বাঙালী মাত্রই আড্ডাবাজ — আড্ডা দিতে পারলে সে আর কিছু চায়না যেকোনো অবস্থায় নানারকম বিষয় নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তুলতে সেওস্তাদ।এসব আড্ডা সবসময় যে নিছক গল্পগুজবের জন্যই দেওয়া হয় তা কিন্তু নয়। বাঙালি মননশীলতার কতই না দিক উন্মোচিত হয় এইসব আড্ডায়। আর সেই আড্ডা যদি হয় লেখকদের তাহলে তো কথাই নেই। একবার দৃশ্যটা কল্পনা করা যাক। বেশ কয়েকজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক বসে আড্ডা মারছেন। কখনো সেই আড্ডা পত্রিকার সম্পাদকের টেবিলে, কখনো আবার কোনো পত্রিকা দফতরে। হয়তো সুকুমার রায় আড্ডায় মেতেছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে, কিংবদন্তী সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সঙ্গে মুড়ি তেলেভাজাসহ খোশগল্প চলছে বিমলমিত্রর। এমনই কিছু সাহিত্য আড্ডার হাল হকিকত খোঁজবার জন্য কলম ধরা।যেসব পাঠক পাঠিকা দারুন আড্ডাবাজ তাঁরা তো আড্ডা মারতেই অভ্যস্ত আর যাঁরা আদপেই আড্ডাবাজ নন তাঁরাও আমার সঙ্গে সাহিত্যিকদের আড্ডায় চলুন।
শুধু আমাদের এখানে বাঙালি সাহিত্যিকই নন। পাশ্চাত্য দেশে ও সাহিত্যিকদের উপস্থিতিতে গড়ে উঠেছিল আড্ডার পরিমন্ডল। প্রথমেই উল্লেখ করতে হবে ডক্টর জনসনের কথা। অষ্টাদশ শতকে এই ভদ্রলোককে মধ্যমণি করে লন্ডনে আড্ডা জমে উঠেছিল। ইংল্যান্ডের জাতীয় জীবনকে আলোকিত করে রেখেছিলেন তাঁরা সকলেই ছিলেন এই আড্ডার সদস্য। প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট,বাগ্মীশ্রেষ্ঠ এডমান্ড বার্ক,শিল্পীশেষ্ঠ স্যার জসুয়া রেনল্ডস,কবি গোল্ফস্মিথ,শেক্সপীয়ারের বিভিন্ন নাটকের সুদক্ষ অভিনেতা গ্যারিকএই আড্ডায় নিয়মিত আসতেন।
লেক পোয়েটস নামে বিখ্যাত ছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোল্ডরিজ,সাদে – এই তিনজন কবি।। এই তিন কবিই ইংল্যান্ডের লেকসংলগ্ন অঞ্চলে বসবাস করতেন।ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং কোল্ডরিজ লণ্ডনের বাসভবনে এলে তাঁদের ঘিরে সেখানে আড্ডা বসতো।এই আড্ডার বিশিষ্ট দুই সদস্য ছিলেনচার্লস ল্যাম্ব ও হ্যাজলিট। লন্ডনের একটি বিখ্যাত অঞ্চলের নাম ছিল ফ্লিটস্ট্রিট। এই রাস্তায় চেশায়ার চিজ নামে একটি ন রেস্তোরাঁ রয়েছে। ওই রেস্তোরাঁতে ডাবলিউ বি ইয়েটস এবং আর্নেস্ট রীজ- এই দুজন বন্ধুর উদ্যোগে একটি আড্ডার পত্তন হয়। এই আড্ডায় যাঁরা উৎসাহী ছিলেন তাঁদের মধ্যে লায়নেল জনসন,আর্নস্ট ডাওসন,জন ডেভিনসন,আর্থার সাইমনস,প্রমুখ অন্যতম।ব্লুমসবেরি গ্রুপ এরকম আরো একটি আড্ডাস্থল। এই গ্রুপে যে সব কলমচি আড্ডা মারতে আসতেন করতে তাঁদের মধ্যে ই এম ফরস্টার, লিটন স্ট্রাচি,ক্লাইভ বেল,অর্থনীতিবিদ কিনস, ভার্জিনিয়া উলফ অন্যতম। এছাড়াও বার্টান্ড রাসেল,অলডাস হাক্সলে,টি এস এলিয়ট এই আড্ডায় প্রায়শঃ যোগদান করতেন।
এবার চোখ ফেরাই বাঙালি সাহিত্যিকদের আড্ডার দিকে। যে মানুষটিকে ছাড়া কোনো আলোচনাই সুসম্পূর্ণ হয় না তিনি রবীন্দ্রনাথ। তাই বাঙালি সাহিত্যিকদের আড্ডা কথায় রবীন্দ্রনাথ থাকবেন না তা কি হয়? জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খামখেয়ালি সভা।গান, বাজনা সাহিত্য কি না আলোচনা হত সেখানে। খামখেয়ালীর সদস্যরা কখনো নিজের নিজের বাড়িতে, আবার কখনো ঠাকুরবাড়িতেআড্ডার আসর বসাতেন। খামখেয়ালির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন,মনোমোহন ঘোষ,মহিমচন্দ্র বর্মা। জানা যায় রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্প ক্ষুধিত পাষাণ, মানভঞ্জন ও নাটক বৈকুন্ঠের খাতা পাঠ করেছিলেন। আড্ডায় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও প্রমথ চৌধুরী আসতেন। খামখেয়ালী সভার ব্যবস্থাপনা সামলাতেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রথীন্দ্র নাথ ঠাকুর।সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়এর কাঁঠাল পাড়ার বাড়িতে বসতো আড্ডা।সেই আড্ডার প্রধান আকর্ষণ ছিলেন সাহিত্যসম্রাট সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সেই আড্ডায় অল্প বয়সে যাতায়াত করতেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
(ক্রমশ)
– পেশাগতভাবে সরকারী কর্মী, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েই বাঁচেন, লেখলেখির মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত।
আড্ডা মারতে যারা ভালোবাসে তাদের কাছে পূর্বসূরিদের কথা তো সুস্বাদু মিষ্টান্নের মতোই মনে হবে । এবং আড্ডায় মজে যাওয়ার জন্য দুচারটি মহফিলে প্রবেশাধিকার দিলে আরও ভালো লাগতো।
[…] পর্বের […]