আঙিনাশাশ্বত সনাতনসংস্কৃতি

ব্রাহ্মণ

– শ্রী বেণু গঙ্গোপাধ্যায়

 

বশিষ্ঠের তপোবনে একদিন নিরজনে প্রবেশেন বিশ্বামিত্র ঋষি।

নয়ন অনল জ্বলে, সিদ্ধকাম তপোবলে, সেই গর্ব আছে অঙ্গে মিশি।

ব্রহ্মা দিয়াছেন বর আর আছে কারে ডর, পদানত ভয়ে ঋষি, মুনি।

এত যদি হ’ল তবে বশিষ্ঠে দেখিতে হবে, কিসে তিনি তাঁর চেয়ে গুণী?

সৌম্য শান্ত তপোবন, আসিলেন তপোধন, বশিষ্ঠ আছেন যেথা বসি,

বিহরিছে মৃগকুল, বিকশিত কত ফুল, গগনে শোভিছে রাকা শশী।

বলিলেন দৃঢ় স্বরে, ‘হয়েছি ব্রহ্মার বলে দুর্লভ দ্বিজত্ব অধিকারী,

সবি আজ হস্তগত, ষড়রিপু পদানত, আমি পূত যজ্ঞসূত্রধারী।

স্বীকার করুন মোরে, নহে তপঃতেজ-জোরে প্রলয় ঘটাব পুনঃ আজি’

বশিষ্ঠের ওষ্ঠ নড়ে গভীর আবেগভরে, কম্বুকণ্ঠ ধীরে উঠে বাজি –

‘ব্রাহ্মণের গুণপনা যাঁর নাই এককণা, কেমনে ব্রাহ্মণ তাঁরে ধরি?’

বিশ্বামিত্র গর্জি উঠে, নয়নে অনল ছুটে, রোষে অঙ্গ কাঁপে থরহরি।

শপথ করিয়া কন, ‘শোন তবে হে ব্রাহ্মণ, মারণ যজ্ঞের হও হোতা।

করি যজ্ঞ অভিনব মস্তক খসুক তব, শোনে নাই যাহা কেহ কোথা।  

 

বশিষ্ঠ ‘তথাস্তু’ বলি ধীর পদে গেল চলি। বিশ্বামিত্র ভাবিল বিস্ময়ে,

নিজমৃত্যু কথা শুনি কোন গুণে হয়ে গুণী মুখ ম্লান হইল না ভয়ে।

যজ্ঞকুণ্ড উঠে জ্বলি – হায়, একি হ’ল বলে কাঁদে লোক তপোবন ঘিরে,

হস্তে কমণ্ডলু ধরি, বশিষ্ঠ গায়ত্রী স্মরি’ যজ্ঞভূমে প্রবেশেন ধীরে।

যজ্ঞ করি বিধিমত উচ্চারিয়া মন্ত্র যত পূর্ণাহুতি দিতে উঠে হোতা,

হাতে মুখে ঢাকে সবে, বীভৎস দেখিতে হবে, অঙ্গুলি কানেতে দেয় শ্রোতা।

প্রথম আহুতি হলে বিশ্বামিত্র পুনঃ বলে, এখনো বলুন মোরে দ্বিজ,

তা না হলে মাথা খসি যাবে হোমানলে পশি – বৃথা বাহিরিবে প্রাণ নিজ।’

হাসিয়া বশিষ্ঠ কন, ‘যে জন ব্রাহ্মণ ন’ন, কেমনে ব্রাহ্মণ বলি তাঁরে?

প্রাণ তুচ্ছ বলে মানি, সত্যই শাশ্বত জানি, মৃত্যু ধ্রুব অনিত্য সংসারে।’

এত বলি মন্ত্র পড়ি পাত্রে ঘৃত-অর্ঘ্ ধরি ব্রহ্মর্ষি আহুতি দেন পুনঃ।

বিশ্বামিত্র মূঢ় প্রায় বশিষ্ঠ সমীপে ধায়, বলে, ‘প্রভু নিবেদন শুন।’

 

সময় বহিয়া যায় – যজ্ঞ শেষ হ’ল প্রায়, শেষ আহুতির লগ্ন আসে,

বশিষ্ঠের পায়ে পড়ি বিশ্বামিত্র গড়াগড়ি দিয়ে নয়নের জলে ভাসে।

উদাত্ত সহজ স্বরে বশিষ্ঠ প্রচার করে, ‘ওঠ, ক্ষমা-সুন্দর, ব্রাহ্মণ,

গেছে দম্ভ, অভিমান, প্রেমে, ক্ষেমে পূর্ণ প্রাণ – ত্যাগ, তিতিক্ষায় ভরা মন।”

Comment here