লুব্ধ দৃষ্টি ছিল দনুজের সাম্রাজ্যের ওপর । তিনি এরপর তার পুত্র ও সেনাপতি নাসিরউদ্দিন বোগরা খানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন “দিয়ার-ই-বাঙ্গালাহ” (دیار بنگلا) বিজয়ের জন্য । কিন্তু রাজা দনুজ রায় খুব অনায়াসেই বোগরা খানকে পরাজিত করে পালাতে বাধ্য করেন । জিয়াউদ্দিন বারানি’র ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’তে উল্লিখিত যে “রাইয়ে বঙ্গালা” (روی در بنگال) অর্থাৎ বাঙ্গালার রায় (রাজা) দনুজমাধব এর প্রতিরোধের ফলে সুলতানের নির্দেশ পালন করতে অক্ষম হন বোগরা খান ।

●⚔️ সুবর্ণগ্রাম বিজয় (১২৯৪ খ্রি:)

১২৮৩ সালে বিহার-লক্ষ্নৌতির গভর্নর মুঘিসুদ্দিন তুঘ্রাল দক্ষিণ-পূর্ব অভিযানের সময় সেনবংশের অন্তর্ঘাতের সুযোগ সুবর্ণগ্রাম দখল করে । পূর্ববঙ্গের সর্বাধিক ধনসম্পদসমৃদ্ধ ঐশ্চর্যশালী নগরী সুবর্ণগ্রাম পুনরুদ্ধারের জন্য মহারাজা দনুজমাধব দৈবসংকল্প শুরু করেন । বিহার-লখনৌতিতে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ দিল্লি সালতানাতের গভর্নর হিসেবে শাসন করছিলেন । বিহারের কর্তৃত্ব নিয়ে এসময় ফিরোজ শাহ ও রুকুনুদ্দিন কাউস’র মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যা ক্রমশ গৃহযুদ্ধের আকার ধারন করে ।

এই অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে সোনারগাঁও উদ্ধারের পরিকল্পনা করেন রাজা দনুজ রায় । দিল্লি সালতানাতের অধীনতা থেকে সুবর্ণগ্রাম মুক্ত করার জন্য মহারাজ দনুজমাধব এসময় একটি শক্তিশালী সালতানাত বিরোধী রাজনৈতিক জোট গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন । দিল্লির সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি পার্শ্ববর্তী আরাকান রাজ্যের সাথে মিত্রতা করার সিদ্ধান্ত নেন । অবশেষে বাঙ্গালার রাজা দনুজ রায়’র সাথে আরাকানের তৎকালীন শাসক মিং-হেট্টে (မင်းထက်)’র সাথে মিত্রতাচুক্তি সম্পন্ন করেন ও দিল্লি সালতানাতের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ ঘোষণা করেন ।

১২৯৪ এ বাঙ্গালা ও আরাকানের মিলিত বিধ্বংসী নৌবাহিনী সোনারগাঁও এর সালতানাত শিবির আক্রমন করে । গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের দক্ষিণ সীমান্তে বঙ্গজ দেবসৈন্য সুবর্ণগ্রামের দুদিকে একটি প্রতিরোধক প্রাচীন নির্মাণ করে । মেঘনা নদীর উত্তরপথে চন্দ্রদ্বীপ থেকে দেবসৈন্য অগ্রসর হয় ও সোনারগাঁও এর দক্ষিণসীমান্তে সুলতানি সেনার সাথে ভয়ানক যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের তৃতীয় দিনে চট্টগ্রামের দেবসৈন্যর সাথে বিশাল আরাকানি নৌবাহিনী একসাথে সোনারগাঁও আক্রমন করে ও সোনারগাঁও পুরোপুরিভাবে ঘিরে ফেলে । এরকম দুরবস্থায় সুলতানি সেনা পরাজয় স্বীকার করে এবং শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ সন্ধি প্রার্থনা করেন । সন্ধির শর্ত অনুযায়ী :

১) সুলতানি সৈন্য সুবর্ণগ্রাম পরিত্যাগ করবে ও সুবর্ণগ্রামে দেববংশের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে । দিল্লি সালতানাতের সীমানা করতোয়া নদীর পশ্চিম পাড় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে ।

২) বিহার-লক্ষ্নৌতির গভর্নর আরাকানের মিং কে বৃহৎ সংখ্যায় স্বর্ণমুদ্রা, অস্ত্র ও যুদ্ধহস্তী সরবরাহে বাধ্য থাকবে ।

অরিরাজদনুজমাধব দশরথদেব অধুনা বরিশাল অঞ্চলে চন্দ্রদ্বীপ নামক এক সমৃদ্ধ নগরী স্থাপন করেন, যা পূর্ববঙ্গে চিরকালীন স্বতন্ত্র হিন্দু রাজ্য হিসেবে নিজের অস্তিত্ব ধরে রেখেছিল । পরবর্তীকালে ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে দশরথদেব’র ভাই রাজা বিক্রমাদিত্য দেব রাজ্যসীমার পূর্ব অংশে রাজধানী স্থানান্তর করেন। রাজবংশের নথিভুক্ত তথ্য থেকে এই পর্যন্ত জানা যায়।

● দেববংশের শাসন ও অবদান :

বাংলায় দেববংশের অধীনে এক সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা স্থাপিত হয় । চতুর্দশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই দেবশাসনে বাংলার সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতি চরম শিখরে পৌঁছায় । দেব শাসন প্রকৃতপক্ষে ছিল শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সৃজনশীল শ্রেষ্ঠত্ব একটি নির্দিষ্ট সময়ের ছিল, তাই এই সময়কালকে মধ্যযুগীয় বাংলার ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয় ।

চন্দ্রদ্বীপের টেরাকোটা পোড়ামাটির শিল্প ও বিষ্ণুমন্দিরের বেসমেন্ট দেয়ালে প্রাপ্ত ভাস্কর্যযুক্ত ফলকসমূহ দেবযুগের দৈবিক মহিমার উৎকর্ষতা তুলে ধরে । প্রতিনিধিত্ব করে। এটি সর্বজনীন স্বীকৃত যে এই ধ্বংসাবশেষগুলি একটি একক সাংস্কৃতিক যুগের, যা দেববংশীয় শাসনকালের এবং এগুলি বাংলার লোকশিল্পের গভীরে প্রোথিত একপ্রকার বঙ্গজ শিল্পশৈলীর প্রতিনিধিত্ব করে। স্পষ্টতই এই সময়ের মধ্যে এটি এই অঞ্চলে উদ্ভূত এবং বিকাশ লাভ করে এবং ধীরে ধীরে দেশের বাকি অংশ এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ‘অশোধিত, কোমল হৃদয়ের এবং শিল্পের অপ্রতিফলিত কাজ’ হিসাবে বর্ণিত এই শিল্পশৈলীগুলি তাদের দুর্দান্ত অভিব্যক্তির গুণমানের দ্বারা ব্যাপকভাবে আলাদা। এর সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল এর সমৃদ্ধি, বৈচিত্র্য, প্রাণশক্তি এবং গতিশীলতা।

● বাণিজ্যব্যবস্থায় সমৃদ্ধি :

দেব রাজবংশের শাসনে বাঙালির বাণিজ্য উন্নতি পুনরায় নতুন উদ্যমে শুরু হয় । বস্তুত ত্রয়োদশ শতকে একাধিক যুদ্ধে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত ভেঙে পড়েছিল, এরকম দুরবস্থা হয় যে ‘কপর্দক’ কড়ি’কেও বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে হয় । কিন্তু দেবযুগে বঙ্গজ বণিককুলের বাণিজ্যযাত্রা নতুন পথে শুরু হয় ও নৌবাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার হয় । সেনযুগে সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়কে নির্বাসন দেওয়াতে বাণিজ্যের অবস্থা ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু দেববংশের শাসনে বাঙ্গালার ৩ শ্রেণীসম্বলিত চতুর্জাতি বণিককুল – সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক ও কাংস্যবণিক ‘দের সম্মিলিত সঙ্ঘের বাণিজ্যযাত্রা শুরু হয় ।

চতুর্দশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সুবর্ণগ্রাম এক সমৃদ্ধশালী বাণিজ্যনগররূপে গড়ে ওঠে। সমুদ্রপথে পশ্চিম এশীয় ও দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশ থেকে বাণিজ্য-তরী সহজেই সোনারগাঁয়ে পৌঁছতে পারত। ইবনে বতুতা (১৩৪৬) তাঁর ‘তারিখ আল হিন্দ’ ভ্রমণবৃত্তান্তে সুবর্ণগ্রামকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর-নগরী রূপে বর্ণনা করেন এবং চীন, ইন্দোনেশিয়া (জাভা) ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে এর সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। চীনের পরিব্রাজক মা হুয়ান (১৪০৬) সোনারগাঁওকে একটি বিরাট বাণিজ্যিক শহররূপে প্রত্যক্ষ করেন। হৌ-হিয়েন (১৪১৫) সোনারগাঁওকে বহু পুকুর, পাকা সড়ক ও বাজার সমৃদ্ধ একটি সুরক্ষিত প্রাচীর বেষ্টিত নগর এবং বাণিজ্যকেন্দ্ররূপে উল্লেখ করেন, যেখানে সব ধরনের পণ্যসামগ্রী মজুত ও বিক্রয় করা হতো। সোনারগাঁয়ে প্রস্ত্তত মসলিন, বিশেষত ‘খাস’ নামীয় অত্যুৎকৃষ্ট মসলিন সমগ্র বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করে। এসময় যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ সংলগ্ন এক বৃহৎ অঞ্চলে তুলো চাষের উৎপাদন অত্যন্ত বৃদ্ধি হয়, ঢাকা অঞ্চলে উন্নতমানের দীর্ঘ ও সূক্ষ্ম আঁশবিশিষ্ট তুলো উৎপন্ন হতো । ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ও তাদের শাখানদীগুলির ধারে ধারে প্রচুর কার্পাস চাষ হতো, যা সুবর্ণগ্রামের তন্তুবস্ত্রবয়ন শিল্পের প্রভূত উন্নতি ঘটায় । সুবর্ণগ্রাম, ডুমরোর, তীতবাদী, জঙ্গলবাড়ী, কাপাসিয়া প্রভৃতি বাংলার কার্পাসশিল্পের প্রধান কেন্দ্র ছিল । ঢাকাই মসলিনের রপ্তানি নৌপথে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে যা তৎকালীন বিশ্বের সর্বাধিক কাম্য বস্ত্র হিসেবে পরিগণিত হতো । শঙ্খবণিকদের পৃষ্ঠপোষণায় বিক্রমপুর ও পানাম নগরে শঙ্খশিল্প ও শাঁখার আসবাবপত্র নির্মাণে উন্নতি হয় । দক্ষ কারুশিল্পীর উদ্যোগে বাঁশ-বেত, কাঠ খোদাই, মাটি, জামদানি, নকশিকাঁথা, একতারা, পাট, শঙ্খ, মৃৎশিল্প ও ঝিনুকের সামগ্রী তৈরি হতে থাকে ।

মহানন্দা নদীর তীরে মালদহ অঞ্চলে “মুগা” ও “রেশম” মিশিয়ে ৩০ ধরনের কাপড় প্রস্তুত করা হতো । মালদহ এসময় ক্রমাগত আক্রমণবিধ্বস্ত অঞ্চল হওয়ায় মালদহের তন্তুশিল্পীরা ঢাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়, ঢাকায় এই নতুন ধরনের মিশ্রিত উপাদান বস্ত্রবয়নপ্রণালী সাধারণভাবে “মালদহী” নামে পরিচিত হয় । মালদহের ‘এলাচি’ (দু-পিঠ সমান) ও ‘মশরুর’ (সদর অন্দরপিঠ ওয়ালা) গৌড়নগরে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল, যা ঢাকার খ্যাতি বৃদ্ধি করে । বণিককুলের বহির্বাণিজ্যের উন্নতিতে বাঙ্গালার অর্থনীতি শক্তিশালী হয়, বঙ্গজ মুদ্রার মান উন্নত হয় ও বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বঙ্গসম্রাটের নামাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রার ব্যবহার শুরু হয় ।

👑● মহারাজাধিরাজ দনুজমর্দন রামনাথদেব :

মহারাজা দনুজমর্দন দেব ছিলেন বঙ্গভূমের স্বতন্ত্র নৃপতি, পরমচণ্ডীভক্ত শাক্তসাধক, বঙ্গজ কায়স্থ সমাজের গোষ্ঠিপতি এবং ৩ শ্রেণীয় অখন্ড ‘বাঙ্গালী’ নামক জাতিস্বত্ত্বার নির্মাতা। চন্দ্রদ্বীপ কুলোদ্ভূত মহাশাক্ত এই নৃপতি আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন ‘বাঙ্গালী জাতির সম্রাট’, খন্ডবিচ্ছিন্ন বিভিন্ন বঙ্গীয় প্রদেশকে ঐক্যবদ্ধ করে তিনিই পুনরায় এই গৌড়ীয় জাতিস্বত্ত্বাকে ‘বাঙ্গালী’ বলে নামাঙ্কিত করেন । দনুজমর্দন তাঁর উপাধি- দনু অর্থ অসুর, আর সে অনুযায়ী দনুজ অর্থ হলো অসুরজাত। মর্দন অর্থ ধ্বংস বা হত্যা। তিনি তৎকালীন বিহার-লক্ষ্নৌতির আসুরিক বিদেশি ম্লেচ্ছ রাজশক্তি’র উচ্ছেদ ঘটিয়ে অখন্ড বঙ্গভূমিতে স্বাধীন বাঙ্গালী জাতির শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন । গৌড়-পাণ্ডুনগর বিজয়পূর্বক রাজধানী থেকে নিজ নামাঙ্কিত “শ্রীশ্রীচণ্ডচরণপরায়ণ” খোদিত মুদ্রা প্রচলন করেন । যখন স্পেন থেকে কামরূপ পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ড ইসলামের একচ্ছত্র বিজয়যাত্রায় বিধ্বস্ত, সেই কঠিন সময়কালে সমগ্র বিশ্বের একমাত্র ‘কাফের’ বা সনাতনী হিন্দু নৃপতি হিসেবে চণ্ডীনামাঙ্কিত স্বাধীন মুদ্রা প্রচলন করতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গাধিপতি মহারাজাধিরাজ দনুজমর্দনদেব ।

● বাঙ্গালী সমাজের ঐক্যবদ্ধকরণ ও কুলীন প্রথার সংস্কার :

রাজা দনুজমর্দনদেব পালবংশীয় গৌড়েঈশ্বর পরমভট্টারক ধর্মপাল বা সেনবংশীয় বল্লালসেন’র মতোই বাঙ্গালী সমাজের কুলীন প্রথার সংস্কার করেন । এসময় বরেন্দ্রভূম ও রাঢ়ভূম থেকে অনেক ব্রাহ্মণ এসে হিন্দুরাজ্য চন্দ্রদ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ করে । রাজা দনুজমর্দনদেবের উদ্যোগে কুলীন বারেন্দ্র, কুলীন রাঢ়ি ও বঙ্গজ শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণসমাজকে একত্রিত করে তাঁদের পঞ্চপচার পূজাপদ্ধতি নির্ধারণ হয় এবং প্রত্যেক কায়স্থ ভূস্বামীগৃহে নির্দিষ্ট সমগোত্রীয় ব্রাহ্মণ যজমান নিযুক্ত হয় । মহারাজ দনুজমর্দনদেব নিজশ্রেণী বঙ্গজ কায়স্থদের সমাজ সমীকরণ করেন। বিক্রমপুর হতে সেন রাজদের পতনের পর তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘বিক্রমপুর সমাজ’ ভেঙ্গে পড়ে। বাংলার উচ্চকোটি হিন্দুদের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে দনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপে সমাজ সমীকরণ করে বঙ্গজ কায়স্থ সমাজ পুনপ্রতিষ্ঠা করেন। এ সমাজের জনপ্রিয় নাম ছিল ‘বাকলা সমাজ’। চন্দ্রদ্বীপে রাজা হয়ে দনুজমর্দন দেব বঙ্গজ কায়স্থ সমাজে গোষ্ঠীপতিত্ব লাভ করেন । দ্বিজ বাচস্পতির ‘বঙ্গজ-কুলজীসার-সংগ্রহ’এ আছে –

📜(“দনুজমর্দন রাজা চন্দ্রদ্বীপপতি ।
সেই হইল বঙ্গজ কায়স্থ গোষ্ঠিপতি ।
দেব-পদ্ধতিতে হোম মহিমা অপার ।
সমাজ করিতে রাজা হইল চিন্তাপর ।
গৌড় হইতে আনাইলা কায়স্থকুলপতি ।
কুলাচার্য আনাইয়া করাইল স্থিতি ।”)

মহারাজ দনুজমর্দনদেব নিজে ভরদ্বাজ গোত্র দেববংশীয় মৌলিক কায়স্থ শাখাভুক্ত ছিলেন ।তিনি বঙ্গজ কুলীনদের ৫/৬/৭ পর্যায় নিয়ে প্রথম সমাজ সমীকরণ বা সংস্কার করেন। ব্রাহ্মণদিগকে রাজা ‘নমস্কারা নিবেদনঞ্চ বিশেষ’ পাঠে পত্র লিখতেন এবং কুলীনদের ‘সানুগ্রহ পত্রমিদং’ ইত্যাদি লিখতেন। কোন ব্রাহ্মণ বা কুলীন রাজাকে ‘আর্দ্দান শ্রী’ এভাবে লিখতে হতো । তাঁর নেতৃত্বে বাকলা সমাজ বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ স্থান দখল করে-

📜(“চন্দ্রদ্বীপং শিরস্থান যত্র কুলীনমন্ডলং”।)

(পাণ্ডুয়াতে উৎকীর্ণ মহারাজ দনুজমর্দনদেব এর মুদ্রা, এতে বঙ্গলিপিতে উল্লিখিত “শ্রীচণ্ডীচরণপরায়ণ” ও অন্য তলে রাজার নাম ।)

●⚔️ সাম্রাজ্য বিস্তার :

মহারাজা দনুজমর্দনদেব মধ্যযুগে দিল্লি সালতানাতের আক্রমণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বাংলার বিভিন্ন ভূখণ্ড বিজয় ও একত্রিত করার নির্মাণ করেন অখন্ড ‘বাঙ্গালা সাম্রাজ্য’ । শ্রীহট্ট, চট্টগ্রাম, বঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্র আদি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল একত্রিত করে তিনি শৃঙ্খলাপরায়ণ সনাতনী শাসনব্যবস্থা স্থাপন করেন । বাঙ্গালার বিভিন্ন স্থানে দেববংশের ৭টি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল, সেগুলি হলো –

১) চন্দ্রদ্বীপ- গোবিন্দপুর,
২) বর্ধমানভুক্তি- নবহট্ট (নৈহাটি),
৩) শ্রীহট্ট- পৈড় (পৈল),
৪) ঢাকা- নবচর,
৫) মেদিনীপুর- হরিকোটি,
৬) গৌড়প্রদেশ- পাণ্ডুনগর,
৭) বীরভূম – লাটগ্রাম।

মহারাজ দনুজমর্দনদেব অত্যন্ত শক্তিশালী নৃপতি ছিলেন এবং তিনি বাঙ্গালার সৈন্যবাহিনীর উন্নতিতে বিশেষ মনোযোগ দেন । ঘটক কারিকাগণের বিবরণে দেখা যায় দনুজমর্দন রাজ্য মধ্যে দুর্গ তৈরি, অশ্বারোহী, হস্তী ও নৌ-সৈন্য বৃদ্ধি করে বাইরের আক্রমণ থেকে তিনি বাঙ্গালাকে রক্ষ করেন। বিহার-লক্ষ্নৌতির সুলতানদের চেয়ে তার নৌবাহিনী অধিক শক্তিশালী ছিল। রাজধানীর চারদিকে তিনি বৃহৎ দুর্গ নির্মাণ ও পরিখা খনন করেন। রাজধানী বাকলা শহরের সুরম্য অট্টালিকা, মন্দির ও রাস্তা নির্মাণ করেন।

● ধর্ম, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে অবদান :

চণ্ডীচরণপরায়ণ পরমশাক্ত রাজা দনুজমর্দনদেব ফুলিয়ার উগ্রতারা মন্দির ও কুমিল্লার চণ্ডীমূড়া বা লালমাই চণ্ডী মন্দিরের প্রভূত সংস্কার করেন । তিনি অগ্রদ্বীপ ও নবদ্বীপে দুটি বৃহৎ মহাকাল শিবমন্দির নির্মাণ করেন । দেবশাসনাধীন এই অঞ্চলে বিভিন্ন স্থান ব্রাহ্মণগণ এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে । নবদ্বীপ অঞ্চলে বিভিন্ন টোল ও গুরুকূলে ব্রাহ্মণগণের শাস্ত্রচর্চায় সনাতন সংস্কৃতি নবউদ্যমে বিকশিত হতে থাকে । শিখরভূম রাজ্যের কুলগুরু আচার্য পদ্মনাভ, ‘পদচন্ডিকা’খ্যাত পন্ডিত বৃহস্পতি মিশ্র, কবি কৃত্তিবাস ওঝা প্রমুখ দিকপালগণ নবহট্টে রাজা দনুজমর্দনদেবের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন । পরমভাগবত বৈষ্ণব দেববংশজাত রাজা রামনাথের পৃষ্ঠপোষণায় এখানে কৃত্তিবাস ওঝা রচনা করেন অষ্টকান্ডবিশিষ্ট ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ বা বাংলা রামায়ণ । রাজা রামনাথ দেবের শাসনাধীন বাঙ্গালা সাম্রাজ্য যা সত্যই ধর্মপ্রাণ রামরাজ্য হয়ে উঠেছিল, সেখানেই মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের বন্দনায় বাংলা ভাষায় রচিত হয় ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ ।

তিনি বাঙ্গালা সাম্রাজ্যের সীমা সম্প্রসারণে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন। বর্তমান খুলনা জেলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভুলুয়া (নোয়াখালী), মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া দখল করে, চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যভুক্ত করেন। তার রাজ্য বিজয় সম্পর্কে সতীশচন্দ্র মিত্র বলেন যে, পাঠানদের আগমনের পূর্বে খুলনার অধিকাংশ চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যাধীন ছিল।

●⚔️ রাঢ়ভূম বিজয় (১৩৭৩ খ্রি:) :

১৩৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাঢ়বঙ্গের গোপভূমের সদগোপগোষ্ঠীপতি রাজা মহেন্দ্র সিংহ গোপ, বিহার-লখনৌতির সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ’র সিপাহসালার সৈয়দ বর্মন কে পরাজিত করেন । ১৩৭১ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দিন সেকেন্দার শাহ রাঢ়বঙ্গ আক্রমন করেন, কিন্তু কৈবর্ত্যবীর হিজলিপতি রাজা হরিদাস ভৌমিক’র সাথে যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়ে পলায়নে বাধ্য হন । এসময় রাঢ়বঙ্গে একটি হিন্দু স্বাতন্ত্র্যবোধের স্ফুলিঙ্গ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । রাঢ়িয় নৃপতিবর্গ সমগ্র বাঙ্গালা ঐক্যবদ্ধ করে অখন্ড হিন্দু সাম্রাজ্য গঠনের সংকল্প গ্রহণ করেন । রাঢ়বঙ্গে সপ্তগ্রাম বন্দর (ওলায়েৎ এ সাতগাহ) এসময় ইলিয়াস শাহী সুলতানের দখলে ছিল । বঙ্গভূমির প্রতাপশালী নৃপতি মহারাজ দনুজমর্দনদেবকে অনুরোধ পাঠানো হয় রাঢ়বঙ্গ আক্রমন করে সপ্তগ্রাম মুক্ত করতে ।

সপ্তগ্রাম পুনরুদ্ধারের জন্য গোপভূমরাজ মহেন্দ্র সিংহ, হিজলিপতি হরিদাস এবং চন্দ্রদ্বীপরাজ দনুজমর্দনদেব একটি সম্মিলিত জোট গঠন করেন । ১৩৭২ এর শেষের দিকে হিজলিপতি রাজা হরিদাস সপ্তগ্রামের দক্ষিণ সীমান্ত আক্রমন করেন এবং তাম্রলিপ্ত বন্দরের নৌপথ সম্পুর্ন বন্ধ করে দেন । ১৩৭৩ খ্রিস্টাব্দের চৈত্র মাসে রাজা মহেন্দ্র সিংহ ওলায়েতে সাতগাঁ আক্রমন করে এর উত্তর সীমান্ত সম্পুর্ন বন্ধ করে দেন । এর ফলে ইলিয়াস শাহী রাজধানীর সাথে সাতগাঁর সমস্ত সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায় । এরকম বিধ্বস্ত অবস্থায় পূর্বদিকে গঙ্গানদী পাড় করে রাজা দনুজমর্দনদেব এর বিশাল নৌবাহিনী সপ্তগ্রাম আটক করে । এহেন পরিস্থিতিতে তিনদিক থেকে আক্রান্ত অবস্থায় সুলতানি শাসনের পতন হয় ও সপ্তগ্রামে দেববংশের শাসন প্রতিষ্ঠা হয় ।

রাঢ়ভূম বিজয় করে রাজা দনুজমর্দনদেব নবহট্টে (অধুনা নৈহাটি) প্রশাসনিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন । যুবরাজ মহেন্দ্রদেব তাঁর সামন্ত হিসেবে রাঢ়ভূম শাসন করতেন । হরিকোটি নৈহাটি লাটগ্রাম পৈড় নবচর এই অঞ্চলগুলিতে শাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয় । এসময় শিখরভূম রাজবংশের কুলগুরু ও রাজসভাপন্ডিত আচার্য পদ্মনাভ এসে দেবশাসনাধীন নবহট্টে বসতি স্থাপন করেছিলেন ।

●⚔️ গৌড়-পাণ্ডুনগর বিজয় (১৪১৭ খ্রি:) :

১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে ভাতুরিয়া রাজ্যের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ রাজা গনেশনারায়ণ রায়ভাদুড়ি তানোরের যুদ্ধে ইলিয়াস শাহী বংশীয় গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ’কে পরাজিত ও নিহত করে গৌড় বিজয় করেন ও ‘গৌড়েশ্বর’ উপাধিসহ বাঙ্গালার সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন । তিনি দিল্লি-জৌনপুর মিলিত সেনার আক্রমনকে পরাজিত করেন ও জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শাহ শর্কি পরাজিত হয়ে আফগানিস্তানের তিমুরিদ সুলতান শাহরুখের নির্দেশে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যান । কিন্তু রাজা গণেশের জ্যেষ্ঠপুত্র যদুনারায়ণ গিয়াসউদ্দিন আজম শাহর কন্যা আশমানতারার প্রণয়ে মুগ্ধ হয়ে ইসলামধর্ম গ্রহণ করে জালালুদ্দিন মহম্মদ শাহ নাম নিয়ে পাণ্ডুয়ার সিংহাসন দখল করেন । এর প্রতিবাদে বাঙালিসমাজে অত্যন্ত প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ও বাঙালি ভূস্বামী ও রাজন্যবর্গ মহারাজ দনুজমর্দনদেবকে পাণ্ডুনগর উদ্ধার করতে অনুরোধ করেন । ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ দনুজমর্দনদেব পাণ্ডুয়া আক্রমন করে জালালুদ্দিনকে পরাজিত করেন ও পাণ্ডুয়া দখল করেন ।

এভাবে বঙ্গভূমিতে চন্দ্রদ্বীপ-সুবর্ণগ্রাম, রাঢ়ভূমে নবহট্ট-সপ্তগ্রাম এবং বরেন্দ্রভূমিতে গৌড়-পাণ্ডুনগর একত্রিত করে মহারাজ দনুজমর্দনদেব এক অখন্ড ভৌগলিক একতা সাধন করেন এবং অখন্ড বাঙ্গালী ভূমির নাম দেন “বাঙ্গালা সাম্রাজ্য” । পাণ্ডুনগর বিজয় করে সম্রাট দনুজমর্দনদেব নিজ নামাঙ্কিত বাংলা লিপিতে ‘শ্রীশ্রীচণ্ডীচরণপরায়ণ’ খোদিত মুদ্রা প্রচলন করেন । ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতে, সেসময়ের ভারতবর্ষে পেশোয়ার থেকে কামরূপ পর্যন্ত কেবল দনুজমর্দনদেব ই একমাত্র হিন্দু নৃপতি যিনি স্বাধীন মুদ্রা প্রচলন করতে পেরেছিলেন । ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট দনুজমর্দনদেবের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সম্রাট মহেন্দ্রদেব পাণ্ডুনগরের সিংহাসনে অধিষ্ঠান করেন এবং নিজ নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলন করেন । অখন্ড বঙ্গদেশীয় ভূখণ্ড ও ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালী জাতির সম্রাট হিসেবে তাঁর নাম আমাদের ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে উল্লিখিত থাকবে ।

● তথ্যসূত্র :

১) বিক্রমপুরের ইতিহাস, শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, প্রথম খন্ড- দ্বিতীয় সংস্করণ ।

২) The Delhi Sultanate, History & Culture of the Indian People- RC Majumdar, Volume- 6

৩) বাঙ্গালার ইতিহাস, প্রথম খন্ড- রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ।

৪) গৌড়ের ইতিহাস- রজনীকান্ত চক্রবর্তী ।

৫) বর্ধমান ইতিহাস ও সংস্কৃতি- যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী ।

৬) বৃহত্তর তাম্রলিপ্তের ইতিহাস, যুধিষ্ঠির জানা ।

৭) সদগোপ কুলীন সংহিতা, শরৎ চন্দ্র ঘোষ ।

৮) বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, রাজন্য কান্ড- নগেন্দ্রনাথ বসু ।

৯) পাল সেন যুগের বংশানুচরিত, দীনেশচন্দ্র সরকার ।

১০) বাংলায় মুসলিম অধিকারের আদি পর্ব, সুখময় মুখোপাধ্যায় ।

১১) পুরুলিয়া, তরুণদেব ভট্টাচার্য ।

১২) যশোর খুলনার ইতিহাস, সতীশচন্দ্র মিত্র ।

 

(চিত্র – বঙ্গাধিপতি পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ অরিরাজ-দনুজমাধব দশরথদেব)

(চিত্রাঙ্কন : শ্রী ঋতঙ্কর দত্তচৌধুরী)

(লেখক – শ্রী স্নেহাংশু মজুমদার উদ্ভিদবিজ্ঞান স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষ। বঙ্গীয় সনাতনী ইতিহাস সন্ধানী ও প্রচারক।
সদস্য :- গৌড়ীয় ওয়ারিয়র্স)……

(সমাপ্ত)

Comment here