-Woke Hunter
পদার্থের ঠিক কত রকম অবস্থা হতে পারে?
এইরকম পাতি প্রাইমারি শ্রেণীর প্রশ্ন আমাদের মত সাধারন পরিণত বয়স্ক অনেকের কাছেই অমূলক মনে হতে পারে।উত্তর আসতে পারে,
‘ কেন, জানো না?
তিনটে হয়।
জিজ্ঞেস করার কি আছে?’
ব্যবহারিক জীবনের কথা বাদ দিন, আমাদের পড়াশোনার বইতেও তো পদার্থের তিনটি অবস্থার বাইরে কোন আকাশ কুসুম জিনিসের কথা শুনিনি। একদম প্রাথমিক স্তরের ‘ water cycle’ ‘change of states’ থেকে শুরু করে ক্লাস টেনের থার্মোমেট্রি অব্দি, আমরা তো কম জিনিস আয়ত্ত করিনি। কই পদার্থের তিনটের বেশি অবস্থা হয় এমনটা তো কোথাও পড়িনি!। এ তো মূর্খের মতো প্রশ্ন!
কিন্তু পাঠকদের মধ্যে হয়তো বেশিরভাগ মানুষ এই প্রথমবার এটা শুনবেন যে, কঠিন তরল এবং গ্যাস এই তিন অবস্থার বাইরেও একটা চতুর্থ অবস্থায় রয়েছে যার নাম প্লাজমা। নক্ষত্র নেবুলা ইত্যাদি এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রায় ৯৯% জড়পদার্থ এই চতুর্থ অবস্থায় বিচরণ করছে; অবশ্য পৃথিবীর নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা মানুষের পক্ষে সেটা কল্পনা করা খুবই কঠিন। তার ঠিক কি কারণ তা আমরা আলোচনা করব এই আর্টিকেলের শেষের দিকে।
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক প্লাজমা বলতে আমরা কি বোঝাই।
প্লাজমা শুধু চতুর্থ স্টেট নয় তরল ও গ্যাসের পাশাপাশি এটি হলো তৃতীয় ফ্লুইড অবস্থা।
প্লাজমা এমন একটা গ্যাসীয় সংমিশ্রণ যাতে প্রচুর তড়িৎ নিরপেক্ষ (neutral) এবং আধানযুক্ত (charged) কণা একসাথে এক অস্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রায় উপস্থিত থাকে। সুবিধার খাতিরে ‘গ্যাস’ কথাটা বললেও প্লাজমার আচরণ একেবারেই ভিন্ন। তার পিছনে মূল কারণ হলো প্লাজমার দুটো প্রধান বৈশিষ্ট্য সম্মিলিত ব্যবহার (collective behaviour)এবং আপাত নিরপেক্ষতা(Quasi-neutrality)।
প্রথমে আসা যাক collective behaviour এ –
আমরা জানি যে যে কোন সাধারণ গ্যাসের কণা মোটামুটি তিনটে শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়;
প্রথম, অন্য কণার সাথে ধাক্কা
দ্বিতীয়, আন্তঃ আণবিক আকর্ষণ (intermolecular attraction)
এবং তৃতীয, মাধ্যাকর্ষণ।
কিন্তু যেকোনো প্লাজমা সিস্টেমে এই তিনটির চেয়ে অনেক বেশি বনশালী প্রভাব কাজ করে। তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্র (electromagnetism)।প্লাজমায় আধানযুক্ত কণা থাকার কারণে ইলেকট্রিক ফিল্ডের সৃষ্টি হয়। তার পাশাপাশি এইসব আধানযুক্ত কণা গতিশীল হওয়ার কারণে যে তড়িৎ প্রবাহ হয় তার সৃষ্টি করে চুম্বকীয় ক্ষেত্র (magnetic field)। অতএব আধানযুক্ত কণা Coulomb interaction এর মাধ্যমে প্রভাবিত হয় এবং তড়িৎ নিরপেক্ষ (electrically neutral)কণাগুলো চার্জড কণাগুলোর কারনে ধ্রুবীকরণের মধ্যে দিয়ে যায় এবং খুবই শর্ট রেঞ্জের কোয়ান্টাম মিথোক্রিয়ায় দেখা যায়। এইসবের সম্মিলিত প্রভাবের ফলে প্লাজমা পদার্থের সমস্ত কণাগুলো মিলে যেন একই সত্ত্বায় পরিণত হয় এবং সেরকমই ব্যবহার করে। অন্যদিকে গ্যাসের সমস্ত কণা যেন বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরে বেড়ায়। এরই নাম collective behaviour।
উদাহরণ হিসেবে সূর্যকেই দেখা যাক। সূর্য একটা প্রকাণ্ড প্লাজমা সিস্টেম ছাড়া আর কিছুই নয়। প্লাজমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সেই অকল্পনীয় রকম উচ্চ তাপমাত্রা, যা নিউক্লিয়ার ফিউশনের কারণে সূর্য উৎপাদন করতে সক্ষম। ফলে সূর্যের ভিতরে প্লাজমা পদার্থের গতিবিধি উচ্চ মানের তড়িৎ ও চুম্বকীয় ক্ষেত্র উৎপাদন করে এই collective behaviourএর মাধ্যমে। Solar wind বা সৌর বায়ু এবং Coronal Mass Ejection (CME)ক্লাউড সেই প্লাজমা চরিত্রেরই উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। প্রতি তিন চার দিন অন্তর পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের মধ্যে পৌঁছাতে থাকা সৌর বায়ু সৌর প্লাজমার বহির্মুখী প্রসারণ ছাড়া আর কিছুই নয়,যা সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। বস্তুত, সূর্যের প্লাজমা ব্যবহার নিয়ে নিরীক্ষা এবং গবেষণা করতে MagnetoHydroDynamics অধ্যায়ন করা একান্ত আবশ্যক।
এইবার আসা যাক প্লাজমার দ্বিতীয় প্রধান বৈশিষ্ট্য আপাতনিরপেক্ষতা বা quasineutrality নিয়ে।Quasineutrality এমন একটা বৈশিষ্ট্য যা প্লাজমার অদ্ভুত ব্যবহারের পিছনে অন্যতম দায়ী কারণ। একটা প্লাজমা সিস্টেমের উপর যখনই বাইরে থেকে ইলেকট্রিক ফিল্ড দেওয়া হয় বা প্লাজমার ভিতরেই যদি কোন আধান কেন্দ্রীভূত হয়ে ইলেকট্রিক ফিল্ডের জন্ম দেয় তাহলে সেটাকে অদ্ভুতভাবে একটা আস্তরণে মুড়ে দেয় প্লাসমা। এই সব ক্ষেত্রের চারিপাশে খোলসের এমন স্তর জমে যায় যাতে খোলসের বাইরে সেই ফিল্ডের প্রভাব প্রায় অগ্রাহ্য করার মতো হয়ে দাঁড়ায়। একটা প্লাজমা সিস্টেম ওপর থেকেএকদম নিউট্রাল ম’নে হলেও এর ভিতর বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় আধান কেন্দ্রীভূত হওয়া সম্ভব। কিন্তু সেই সব আধানের তড়িৎ ক্ষেত্র বেশি দূর যায় না। এরই নাম Quasi neutrality যার সহজ বাংলা অনুবাদ আপাতনিরপেক্ষতা।
এই কোয়াসি নিউট্রালিটির অত্যন্ত সাধারণ নিদর্শন হলো Debye Sheilding। ধরা যাক তড়িৎ ক্ষেত্র লাগানোর উদ্দেশ্যে একটা প্লাজমা সিস্টেমের ভিতরে দুটো গোলাকার electrodeকে ডুবিয়ে দেওয়া হলো। চোখের নিমেষে সেই দুটো ইলেক্ট্রোডের চারপাশে বিপরীত চার্জের প্লাজমা কণার একটা পুরু খোলসে সৃষ্টি হবে যে খোলসের পুরুতার (thickness)আন্দাজ করতে Debye Length নামক একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিমাণকে বোঝানো হয়। যেটা নির্ভর করবে প্লাজমাটির তাপমাত্রার উপর। প্লাজমা হওয়ার মূল শর্ত হলো এই খোলস বা Shielding এর দৈর্ঘ্য সমস্ত সিস্টেমটার দৈর্ঘ্যের তুলনায় একেবারেই নগণ্য হতে হবে যাতে সেই ইলেকট্রোডগুলোর ভোল্টেজ সামান্য দৈর্ঘ্যের মধ্যেই ব্যালেন্স হয়ে যায়। অতএব,এই Debye Length থেকেই বোঝা যায় যে এই প্লাজমার ভিতর ঠিক এই চার্জ কেন্দ্রীভূত হওয়া সম্ভব।
এই Quasi Neutralityর কারণেই প্লাজমার মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রায় চার্জ এর অত্যন্ত সামান্য অভারসাম্য খুবই সামান্য দৈর্ঘ্যের ভিতর মারাত্মক উচ্চ ভোল্টেজের জন্ম দেয়।
কিন্তু তাহলে পৃথিবীর মধ্যে প্লাজমা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর না হওয়ার কারণটা ঠিক কি হতে পারে?
এর উত্তর খুঁজতে গেলে প্রবাদপ্রতিম ডঃ মেঘনাদ সাহার সেই অনন্য Saha Equation এর শরণাপন্ন হতে হবে।
এখানে nn এবং n i হলো নিউট্রাল এবং ionised এটমের ঘনত্ব। T হলো কেলভিন স্কেলের তাপমাত্রা এবং K বলতে Boltzmann constant কে বোঝানো হয়েছে এবং U i হল ব্যবহৃত পদার্থের ionisation energy।
অতএব সাহা সমীকরণ অনুযায়ী পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা যদি300k হয়, নিউট্রাল বায়ুমন্ডলের ঘনত্ব…… যদি প্রতি কিউবিক মিটার এবং পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় থাকা নাইট্রোজেনের ionisation energy যদি আমরা U=14.5eV ধরে নিই তাহলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ionisation এর মাত্রা নগণ্য।
সুতরাং সাহা ইকুয়েশন অনুযায়ী, ionisation এর মাত্রা তাপমাত্রার সাথে বৃদ্ধি পাবে। প্লাজমা পদার্থের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতির জন্য যে রকম উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন সেটা পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভাবে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব অন্যথা পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব অসম্ভব হয়ে যেত। আবার প্লাজমায় ইলেকট্রন এবং পজিটিভ আয়নের recombination যে প্লাজমা ঘনত্ব কমার সাথে বৃদ্ধি পায় সুতরাং সেইরকম প্রয়োজনীয় কম ঘনত্বের বায়ুমণ্ডল কেবল নক্ষত্রসুলভ পরিবেশেই সম্ভব।
পদার্থবিদ্যার নিরিখে বলতে গেলে আমরা যখন কোন কঠিন পদার্থকে গরম করি, সেটা তরলে পরিণত হয়, উচ্চতর তাপমাত্রায় গরম করলে গ্যাসের উৎপাদন হয়। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে যদি আমরা অনবরত চালিয়ে যেতে থাকি তাহলে দেখব প্রায় মিলিয়ন খানিক ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উচ্চশক্তির ধাক্কাধাক্কির কারণে এটমগুলোর থেকে ইলেকট্রন গুলো আলাদা হয়ে যাচ্ছে সমানে এবং যা পড়ে থাকছে তা হলো স্বতন্ত্র ইলেকট্রন সমূহ, পজিটিভ আয়ন এবং পড়ে থাকা নিউট্রাল এটমগুলোর সংমিশ্রণ। নিউট্রাল অ্যাটম আর ইলেকট্রনের collision এর ফ্রিকোয়েন্সি আয়ন এবং নিউট্রাল অটোমের কলিশন এর থেকে বেশি হলে সেটাকে ‘fully ionised plasma’ বলা হয় আর উল্টোটা হলে ‘partially ionised plasma’ বলা হবে। আমাদের সূর্য একটা ‘fully ionised plasma’।
কিন্তু এতকিছু সত্বেও পৃথিবী পুরোপুরি প্লাজমা শূন্য নয়। একেবারে সীমিত পরিমানে হলেও প্লাজমা ঠিকই আর্টিফিশিয়াল এবং প্রাকৃতিক দুই রকম উৎস থেকে পাওয়া যায়। বায়ুমন্ডলে বজ্রপাত ছাড়াও বায়ুমন্ডলের উচ্চ স্তরে Magnetosphere এ প্রাকৃতিক প্লাজমার খোঁজ মেলে। Magnetic reconnection নামের এক বিশেষ প্রক্রিয়ার কারণে পৃথিবীর চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে পরিবর্তনের কারণে সৌর বায়ুর অনুপ্রবেশ ঘটে পৃথিবীর মেরুঘনিষ্ঠ বায়ুমন্ডলের মধ্যে। যার কারণে Aurora Borealis বা নর্দার্ন লাইটসের দেখা মেলে উত্তর মেরুর কাছে।
ব্যবহারিক এবং বাণিজ্যিক স্বার্থে আর্টিফিশিয়াল প্লাজমার ব্যবহার খুঁজে পাওয়া যায় প্লাসমা টিভি এবং পারমাণবিক গবেষণায় ব্যবহৃত plasmatron যন্ত্রের মধ্যে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্লাজমা ফিজিক্স পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা চর্চার ক্ষেত্র হলেও এর জটিলতা এবং ইন্টারনেট আর বইপত্রের থেকে প্রাপ্ত তথ্য সীমিত হওয়ার কারণে এই বিষয়টির অনেক কিছুই অপরিষ্কার মনে হতে পারে। অতএব গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলি পরিষ্কার করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে; তা সত্বেও পাঠক যদি কোন অস্পষ্টতা বা ত্রুটি লক্ষ্য করে থাকেন তাহলে তার জন্য লেখক ক্ষমাপ্রার্থী। গঠনমূলক সমালোচনা অবশ্যই গ্রহণীয় হবে।
(লেখক পরিচিতি: বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে MSc(Physics) পাঠরত)
Comment here