(আগের পর্বের লিঙ্ক)
বৈশাখ বরণ করেই এসে যায় শুক্লতৃতীয়া তথা অক্ষয় তৃতীয়া 🙂 পুরাণ মতে শুক্ল তৃতীয়ায় অজস্র শুভ কর্ম সম্পন্ন করেছিলেন দেবদেবীগণ।। তাই এহেন নির্ঘণ্ট অবশ্যই পুণ্য তিথি ☺️ অক্ষয় অর্থে যা ক্ষয়হীন, অর্থাৎ সেদিন যাহাই কর্ম তাহারই অক্ষয় প্রাপ্তি ঘটে।। দেবগৃহের দ্বারোদঘাটন থেকে শুরু করে ভিত্তি প্রতিষ্ঠা-হলকর্ষণ-দেবীমূর্তিপ্রতিষ্ঠা-হালখাতা তথা নানান শুভ উদ্বোধন আজ এমন পবিত্র লগ্নে সম্পন্ন করে থাকেন সকলে।। অতএব, এহেন শুভক্ষণে পাঁচঘরা তেও সকলে যে সজাগভাবে সংসারের অক্ষয় সৌভাগ্যকামনায় মগ্ন হবেন , বলাইবাহুল্য। ভোরের আলো গায়ে মেখে শুরু হয়ে যায় বাড়িঘর গোবরজলে নিকিয়ে পরিচ্ছন্ন করে নিত্যপুজো, কিন্তু এমনদিনে পূজার্ঘ্য ফুল-ফল-নৈবেদ্যর নিখুঁত আয়োজনে প্রস্তুত হবেই। অধিকাংশ মানুষ একসাথে দলবেঁধে যান নিকটবর্ত্তী গঙ্গার ঘাটে অক্ষয় পুণ্যস্নানে। যদিও পাঁচঘরা থেকে নিকটবর্ত্তী গঙ্গার ঘাট হল শ্রীরামপুর, তাও প্রায় ৩০ কিলোমিটার। কিন্তু গ্রীষ্মের দাবদাহ সহ্য করেই অনেকে পদব্রজে পৌঁছে যান পূণ্যতোয়া গঙ্গায়। এরপর সারাদিন রাত নানান পুজোপাঠ তো চলেই।
এ গ্রামের প্রায় ৯০বছরের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান কালীতলা বারোয়ারির চব্বিশ প্রহরব্যাপী হরিনাম সংকীর্তন, যা বৈশাখ শেষেই শুরু হয়ে যায়। সেও আমাদের বড় কাছের পার্বণ বটে, বাড়ি বাড়ী কুটুম্বজন থেকে শুরু করে মেয়ে-জামাইও এসে যায় কটাদিন কীর্ত্তন আস্বাদনে। আমন্ত্রন-অধিবাস-মাদলগান- পালাগান-রুপ-রসলীলা-আসরশেষে কৃষ্ণবেশে এক বালককে নিয়ে গ্রামের বাড়িবাড়ি ঘুরে মাধুকরী সংগ্রহ শেষে বিকেলে সংকীর্তন আসরে মানতের পুজো, মালসাভোগ তৈরীর সুনিপুণ দক্ষতা, বাতাসা ছড়িয়ে আনন্দের রেশ নিয়ে সবার চোখের জলে সাঙ্গ হয় বছরের মতো শ্রীহরিনাম সংকীর্তন। ছেলেপিলেদের এইসময় প্রতিটা দিন অন্যান্য কাজের সাথে যুক্ত হয় রোজ ভোরে ফার্স্ট ট্রেনে কলকাতার ফুলবাজার থেকে টাটকা ফুল কেজি কেজি কিনে আনা এবং রাতজাগা ভক্তবৃন্দ এবং কীর্ত্তনীয়াদের গোলাপ জল ছিটিয়ে দেওয়া, যদি খানিক আরাম তাতে পান সমস্ত রাতজাগা মানুষগুলো। এ আসরের একটি সবিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো শুরু থেকে অর্থাৎ ৯০টা বছর ধরেই রাধাকৃষ্ণের বেশে মাদলগান। প্রায় পড়শী কোনো গ্রামেই এই মাদলগানের কদর বা রেওয়াজ নেই, কিন্তু পাঁচঘরা অক্ষুণ্ন রেখেছে এইধারা। এবং যে কথা না বললেই নয়, কিছু কীর্ত্তনের দল বহুদূর থেকে আসেন, দুদিন তিনদিন একসাথেই পালাগান থাকলে সে কটাদিন রয়ে যান। প্রশ্ন হলো থাকবেন কোথায়! নিস্তরঙ্গ গ্রাম্য সারল্যের উদারতা তো এখানেই, প্রায় সব বাড়ির মানুষরা বারোয়ারিতে যেচে পড়ে বলে যান “দলের থাকার জন্য আমার বাড়ির কথা ভুলবেন না, ওই কটা দিন অতিথি হয়ে দলেরা আমার বাড়িতেই থাকবেন এবং খাওয়াদাওয়া করবেন”! একবাক্যে একটা দুটো নিজেদের ঘর তখনকার মতো অতিথি কীর্ত্তনীয়ার দলকে ছেড়ে দেন। ধন্য এই সারল্য,বেচেঁ থাকুক এমন বাংলার ঘর।
জৈষ্ঠ্যমাসে অরণ্য ষাট /
ফিরে ঘুরে এলো ষাট /
বার মাসে তের ষাট /
ষাট ষাট ষাট /
ঝি চাকরের ষাট /
গোরু বাছুরের ষাট /
কর্তার ষাট , ছেলেমেয়ের ষাট /
বউ ঝিয়ে ষাট, নাতিনাতনির ষাট /
ষাট ষাট ষাট ” !!
ব্যাপারখানা কী হলো!! আর কী মশাই, এবার তো এসেই গেল জৈষ্ঠ্যের শুক্ল ষষ্ঠী তিথি, বলি মেয়েজামাই বরণ হবে যে, চাট্টিখানি কথা নাকি! পালাগান শেষ হলো তো এসেই গেল “জামাইষষ্ঠী”! সেতো নতুন জামাইদের খুউউউব আদর আপ্যায়ন, তাই বলে বাপু অন্য জামাইগণ কোণঠাসা নাহে। মালকোচা দিয়ে ধুতি পরে জামাইগণের আগমন না হয় কমে গেছে তাই বলে কই সবই বাদ!! না না।। হাতে মিষ্টির হাঁড়ি, অন্য হাতে শ্বশুরবাড়ির সবার জন্য সাধ্যমতো কিছু উপহার অবশ্যই এনে হাজির হন যুগলে। এরপর আরকি, শুরু হলো জামাই আদর, কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে আমকাঁঠালের বাটা দিয়ে হইহই করে ঘরে তোলে মেয়ে জামাইকে। নাহ দিনবদল হচ্ছে এদিক পানেও, মেয়ে বলে তার ভাগে আদর নেই এমন কুপ্রথা আর নেই। এবার তো শুরু হলো একে একে বাড়ির গাছের সেরার সেরা আম-জাম-কাঁঠাল লিচু সাজানো একেকটা কাঁসার থালা। মন্ডা মিঠাই তো রইবেই, সাথে জলযোগে উঠোনের গন্ধরাজ লেবুর রসযুক্ত কুয়োর ঠান্ডা পানীয়। রোসো মশাই রোসো, মধ্যান্হ ভোজন তবে?? হাট থেকে আনা সেরা রুইকাতলার কালিয়া, শিলেবাটা পোস্ত দিয়ে পাঁচমিশেলি শাকভাজা, মুড়িঘণ্ট, কচিপাঁঠার ঝোল, কলাপাতায় ডুমোডুমো করে কাটা আলুভাজা সমেত চৌঁষট্টি ব্যঞ্জনের সমাহার। উদরসাৎ করে কোনোরকমে দুপুর পেরোতেই এবার দই-চিঁড়ে-কলা, উফফ বাপু প্রতি বাড়ির জামাইষষ্ঠীতে এ লিষ্টি খুউউব কম। বস্তুত জৈষ্ঠ্যের এই শুক্লষষ্ঠী আসলে মেয়েজামাইসমেত অনাগত সন্তানের মঙ্গলকামনায় দেবী ষষ্ঠীর উদ্দেশ্যে পুজো দিয়ে মেয়েরবাড়ীর ব্রত পালনের সঙ্গে তাদের আদর আপ্যায়ন।
এ ষষ্ঠী অরণ্যষষ্ঠী নামেও পরিচিত এবং অরণ্যে পূজিত কিন্তু এ গ্রামে এপূজার চল একেবারেই নেই।
গ্রীষ্মের এসব পাব্বণ সমেত সমাপ্তি ঘটে এসে যায় ঋতুবদলে ঘনমেঘে কালোকরা আষাঢ়মাস, আর কথায় তো আছেই,
“কীসের বার কীসের তিথি,
আষাঢ়ের সাত অম্বাবতী”!!
আজ্ঞে হ্যাঁ অম্বুবাচী তিথি, তবে গ্রামে আলাদা করে এ তিথিতে উৎসব না হলেও যেমন নিয়ম ভূমিকর্ষণ, চাষাবাদ, দেবদেবীবিগ্রহ স্পর্শ বন্ধ থাকে। তবে উৎসব নাই বা হলো, নিষ্ঠায় কোনো কমতি নেই। এতেই বিশ্রাম নয় যে, আষাঢ়ের বর্ষামঙ্গলে “বিপত্তারিণী ব্রত”, “মনোরথ দ্বিতীয়া ব্রত”, ” ষটপঞ্চমী ব্রত”সমেত রয়েছে নানান ব্রতপালনের লোকবিশ্বাস। আষাঢ়ের শুক্ল তৃতীয়া থেকে নবমী তিথির মধ্যে শনি বা মঙ্গলবারে ঘটস্থাপন করে তাতে আম্রপল্লব দিয়ে, সারাদিন উপোস করে নৈবেদ্য, তেরো ফুল-ফল, তেরোগাছা লালসূতো, তেরোটি পান-সূপারী সমেত কায়মনোবাক্যে পুরোহিতদ্বারা পুজো করে সম্পন্ন করেন সংসারের সবার মঙ্গলকামনায় বিপত্তারিণী ব্রত।
এই মূহুর্তে যে বিপত্তারিণী মায়ের কৃপা আমাদের সব্বারই একান্তভাবে দরকার।
সবার মঙ্গল ও সারা পৃথিবীর সুস্থতা কামনা ক’রে আজ এই পর্যন্তই রাখলাম।
রথের গল্প নিয়ে আসব এর পরের পর্বে
চিত্র সৌজন্য: Flickr
রবীন্দ্রসংগীত ও কত্থক নৃত্যশিল্পী, কথাসাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও আকাশবাণীর ঘোষিকা। .দেশজ জীবনশৈলীর একনিষ্ঠ ধারক।
Comment here