সেটি ১৯৩০-এর প্রথমার্ধ – বাঙ্গালী হিন্দুর উপর বিমাতৃসুলভ প্রতিহিংসা বৃ্দ্ধি হচ্ছে ব্রিটিশের ক্রমশ। ১৯৩২-এর সাম্প্রদায়িক রোদেয়াদের ফলে তৎকালীন ২৫০ আসন বিশিষ্ট অবিভক্ত বঙ্গের আইনসভায় হিন্দুর (তৎকালীন প্রদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫%) জন্য বরাদ্দ হল মাত্র ৮০টি আসন (তফসিলি-সহ) – যা প্রথমবারের মতো বাঙ্গালী হিন্দু জাতিকে ঝাঁকিয়ে দেয়। একদিকে উৎপীড়ক ব্রিটিশ, অন্যদিকে বৈরী বেরাদরদের মধ্যিখানে জাঁতাকলে পড়ে যাওয়া হিন্দুর নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ কমছে দ্রুত। ১৯৩৫-এর ভারত রক্ষা আইন ও ব্রিটিশের এহেন আচরণ যে পাকিস্তান নির্মাণের পথ সুপ্রশস্ত করছে তা বাকি ভারতবর্ষের পূর্বেই স্পষ্ট হয়েছিল এই অবিভক্ত বঙ্গভূমে।
প্রতিবাদে উত্তাল বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের প্রকাশ্য ও প্রকান্ড জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় জুলাই ১৪, ১৯৩৬-এ টাউন হলে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে, সভাপতিত্বে। মুখ্য আহ্বায়ক ছিলেন বিখ্যাত ‘প্রবাসী’ ও ‘Modern Review’ – এর সম্পাদক শ্রী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, অবিস্মরণীয় কথাসাহিত্যিক শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘Masculine Hinduism’ – এর মূল প্রবক্তা শ্রীমতী সরলা দেবী চৌধুরানী, ডঃ নীলরতন সরকার। এবং তখন অপেক্ষাকৃত তরুণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
প্রতিবাদ ধ্বণিত করে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ বলেন, “বহুকাল পর আজ আমি রাজনৈতিক সভায় যোগদান করিলাম। প্রথমে এই সভায় যোগ দিতে আমি ইতস্ততঃ করিয়াছিলাম; কিন্তু স্বদেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়া আমি আপনাদের আহ্বান উপেক্ষা করিতে পারিলাম না…।”
১৯৩৭-এর বঙ্গে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লীগ ও প্রজা-কৃষক সরকার তথাকথিত প্রগতিশীল প্রধানমন্ত্রী শেরে বঙাল ফজলুল হকের নেতৃত্বে সংস্কৃত-দুহিতা, হিন্দু-গন্ধী বাংলার পরিবর্তে আরবী ও ঊর্দু মিশ্রিত এক বাংলা ভাষার জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করলে সমস্যা গুরুতর হয়ে ওঠে। ২১শে আগস্ট, ১৯৪০ সালে প্রস্তাবিত সেকেন্ডারি এডুকেশন বিলের মাধ্যমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ হতে সেকেন্ডারি এডুকেশনকে বের করে নিয়ে যাওয়ার মারাত্মক প্রবণতা সৃষ্টি করে বাঙ্গালী হিন্দু তথা বৃহত্তর হিন্দু সমাজের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ। the noncommittal stance of Congress gave way to the fledgling Hindu Mahasabha..
ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সহসা পরিবর্তিত করে রাজনৈতিক বিন্যাস। তার ফল এত তীব্র হয় যে শেষ পর্যন্ত শ্রী শরৎচন্দ্র বসু ও শ্রী কিরণশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসও সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিন্দু রক্ষার্থে ও বঙ্গীয় আইনসভায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার সাথে একযোগে ঐসলামিক প্রাদেশিক সরকারের বিরুদ্ধে এক অনমনীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বে যে শিক্ষা রক্ষা হেতু আন্দোলন অনুষ্ঠিত হয় তার পুরোভাগে থাকেন বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, স্যার মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায়, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শ্রী নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।….
আজ ২০২২ সালে পুনরায় যখন দেখা যাচ্ছে আরবী ভাষায় পঠন পাঠনের দাবিতে ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তখন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা আশ্চর্যজনক রূপে বধির: হিন্দুর স্বঘোষিত অভিভাবক/তত্ত্বাবধায়ক বিজেপি স্থবির। আরবী ভাষায় পঠন-পাঠনের বিষয়কে কেন্দ্র করে যখন অশনিসঙ্কেত স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশ তখন বিজেপি নিশ্চল কেন এই প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক নয়। পরিস্কার ভাবে বাঙ্গালী হিন্দুর স্বার্থরক্ষাতে স্থানুবৎ ভূমিকার কারণ দর্শানোর সময় আগত। প্রশ্ন যদি আজ ওঠে এই রাজ্যে হিন্দুর প্রতিনিধিত্ব কে করে তখন যদি হিন্দুর পক্ষে দ্বিধা অনাবৃত হয় তা আদৌ সুখকর হবে কি ভবিষ্যতের জন্য? ৪০-এর দশকের হিন্দু মহাসভার আগ্নেয়, বলিষ্ঠ উত্তরাধিকারীকে সনাক্ত করতে হবে সর্বাগ্রে; শুধুমাত্র স্তোকবাক্য আর ধৈর্য কোন জাতির হিতের পক্ষে যথেষ্ট নয়।
(এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রকাশিত হবে শীঘ্রই)
শ্রী অনিমিত্র চক্রবর্তী হলেন একজন সাংবাদিক ও বিভাগীয় লেখক (columnist) এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের এক সক্রিয় কর্মী।
Comment here