বিশ্বপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ পরাধীন ভারতবর্ষের শৃঙ্খল মুক্তির যে বাণী বিপ্লব তপস্বী শ্রীহেমচন্দ্র ঘোষকে প্রদান করেছিলেন, পরবর্তীকালে সেই মাতৃমন্ত্রে দীক্ষিতদের মধ্যে অন্যতম বিপ্লব সাধক ছিলেন শ্রী সত্যরঞ্জন বক্সী। দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্রের মাতৃবন্দনা্ ও রাজনৈতিক গণ মাধ্যম পরিচালনার নির্ভরযোগ্য সেনাপতি ছিলেন শ্রী সত্যরঞ্জন বক্সী। পূর্বতন অখণ্ড বঙ্গের পূর্বাংশে, বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বাথি গ্রামে [ পিতা শ্রী বসন্ত কুমার বক্সী এবং মাতা শ্রীমোক্ষদা সুন্দরী বক্সী] ১৮৯৭ সালের ১৬ই জুলাই জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজী সাহিত্য ও বি.এল উত্তীর্ণ শ্রী সত্যরঞ্জন বক্সী ‘মুক্তি সংঘ’ থেকে বৈপ্লবিক বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁর বিপ্লবী কর্মধারাকে সংগঠিত করেছিলেন। দেশবন্ধুর আহ্বানে তিনি ফরওয়ার্ড প্রত্রিকার প্রথমে সহ-সম্পাদক ও পরে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন, সাল ১৯২৪ -২৯। ফরওয়ার্ড পত্রিকাতেই রাষ্ট্রদ্রোহী (সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের মানদণ্ড অনুযায়ী) প্রবন্ধ লেখার জন্য তিনি প্রথম কারাদণ্ড ভোগ করেন, স্থান পান প্রেসিডেন্সি জেলে, ১৯৩১ সালে লিবার্টি-পত্রিকাতে প্রতিস্পর্ধী (এবারেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ) লেখার জন্য প্রায় দেড় বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন।
১৯৩২-৩৮ সালের মধ্যে তিনি বিনা বিচারে ডেটিনিউ ছিলেন বক্সা ও দেউলি জেলে। ১৯৪০ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্সী জেলে নিরাপত্তা বন্দী হিসাবে আটক থাকেন। এর পর সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধানের পর ১৯৪২-এর মে মাস থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বিনা বিচারে কারারুদ্ধ হন এবং অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন ভোগ করেন। প্রথমে লালকেল্লার ভূগর্ভ সেল-এ, পরে নৈনী জেল হয়ে প্রেসিডেন্সি জেলে স্থানান্তরিত হন।
১৯৩৮-৩৯ সালে এডভান্স এবং ১৯৪৮-এ United Socialist Organization -এর সেক্রেটারি ও ‘ The Nation’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের বৈপ্লবিক ত্রয়ী বিনয়-বাদল-দীনেশ’–কে স্মরণ করে তিনি লিখছেন –আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে। এই ডাক শুনেছি জীবনের প্রথম ঊষায়, জগতের প্রাণ সঞ্চারে। …… জননী জাগুক, নয়ন খুলে করুক নূতন জীবন লাভ। মনে প্রাণে, শারীরিক উৎকর্ষে, অন্তরের সাধনায়, মন্দির দ্বারে এই প্রত্যাশা আজ উজ্জ্বল হউক–এই প্রত্যাশায় এ ধূলায় রাখিনু প্রণতি।”
১৯৪৯ সালের ২৩শে জানুয়ারি ‘The Nation’ পত্রিকায় তিনি SUBHAS-ISM শিরোনামে বহু প্রবন্ধে সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও তার প্রায়গিক দিকগুলির নিয়ে আলোচনা করেন। শ্রী সত্যরঞ্জন বক্সী ছিলেন সত্যের পূজারী, দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের সংগ্রামে তাঁর নির্ভীক সাংবাদিকতা শুধু সেযুগেই নয় সর্বযুগে সর্বকালের জন্য ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম ছিল আপোষহীন। স্বাধীনতার পর নেহেরু তাঁকে উপ-রাষ্ট্রপতি পদে যোগদানের জন্য আহ্বান করেছিলেন, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। সংকল্পে দৃঢ় এবং বিশ্বাসে অটল এই মহান ত্যাগী বিপ্লবী তাঁর সমগ্র জীবনকেই বিপ্লবের সাধনার কৃচ্ছতাকে স্বচ্ছায় বরণ করেছিলেন। তাঁর বিপ্লব সাধনা ছিল সমগ্র মানবজাতির মুক্তি সাধনা। তাঁর সাধনা ছিল পরিপূর্ণ জীবনব্যাপী অব্যাহত ছিল। কেননা মানুষের মুক্তি সংগ্রামের সাধনা সর্বকালে সর্বযুগেই তা চিরন্তন, তা শাশ্বত।
এই মহান ত্যাগী বিপ্লব সাধককে আমাদের প্রণাম-শ্রদ্ধা।
জয় হিন্দ, বন্দেমাতরম্।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা –এই লেখাটির জন্য ডঃ নিশীথরঞ্জন রায়, ডঃ শঙ্করীপ্রসাদ বসু ও শ্রী সত্যেন চৌধুরী সম্পাদিত ‘রাখাল বেণু’ প্রকাশিত ‘সত্যরঞ্জন বক্সী’ সঙ্কলন গ্রন্থের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এই গ্রন্থটি দিয়ে সাহায্য করেছেন শ্রীশুভাশিস চৌধুরী।
প্রত্নতত্ত্ববিদ, গবেষক ও সমাজকর্মী। । এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সক্রিয় কর্মী।
Comment here