সংস্কৃতি

কলমচিদের আড্ডাখানায়-৯

(অষ্টম পর্বের পর)

কালিঘাট ট্রামডিপো যেখানে ঠিক তার উল্টোদিকে একটি ছোট্টো চায়ের দোকান ছিলো। সেই দোকানে বসতেন দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী,বিমল মিত্র, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।চায়ের দোকানের এই আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়।তিনি তাঁর নানাধরনের অভিজ্ঞতার গল্প বলতেন সকলের কাছে।সাগরময় ঘোষ তাঁর ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ গ্রন্থে এই বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় বা বিশুদাকে অমর করে দিয়েছেন।

শ্রী রাধাপ্রসাদ গুপ্ত বা শাঁটুলবাবুর কথা না লিখলে কলমবাজদের আড্ডার গল্প রয়ে যাবে অসম্পূর্ণ।এই মানুষটি ছিলেন আড্ডাবাজ।তাঁর সঙ্গে কারা কারা আড্ডা মারতেন?সেই তালিকাটিও বেশ উল্লেখ করার মতো। সত্যজিৎ রায়,পৃথ্বিশ নিয়োগী,বংশী চন্দ্রগুপ্ত,হরিসাধন দাসগুপ্ত,চিদানন্দ দাসগুপ্ত, সুভাষ ঘোষাল,কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়,প্রতাপ রায় প্রমুখ। মাঝে মাঝে চলে আসতেন ভাস্কর প্রদোষ দাসগুপ্ত,চিত্রকর পরিতোষ সেন,শুভো ঠাকুর। কুমার প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে পাই যে তাঁর কচি কলাপাতা রঙের এংলিয়া ফোর্ড গাড়িটি চল্লিশের দশকে ডালহৌসি স্কোয়ারে পাক খেতো।ব্যাংকশাল কোর্ট স্ট্রিটের ওয়াল্টার টমসন থেকে বের হতেন রাধাপ্রসাদ গুপ্ত। ১ নং কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট থেকে আসতেন সত্যজিৎ রায় ও চিদানন্দ দাশগুপ্ত। তাঁরা চলে যেতেন চৌরঙ্গীর কফি হাউসে। সেই আড্ডায় আলোচনার বিষয় হয়তো কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির পত্তন বা রেনোয়াঁর সিনেমা। কে বলতে পারে এই আড্ডাই হয়তো পথের পাঁচালী চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন সত্যজিতের চোখে এঁকে দিয়েছিল।

দক্ষিণ কলকাতায় কবিশেখর কালিদাস রায়ের বাড়িতে আরেকটি আড্ডা বসতো।সেই আড্ডার নাম ছিলো রসচক্র।কালিদাস রায়ের ছোট ভাইয়ের নাম ছিলো রাধেশ রায়।তিনি ছিলেন রসচক্রর মধ্যমণি। একজন অন্যতম সদস্যর নাম ছিল বিশ্বপতি চৌধুরী।রসচক্রর সদস্যরা নিয়মিত বনভোজন করতেন। তাঁরা একবার কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করেছিলেন। কবিশেখর কালিদাস রায় ছাড়া অন্যদের মধ্যে ছিলেন সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়,হেমেন্দ্রকুমার রায়, নরেন্দ্র দেব,অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধকুমার সান্যাল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। সংবর্ধনাসভায় নজরুল গিয়েছিলেন গান,’ তুমি কোন পথে এলে হে মায়াবী কবি বাজায়ে বাঁশের বাঁশরী’।রসচক্রের আসরে মাঝেমাঝে বসতো গানের আসর।সেসময়কার নামকরা শিল্পী হরিপদ চট্টোপাধ্যায় অসম্ভব দরদ দিয়ে গান করতেন। সেখানে উপস্থিত কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরতো।রসচক্রের আসরে আহারপর্ব মিটে যাওয়ার পর সকলে বাগানে বেড়াতে বের হলেন।তখন সাহিত্যিক মনোজ বসুর বই প্রকাশ পেয়েছে ও সমাদৃত হয়েছে। কালিদাস রায় বললেন,
– হ্যাঁরে তুই তো বনজঙ্গল নিয়ে লিখিস। নিজেকে বলিস গাঁয়ের ছেলে। বাতাবি লেবু পাড়তে পারিস?
মনোজ বসু তৎক্ষণাৎ জামা খুলে, ধুতি গুটিয়ে অসংখ্য কাঁটাতারকে তোয়াক্কা না করে বাতাবি গাছে উঠে গেলেন ও বাতাবিলেবু পেড়ে আনলেন। মুখের মতো জবাব হলো।

একবার সাহিত্যিক অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়ের সংবর্ধনা সভায় বিশ্বপতি চৌধুরী বললেন যে তিনি কবি হরেন সিংহকে মানপত্র দেবেন।দেখা গেলো যে ফটো তোলার সময় কবি হরেন সিংহর পিছনে দি গ্রেট বিশুদা অর্থাৎ বিশ্বপতি চৌধুরী একটি বড় কচুর পাতা ধরে রয়েছেন।
মৌচাক পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক সুধীরচন্দ্র সরকার হলেও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন এই পত্রিকার মধ্যমণি।মৌচাকের আড্ডায় যাঁরা নিয়মিত আসতেন তাঁদের মধ্যে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্রদেব,গিরিজাকুমার বসু, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ছিলেন অন্যতম।

(ক্রমশঃ)

Comment here