প্রবাসী ৪৬শ ভাগ, ১ম খণ্ড{আশ্বিন, ১৩৫৩} ৬ষ্ঠ সংখ্যা
কলিকাতায় লীগের “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম”
কলিকাতায় লীগের “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম” উপলক্ষ্যে যে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন ও অগ্নিদাহ হইয়া গিয়াছে, আধুনিক জগতের ইতিহাসে তাহার তুলনা মেলা ভার। ২৯শে জুলাই বোম্বাইতে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের অধিবেশন হয় এবং ঐ অধিবেশনে মন্ত্রী-মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া লীগ যে সিদ্ধান্ত করিয়াছিল তাহা প্রত্যাহার করিয়া “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম” ঘোষণা করা হয়। সংগ্রাম আরম্ভ করিবার জন্য ভারতের সর্বত্র ১৬ই আগস্ট তারিখ সংগ্রাম দিবসরূপে ঘোষিত হয়। সিভিল ওয়ারের ভয় দেখানো চলিতে থাকে এবং বিশেষভাবে হিন্দু ও জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের বিরুদ্ধেই বিষোদ্গার আরম্ভ হয়। ব্রিটিশ গবর্মেন্টের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিবার কথা হইলেও উহা যে প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধেই আরম্ভ হইবে কয়েকদিনের মধ্যেই লীগ-নেতাদের বক্তৃতা ও বিবৃতি এবং লীগ পরিচালিত পত্রিকাসমূহের মন্তব্য হইতেই সুষ্পষ্ট হইয়া ওঠে।
বাংলার ও সিন্ধুতে লীগ-মন্ত্রীসভা বিদ্যমান। এই দুই মন্ত্রিসভা ১৬ই আগস্ট সরকারী ছুটি ঘোষণা করেন। সিন্ধুর গবর্ণর লীগের পরম অনুরক্ত হইলেও তিনি ঝুনা সিভিলিয়ান, ছুটির তাৎপর্য তিনি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছিলেন। দাঙ্গা বাধিতে দেওয়ার ইচ্ছা তাঁহার ছিল না বলিয়া তিনি ছুটি ঘোষণার আপত্তি করেন এবং সিন্ধুর চীফ সেক্রেটারীর কর্তব্যবোধ লীগ-প্রীতির নীচে একেবারে তলাইয়া যায় নাই বলিয়া তিনি ছুটি বাতিল করিয়া দেন। এই অপমান হেদারতুল্লা মন্ত্রিসভা নীরবে পরিপাক করিতে বাধ্য হন। বাংলার গবর্ণর নবাগত। তাঁহার পরামর্শদাতা সিভিলিয়ান কর্মচারী বা মন্ত্রি কাহারও মধ্যেই কর্তব্যপরায়ণ লোক নাই, কাজেই সুপরামর্শের অভাবে এবং অনভিজ্ঞতার দরুন তিনি ছুটি মঞ্জুর করিয়া বাংলায় অশান্তির আগুন জ্বালাইবার পথ করিয়া দেন। বাংলায় জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ এবং সংবাদপত্রসমূহ সুরাবর্দী মন্ত্রীসভার উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়া এই ছুটির তীব্র প্রতিবাদ করেন। আইন-পরিষদের ইংরেজ নেতাও উহার বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করিয়া ছুটি বাতিল করিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু শুভ পরামর্শ মন্ত্রীরা শুনিলেন না। ১৬ই আগস্টের “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম” উপলক্ষে দাঙ্গা বাধাইবার জন্য লীগ বহু পূর্ব হইতেই প্রস্তুত হইতেছিল। লীগ-নেতাদের বক্তৃতা ও বিবৃতি এবং লীগ-পত্রিকাসমূহের মন্তব্য হইতে প্রয়োজনীয় অংশ উদ্ধৃত করিয়া দৈনিক “ভারত” তাহা প্রমাণ করিয়াছেন। লক্ষ লক্ষ উত্তেজনাপূর্ণ প্রচারপত্রও বিলি করা হয়। একটি উর্দ্দু পুস্তিকায় লেখা হয় –“এই রমজান মাসে ইসলাম এবং কাফেরদের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য যুদ্ধ আরম্ভ হয়। এই মাসেই মুসলমানেরা জেহাদ ঘোষণার এবং কাফের হত্যার অনুমতি লাভ করে। এই মাসেই ইসলাম বিজয়গৌরবে ভূষিত হয়। এই রমজান মাসেই আমরা মক্কায় জয়লাভ করি এবং পৌত্তলিকুদের নিশ্চিহ্ন করিয়া দেই। এই মাসেই ইসলামের বনিয়াদ স্থাপিত হয়। আল্লার পাকিস্থান লাভের উদ্দেশ্যে জাহাদ আরম্ভ করিবার জন্য নিখিল-ভারত মুসলিম লীগ এই রমজান মাস ঠিক করিয়াছেন।”
কলিকাতা জেলা মুসলিম লীগের সেক্রেটারী মহম্মদ ওসমানের স্বাক্ষরে এই পুস্তিকাটি প্রচারিত হয়। এই মিঃ ওসমানের স্বাক্ষরে এই পুস্তিকাটি প্রচারিত হয়। এই মিঃ ওসমান কলিকাতার মেয়র। ১৬ই আগস্টের পূর্বে রাত্রিতে লীগের স্বেচ্ছাসেবকেরা কুচকাওয়াজ করিয়াছে, জেহাদের কথা ঘোষণা করিয়া লরীযোগে মুসলমান পাড়াগুলিতে প্রচারকার্য করিয়াছে এবং “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্থান” ধ্বনি সম্বনয়ে চীৎকার করিয়া পাড়ায় হিন্দুদের ত্রস্ত করিয়া তুলিয়াছে।
১৬ই শুক্রবার ভোর না হইতেই জেহাদ ঘোষণাকারীদের দল পথে পথে বাহির হইয়া পরে এবং কাহারও দোকান একটু খানি খোলা দেখিলেই তাহা বন্ধ করিবার জন্য জিদ করে। দোকান লুঠ এবং দোকানের লোকদের প্রহার ও ছুরিকাঘাতও ভোর না হইতেই শুরু হইয়া যায়। মাণিকতলা, রাজাবাজার, মেছুয়াবাজার, টেরিটিবাজার, বেলগাছিয়া প্রভৃতি মুসলমানপ্রধান অঞ্চলগুলিতেই প্রথমে হিন্দুদের উপর আক্রমণ সুরু হয়। লীগ-নেতারা দাঙ্গার পরে সাফাই গাহিয়া বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন যে কলিকাতার লীগ হিন্দুদের এক-চতুর্থাংশ, সুতরাং এখানে লীগ প্রথম আক্রমণ করিতেই পারে না। সর্বপ্রথমে লীগের লোকেরা মাণিকতলার মোরে এক গোয়ালাকে প্রহার করে, তাহার দুধ রাস্তায় ঢালিয়া দেয় এবং দুগ্ধভাণ্ড প্রভৃতি ভাঙিয়া দেয়। তখন ভোর প্রায় ৬টা। তার পর দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামক একটি খাবারের দোকান লুঠ করে এবং দোকানের লোকদের প্রহার করে। পুলিশ প্রথম হইতেই ছিল নিরপেক্ষ দর্শক। চক্ষের উপর লুণ্ঠন ও ছুরি লাঠির দ্বারা আঘাত দেখিয়াও তাহারা সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয় থাকে।
সারাটা সকাল এই ভাবে গুণ্ডামি, লুঠপাট চালাইয়া লীগের যোদ্ধারা শোভাযাত্রা সহকারে গড়ের মাঠের সভায় যাইতে আরম্ভ করে। ভোর না হইতেই যাহারা পথে বাহির হইয়াছে এবং শোভাযাত্রায় যোগ দিয়া সভাক্ষেত্রে অগ্রসর হইয়াছে তাহাদের প্রত্যেকের হাতেই লাঠি, ছোরা, তরবারি প্রভৃতি কোন-না-কোন অস্ত্র ছিল। লীগ নেতারা অস্ত্র বহনের কথা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করিয়াছেন কিন্তু ফটোগ্রাফে উহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ রহিয়াছে। দাঙ্গা উপলক্ষে লীগ-নেতারা মিথ্যা ভাষণে যে অসামান্য কৃতিত্ব দেখাইয়াছেন তাহার তুলনা পৃথিবীর ক্রত্রাপি মিলিবে কিনা সন্দেহ। শোভাযাত্রীদের সঙ্গে উর্দুতে “জেহাদের ফয়সালা করিতে হইবে” এরূপ কথা লেখা বহু সংখ্যক পতাকা ছিল। ময়দানের সভায় কাফের হিন্দুদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করিয়া জ্বালাময়ি বক্তৃতা দেওয়া হয়। সভার পর জেহাদের সোইনিকেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হইয়া হিন্দুর দোকান লুণ্ঠন ও হিন্দু হত্যা আরম্ভ করে। চৌরঙ্গি ধর্মতলায় যে সব অংশ গবর্ণমেন্ট হাউস হইতে দেখা যায় সেই সব স্থানে যত বড় লাঠি লইয়া জেহাদের সৈনিকেরা হিন্দুর দোকানপাট ভাঙিয়া লুঠ করে। চৌরঙ্গি ধর্মতলার প্রায় মোড়ে কে.সি বিশ্বাসের বন্দুকের দোকান লুঠ করে। লালবাজারে পুলিশের প্রধান ঘাঁটি হইতে কয়েক গজ মাত্র দূরে একটি ঘড়ির দোকান লুঠ হয় এবং উহার প্রায় দুই কার্লঙের মধ্যে পোলক স্ট্রীটে এবং টেরিটি বাজারে অনেক হিন্দু দোকানদার, দারোয়ান ও পথচারী নিহত হয়। গুণ্ডাদের সঙ্গে লাঠি, ছোরা, তরবারি তো ছিলই, প্রচুর পরিমাণে পেট্রোল এবং কেরোসিন তেলও ছিল এবং লরী ও গাড়ীর অভাব ছিল না। শহরের যে সব স্থানে মুসলমানেরা সংখ্যায় কম, সেই সব স্থানে লরীযোগে লোক পাঠাইয়া স্থানীয় মুসলমান্দের শক্তিবৃদ্ধি করা হইয়াছে। সন্ধ্যার মধ্যেই শহরের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্র আগুন জ্বলিয়া উঠে। সর্বত্র মুসলমানেরা আক্রমণ চালাইতে থাকে এবং এক্রান্ত হিন্দুরা পুলিশকে টেলিফোন করিয়া ও স্মমুখে পুলিশ দেখিলে তাহাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিয়া একই উত্তর পাইতে থাকে—রাজনৈতিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিবার হুকুম নাই। পুলিশ সম্বন্ধে গুণ্ডাদের মনোভাব ছিল যেন “পুলিশ আমাদের লোক, কিছু বলিবে না।” নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ প্রভৃতি পুলিশের চক্ষের উপর ঘটিয়াছে। বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশ এবং সার্জেন্টরা লুঠের মালের ভাগ আদায় করিয়াছে।
১৬ই আগস্টের পর
১৬ই আগস্ট সন্ধ্যার মধ্যেই হিন্দুরা উপলব্ধি করিল যে পুলিশের সাহায্য তাহারা পাইবে না। ধন, প্রাণ ও নারীর সম্মান রক্ষা করিতে হইবে। কর্তৃপক্ষের অজুহাত—পুলিশ সংখ্যায় কম ছিল, এত বড় দাঙ্গা নিবারণের শক্তি তাহাদের ছিল না। ভাল কথা, কিন্তু পুলিশ একেবারেই কেন বাহির হইল না তার কোন কৈফিয়ৎ কেহ দেন নাই। ১৬ই সকালে অবস্থা আয়ত্তের বাইরে যায় নাই, ময়দানের সভা পর্যন্তও এমন অবস্থা ছিল যে পুলিশ চেষ্টা করিলে গুণ্ডার দলকে সংযত করিতে পারিত। বোম্বাইয়ে দাঙ্গা নিবারণ করিতে গিয়া পুলিশের উর্ধতন কর্মচারীরাও অনেকে আহত হইয়াছেন কিন্তু কলিকাতার বড় অফিসার তো দূরের কথা একটি কনেস্টবলের পিঠে পর্যন্ত একটি আঁচড় লাগে নাই। ১৭ই সকাল হইতে হিন্দু পাড়ায় আক্রমণ হইলে হিন্দুরা সম্মিলিত চেষ্টায় তাহাতে প্রথমে বাধা দান, পরে পাল্টা আক্রমণ আরম্ভ করিল। ১৭ই এবং ১৮ই এই দুই দিন আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ ভয়ানক ভাবে চলিতে থাকে, ১৮ই সন্ধ্যা নাগাদ গুণ্ডারা বুঝিতে পারে যে হিন্দুরা মারিতে আরম্ভ করিয়াছে, আর বেশি দূর অগ্রসর হইলে জেহাদে পরাজয় বরণ করিয়াই ঘরে ফিরিতে হইবে। ১৭ই হইতে পাল্টা আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি হয়, তখনই লীগ মন্ত্রীরা মিলিটারী বাহির করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠেন। তাহাদের অনুরোধ রক্ষিত হয়, মুসলমানেরা যে সব স্থানে আক্রান্ত হইয়াছিল সেখানে মিলিটারি ধাবিত হয়; পড়িয়া থাকে মুসলমান বেষ্টিত হিন্দু-জনসাধারণ। অবশেষে রবিবার সন্ধ্যা নাগা নাগাদ পাল্টা জবাবের নমুনা দেখিয়ে লীগ-নেতাদের চৈতন্য কতকটা জাগ্রত হয়; সংগ্রাম বন্ধের জন্য তাঁহারা চেষ্টা আরম্ভ করেন। আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার ভার প্রধান মন্ত্রীর হাত হইতে সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে চলিয়া যাওয়াও লীগের হতাশার অন্যতম কারণ। সোমবার ১৯শে অবস্থা অনেকটা আয়ত্তে আসে।
এই তিন দিনের হত্যাকাণ্ডে ছয় হইতে আট হাজার লোক নিহত হয়, ১৫ হইতে ২০ হাজার আহত হয় এবং প্রায় পাঁচ হইতে সাত কোটি টাকার সম্পত্তি লুণ্ঠিত হয়। লুণ্ঠিত সম্পত্তির মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগই হিন্দুর।
এবার শুরু হইল লীগের মিথ্যাভাষণের পালা। মিঃ জিন্না, নবাবজাদা লিয়াকৎ আলি, বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ প্রভৃতি সকলেই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব কংগ্রেসের ঘাড়ে চাপাইবার জন্য বিবৃতি প্রচার সুরু করিলেন। মুসলমানেরা নিরস্ত্র ও শান্ত ছিল, তাহারা মোটেই আক্রমণ করে নাই, হিন্দুরাই তাহাদের মারিয়া শায়েস্তা করিয়াছে, হাতে মারিবার পর বয়কট করিয়া আবার ভাতে মারিবার ব্যবস্থা করিতেছে, হতাহতের মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগই মুসলমান ইত্যাদি প্রচারকার্য সুরু হইয়াছে এবং এখনও চলিতেছে। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের নামে মুসলমানদের নাচাইয়া যাঁহারা ঘরের বাহির করিয়াছিলেন, পাল্টা আক্রমণে তাহাদের দুর্দশা দেখিয়ে লীগ-নেতারা তাঁহাদের সকল দায়িত্ব অস্বীকার করিয়াছেন অথবা তাঁহাদের প্রত্যেক রাজনৈতিক কাজে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণের ন্যায় এখানেও তাঁহারা উহাই করিতেছেন কিনা তাহা বুঝা মুশ্কিল। তবে একথা ঠিক যে কলিকাতায় সংগ্রাম আরম্ভ করিবার দায়িত্ব যাঁহাদের, যাঁহারা এই সংগ্রাম শান্তিপূর্ণ থাকিবে না বলিয়া প্রকাশ্যে ঘোষণা করিয়াছিলেন তাঁহারা সংগ্রামের পর উহার নায়ক্ত্ব অস্বীকার করায় তাঁহাদের চূড়ান্ত নৈতিক পরাজয় প্রকটিত হইয়াছে। নিরপেক্ষ ও চিন্তাশীল মুসলমানেরা অনেকেই লীগ-নেতাদের এই ভীরুতা ও পরাজয় লক্ষ্য করিয়াছেন।
কংগ্রেসের সম্বন্ধে লীগ যাহা বলিয়াছে তাহাতে আমাদের মনে হয় প্রকারান্তরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির প্রশংসাই করা হইয়াছে। বহুদিন যাবৎ বাংলা কংগ্রেস দারুণ নিস্ক্রিয়তার পরিচয় দিয়া আসিয়াছে, দলাদলি লইয়া তাহার নেতারা সব সময়ে ব্যস্ত। কলিকাতার হত্যাকাণ্ড সাধনের আয়োজন পূর্ব হইতে করিত হইল যে সঙ্ঘশক্তি ও কর্মকুশলতার প্রয়োজন বর্তমান কংগ্রেস কমিটির তার বিশ ভাগের এক ভাগও আছে আমরা ইহা মানিতে প্রস্তুত নহি। না বুঝিয়া লীগ নিজের অজ্ঞাতসারে ইঁহাদের যে প্রশংসা করিয়া বসিয়াছেন তার জন্য কংগ্রেস কমিটির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব
“মুসলিম লীগের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবস পালন উপলক্ষে কলিকাতায় গত ১৬ই আগস্ট এবং তাহার পরবর্তী কয়েক দিন যে সকল ঘটনা ঘটিয়া গেল, ওয়ার্কিং কমিটি তাহার বিবরণ অতীব দুঃখের সহিত পাঠ করিয়াছেন। কলিকাতার ধন-প্রাণের যে গুরুতর ক্ষতি হইয়াছে, বিশেষ করিয়া আত্মরক্ষায় অসমর্থ নর, নারী ও শিশুগণকে যে পাশবিক ভাবে হত্যা করা হইয়াছে, ওয়ার্কিং কমিটি তাহার তীব্র নিন্দা করিতেছে। সম্প্রদায় এবং দল নির্বিশেষ নির্যাতিত নরনারীর প্রতি কমিটি সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছে। তাহাদিগকে সাহস, সহনশীলতা ও ধৈর্যের সহিত অবস্থার সম্মুখীন হইবার জন্য কমিটি অনুরোধ জানাইতেছে।
লীগ ও বাংলা-সরকারের ভূমিকা
২৯ শে জুলাই তারিখে মুসলিম লীগ কাউন্সিল ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামে’র সিদ্ধান্ত করিয়া একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবের সমর্থনে কয়েকটি উত্তেজনামূলক বক্তৃতা দেওয়া হয়; ইহার পর লীগের দায়িত্বশীল সদস্য এবং মন্ত্রিগণ এমন কতকগুলি ভাষণ, বিবৃতি ও প্রচারপত্র প্রকাশ করিতে থাকেন এবং লীগের সংবাদপত্রগুলি এমন সমস্ত প্রবন্ধ লেখেন যাহার ফলে বহু মুসলমান ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে।
বহু প্রতিবাদ সত্ত্বেও বাংলা-সরকার ১৬ই আগস্ট ছুটির দিন বলিয়া ঘোষণা করেন। ইহার ফলে এই ধারণাই সৃষ্টি হয় যে, ১৬ই আগস্ট দিবস পালনের সহিত সরকারও সংশ্লিষ্ট এবং যাহারা ইহাতে যোগ দিবে না তাহারা গবর্মেন্টের নিকট হইতে কোন সাহায্য পাইবে না।
দেখা যায় লীগ শোভাযাত্রীদের সহিত লাঠি, তলোয়ার, বল্লম, ছোরা, কুঠার প্রভৃতি ছিল। ১৬ই আগস্ট সকাল হইতেই তাহারা এই সকল আস্ত্রশস্ত্রের ভয় দেখাইয়া দোকানদারদিগকে দোকান বন্ধ করিতে আদেশ দেয়। যে কেহই দোকান বন্ধ করিতে অস্বীকার করিয়াছে বা ইতস্ততঃ করিয়াছে শোভাযাত্রীরা তাহাদিগকে নির্দয়ভাবে প্রহার করিয়াছে। সকাল হইতেই ছুরিমারা এবং লুণ্ঠন চলিতে থাকে। বহু জায়গায় গুণ্ডারা বন্দুক পর্যন্ত ব্যবহার করে। ইহার পর নিতান্ত পাশবিক ভাবে নরহত্যা এবং ব্যাপকভাবে লুণ্ঠন ও গৃহাদিতে অগ্নিসংযোগ চলিতে থাকে। এই নরহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিকাণ্ড তিন-চার দিন সমানে চলিতে থাকে। ফলে সহস্র সহস্র লোক নহত হয় এবং কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়।
১৬ই আগস্ট কোন পুলিশ এবং ট্রাফিক পুলিশ পর্যন্ত একরূপ ছিলই না। মহরম এবং অন্যান্য শোভাযাত্রা ব্যাপারে যে অতিরিক্ত পুলিশ নিয়োগ করা হইয়া থাকে, তাহাও ওই দিন করা হয় নাই। পুলিশ শেষ পর্যন্ত আসিলেও তাহারা শান্তিপূর্ণ নাগরিকদিগকে কোন সাহায্যই করে নাই। ফলে জনগণকে যথাসাধ্য আত্মরক্ষা করিতে হয়। প্রথম দুই দিন নোইশ চলাচল সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা জারি করা সত্ত্বেও তাহা কার্যকরী হয় নাই। জনসাধারণ কোন যানবাহন পায় নাই,কিন্তু গুণ্ডারা মোটর লরী ব্যবহার করে। অগ্নিসংযোগ করিবার জন্য অবাধে প্রেটল ব্যবহার করা হয়। ঘরবাড়ী, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি ধ্বংস ওভস্মীভূত হয়। গুণ্ডারা যতদূর সম্ভব বহু জিনিসপত্র লইয়া যায়। মৃতদেহে রাজপথ সমাকীর্ণ হইয়া যায়। বহু মৃতদেহ এবং মুমূর্ষু ব্যক্তিকে ভুগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালীতে অথবা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। বহু তাণ্ডবলীলা চলার পরও শান্তি ফিরাইয়া আনিবার জন্য সৈন্যবাহিনীকে আহ্বান করা হয় নাই। কোন কোন স্থানে পুলিশ পর্যন্ত লুণ্ঠনে যোগ দেয়।
প্রথমে এই ভাবে নরহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিকাণ্ডের পর হিন্দু এবং অন্যান্য লোকেরা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় এবং যেখানে সম্ভব সেখানেই তাহারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে। ফলে বহু মুসলমান নিহত হয়।
পরস্পরের এই হত্যা ও অমানুষিক বর্ব্রতার মধ্যেওদেখা গিয়াছে যে হিন্দুরা দুর্গত মুসলমানদিগকে আশ্রয় দিয়াছে এবং মুসলমানরাও বিপন্ন হিন্দুদিগকে আশ্রয় দিয়াছে।
দাঙ্গার বিস্তৃতি
ওয়ার্কিং কমিটি উদ্বেগের সহিত লক্ষ্য করিতেছে যে অন্যান্য স্থানেও সামপ্রদায়িক অসম্প্রীতি বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং দাঙ্গাহাঙ্গামা হইয়াছে। ফলে ওই সকল স্থানেও বহু নরহত্যা হইয়াছে। সকলেই আশঙ্কা করিতেছে ইহা আরও বিস্তৃত হইতে পারে। সময় থাকিতে যদি ইহা প্রতিরোধ না করা যায় তবে এই দাঙ্গাহাঙ্গামা আরো ছড়াইয়া পড়িতে পারে।ইহা নিবারণ করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। শান্তিরক্ষা করা এবং শান্তিপূর্ণ নাগরিকের রক্ষা করা প্রত্যেক গবর্মেণ্টের কর্তব্য।
তদন্ত করা প্রয়োজন
দাঙ্গাহাঙ্গামার গুরুত্ব বিবেচনা করিয়া কমিটি মনে করে যে, ১৬ই আগস্টের পূর্বের ঐ দিনের ও তাহার পরের কয়েক দিনের ঘটনাবলী সম্পর্কে এবং দাঙ্গার পূর্বে ও পরে গবর্মেন্টেরবল্বিত ব্যবস্থা সম্পর্কে তদন্ত করিবার জন্য জনসাধারণের আস্থাভাজন একটি নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনাল নিয়োগ করা প্রয়োজন।
ওয়ার্কিং কমিটি মনে করে যে, বাংলা-সরকার শান্তি রক্ষা এবং শান্ত নাগরিকদের ধনপ্রাণ রক্ষা ব্যাপারে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছেন। ওয়ার্কিং কমিটির বিশ্বাস, যে আঘাত এবং হানা হইয়াছে তাহা শুধু দেহের উপরই নয়, মানুষের আত্মা এবং আত্মমর্যাদার উপরও বটে। এই আঘাত মুছিতে দীর্ঘ দিন লাগিবে। তথাপি জনগণের নিকট কমিটির আবেদন, তাহারা যেন গত কয়েক দিনের মর্মান্তিক ঘটনাবলী ভুলিয়া যায় এবং পরস্পরকে ক্ষমা করে; বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শুভেচ্ছা ও সৌদার্্য পুনঃস্থাপনের জন্য তাহার যেন এই ভয়াবহ অভিজ্ঞোতার সদ্ব্যবহার করে। ওয়ার্কিং কমিটি মনে করে, ভয় দেখাইয়া এবং হিংসাশ্রিত কার্যকলাপের দ্বারা বোঝাপড়া, সৌদার্য্যপূর্ণ আলোচনা এবং প্রয়োজন ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের গ্রহণযোগ্য সালিশীর দ্বারাই শুধু এই সমস্যার সমাধান করা যাইতে পারে।” —এ পি
কলিকাতার দাঙ্গা সম্বন্ধে চিন্তাশীল মুসলমানদের অভিমত:
কলিকাতার দাঙ্গায় পর উহা লইয়া নানা জনে নানা ভাবে আলোচনা করিয়াছে। এই দাঙ্গায় গুণ্ডাশ্রেণীর মুসলমানেরা লুঠের মাল হস্তগত করিয়া কিছু সুবিধা করিয়া লইয়াছে কিন্তু সাধারণ মুসলমানের ইহাতে অশেষ ক্ষতি হইয়াছে। কংগ্রেসকে জব্দ করিবার জন্য সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি করিয়া দাঙ্গা যাহারা বাধাইতেছে তাহারা মুসলমান জনসাধারণের হিতাকাঙ্খী নন, অনেকেই উহা বুঝিয়া প্রকাশ্যে এই কথা প্রচার করিতে সাহসী হইতেছেন। বর্তমান ঘোর দুর্যোগের মধ্যে ইহা আশার লক্ষণ। দাঙ্গার পর বাংলার মুসলমান ছাত্র ও যুবকদের নিকত আবেদন জানাইয়া বঙ্গীয় আজাদ মুসলমান ট্রাস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মিঃ এম আনিসুজ্জামানের একটি বিবৃতি ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে। উহাতে তিনি লিখিতেছেন :
আমি এই বিবৃতিতে হিন্দু সমাজকে উদ্দেশ্য করিয়া কিছু বলিব না। মাত্র মুসলমান জনসাধারণকে—বিশেষ করিয়া মুসলমান ছাত্র ও যুবক সম্প্রদায়কে কয়েকটি প্রশ্ন করিতে চাই। লীগপন্থী মুসলমান ভাইগণ ও উহার নেতৃবৃন্দ দাঙ্গার দায়িত্ব যতই অন্য কোন প্রতিষ্ঠান বা সম্প্রদায়ের স্কন্ধে চাপাইবার চেষ্টা করুন না কেন, একথা প্রত্যেক নিরপেক্ষ সজ্জনব্যক্তি একপটে স্বীকার করিবেন যে, দাঙ্গার জন্য মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দই একমাত্র দায়ী। এইরূপ দাঙ্গা চালাইবার জন্য লীগের নেতৃবৃন্দ ১৬ই আগস্টের পূর্ব হইতে বহু বিবৃতি এবং প্রচারণা প্রকাশ্যভাবেই প্রচার করিতেছিলেন। ১৬ই তারিখের পূর্বে নাজিমুদ্দীন সাহেব, সোহরাওয়ার্দী সাহেব, মওলানা আকরাম খাঁ সাহেব—এমনকি জিন্না সাহেব পর্যন্ত বিবৃতি ছাপিয়া লীগপন্থী মুসলমানগণকে এইরূপ একটি হিংসাত্মক কার্যে প্ররোচিত করিয়াছিলেন। এমন কি ইসিলামের পবিত্র “জেহাদের” নাম ভাঙ্গাইয়াও তাহাদিগকে উত্তেজিত করা হইয়াছে। ১৬ই আগস্ট তারিখের “আজাদে’ মওলানা মহম্মদ আকরাম খাঁর সুনামে লিখিত এক ঘোষণা প্রকাশিত হয়। উহাতে বলা হইয়াছে যে, অদ্য ১৮ই রমজান। এই দিন হজরত মহম্মদের (দঃ)নেতৃত্বে মুসলমানগণ কাফেরদের বিরুদ্ধে মদিনার “জেহাদ” করিয়া যুদ্ধ করেন। আজও সেই ১৮ই রমজান, অতএব মুসলমানগণ অদ্য ‘জেহাদের’ জন্য প্রস্তুত হও ইত্যাদি ধর্মের দোহাই দিয়া নানা ভাবে মুসলমানগণকে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় উত্তেজিত করা হইয়াছে। শুনা যায়, লীগ-মুসলমান গুণ্ডাদিগকে (যাহাদের) অনেকে গ্রেপ্তার হইয়াছে এই বলিয়া আশ্বাসও দিয়াছিল যে, বর্তমান বাংলার শাসনক্ষমতা লীগের করায়াত্ত। অতএব গুণ্ডাগণ খুশীমত হিন্দুর দোকানপাঠ লুণ্ঠন, মারামারি, কাটাকাটি করিলে তাহাদের ভবিষ্যতে কোন বিপদাশঙ্কা নাই, কারণ মন্ত্রীরা পুলিশকে নিরস্ত্র করিয়া রাখিবে। ফলেও যে তাহাই হইয়াছে ইহা কোন নিরপেক্ষ বিবেকবান ব্যক্তি অস্বীকার করিতে পারিবেন কি? আমরা দেখিয়াছি, ময়দানে সভায় যাইবার জন্য মিছিলকারী লীগওয়ালারা ছড়া ও লাঠিসহ সশস্ত্র হইয়া অবলীলাক্রমে রাস্তার উভয় পার্শ্বস্থ হিন্দুর দোকানসমূহ লুণ্ঠন করিতে করিতে যাইতেছে। আমরা আরও দেখিয়াছি—সশস্ত্র পুলিশ ইহা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিয়াছে আর মনের আনন্দে হাসিয়াছে।
হানাহানিতে লাভ কাহার?
এই হানাহানিতে লাভ কাহার হইল, এই ভাবে পাকিস্থান অর্জনই বা কতদূর সম্ভব হইল, রাজনীতির নামে নারী-নির্যাতন, গৃহুদাহ, লুঠতরাজ ও গুণ্ডামি করিয়া মুসলমান সমাজের কি উপকার হইল—এই সব প্রশ্ন তুলিয়া মিঃ আনিসুজ্জামান বলিতেছেন “বর্তমান দাঙ্গা সংঘটিত করাইয়া লীগ নেতৃবৃন্দ কতদূর সমাজের উপকার করিলেন? যাহাদের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এত জঘন্য তাহারা কোন্ মুখে ভারতের দশ কোটি মুসলমানের নেতৃত্বের বড়াই করে? তারপর তিনি লিখিতেছেন :
মুসলমান যুবকদিগকে চিন্তা করিতে অনুরোধ করিতেছি যে, পাকিস্থানী লড়াইয়ে নেতারা তাঁহাদিগকে ধ্বংসের কোন্ অতল তলে লইয়া যাইতেছেন তাহা কি তাঁহারা এখনও অনুভব করিতে পারেন নাই? নেতারা যে দাঙ্গাহাঙ্গামায় তাঁহাদিগকে প্ররোচিত করিয়াছিলেন সে দাঙ্গার পরিমাণ কি হইল তাহা তাঁহারা চিন্তা করিয়াছেন কি? তাঁহারা হয়ত বলিবেন—হিন্দুর দোকানপাট, বাড়ীঘর লুঠ হইয়াছে, হিন্দুর মেরুদণ্ড চূর্ণ হইয়াছে, এইবার সে পাকিস্থান প্রস্তাবে আর বাধ সাধিতে সাহস পাইবে না। কিন্তু আমি বলিব, না হিন্দুর মেরুদণ্ড পূর্বাপেক্ষা আরও দৃঢ়তর হইয়াছে। ঘুমন্ত সাপকে খোঁচা মারিয়া ফণা উত্তোলন করান হইয়াছে। বর্তমান দাঙ্গায় তাহার চূড়ান্ত প্রমাণ হইয়া গিয়াছে, আর সামাজিক মেরুদণ্ড চূর্ণ হইয়াছে মুসলমানের। হিন্দুর কমলালয়, জহরলাল, পান্নালাল, ডালিয়া প্রভৃতি কোটিপতিদের দোকান লুণ্ঠিত হইয়াছে। কিন্তু তাহাতে হিন্দু সমাজের কোন ক্ষতি হইয়াছে? এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মালিকদের লক্ষ লক্ষ টাকা ইন্সিওর করা রহিয়াছে। অতএব তাহারা দুই-এক মাসের মধ্যেই আবার পূর্ববৎ দাঁড়াইয়া যাইবে। কিন্তু মুসলমানের ক্ষতির পরিমাণ অপূরণীয়। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ই সমাজ ও জাতির মেরুদণ্ড। সেই মধ্যবিত্ত কলিকাতাবাসী মুসলমান আজ কোথায়? বিহারী ও পাঞ্জাবী মুসলমানরা গুণ্ডামী ও লুঠরতরাজ করিয়া অনেক কিছু লুঠিয়াই সরিয়া পড়িয়াছে। আর হিন্দুর মার খাইয়াছে বাঙালী মধ্যবিত্ত মুসলমান। মুসলমান বিড়ি-পান-সিগারেট-ওয়ালার, হোটেলওয়ালার, ছোটোখাটো থালা বাসনের দোকালওয়ালার, ছোট কাটা-কাপড়ওয়ালার, মনোহারী দোকানওয়ালার, কলওয়ালার যথাসর্বস্ব পরে এক এক করিয়া লুণ্ঠিত হইয়াছে। ইহারা কি আর কমলালয় বা তদনুরূপ অন্যান্য হিন্দু প্রতিষ্ঠানের মতন দাঁড়াইতে পারিবে? পানবিড়িওয়ালা বাদে এই সমস্ত দোকান প্রায় সবই বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্তের। এই ছোটখাটো ব্যবসায়ি মুসলমান মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় আজ সর্বহারা হইয়া কপালে হাত দিয়া কাঁদিতেছে। তাই আজ কলিকাতায় আত্মনির্ভরশীল ব্যবসায়ী মধ্যবিত্ত বাঙালী মুসলমান বিলুপ্ত হইল। ইহাতে সমাজের যে অপূরণীয় ক্ষতি হইল তাহা জিন্না সাহেব হইতে আরম্ভ করিয়া সোহারাওয়ার্দী, নাজিমুদ্দীন, মঃ আকরাম খাঁ, ওসমান প্রমূখ সমাজ-দরদী (?) মুসলিম নেতারা ভাবিয়াছেন কি? তাঁহাদের আরম্ভ ইহা ভাবিয়া দেখিবার প্রয়োজন নাই, কারণ সমস্ত নেতার (?) প্রয়োজন আজ আর সমাজের নাই। ইহাদিগকে সমাজের পুরোভাগ হইতে বহিষ্কার করিতে পারিলে সমাজের মঙ্গল হইবে। ধর্মের দোহাই দিয়া এই দাঙ্গায় মুসলমানগণকে উত্তেজিত করান হইয়াছে। কিন্তু ধর্মের নামে অধর্মের এত বর লীলাখেলার অনুষ্ঠান পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে কিনা তাহা একবার মুসলমান যুবকদিগকে চিন্তা করিয়া দেখিতে অনুরোধ করিতেছি। নিরীহ নাগরিকের জীবন সংহার, তালাবন্ধ দরজা ভাঙ্গিয়া দোকান লুণ্ঠন, নারীর পবিত্র দেহে ছুরিকাঘাত এ কোন ধর্মসম্মত? এই সমস্ত বিষয়ে এছলামের যে কঠোর নির্দেশ রহিয়াছে তাহা তাঁহারা ভুলিয়া গিয়াছেন কি? আমাদের আল্লাহ্ পবিত্র কোরয়ানে বলিয়াছেন, “যে ব্যবক্তি একজন নিরীহ (সে যে কোন ধর্মালম্বীই হউক না কেন) মানুষের প্রাণ সংহার করে সে দুনিয়ার সমস্ত মনুষ্য জাতির জীবন-সৎকারের অপরাধে অপরাধী। আর যে এক জন বিপন্ন মানূষের জীবন রক্ষা করিয়াছে সেই মহৎ; সমস্ত মনুষ্য জাতির জীবনরক্ষার পুণ্যভাগী।” এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া চলিলে আজ যে অসংখ্য নাগরিকের জীবন বিপন্ন হইল ইহার জন্য কি লীগ-নায়করা সমস্ত মনুষ্য জাতির জীবন-সংহারের পাপ অর্জন করেন নাই?
বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দুই রূপ
বাংলার প্রধানমন্ত্রী যে দ্বৈতনীতি অনুসরণ করিয়া চলিয়াছেন দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলার উপর তাহার ফল বিষময় হইতেছে এবং গবর্মেন্টের উপর জনসাধারণের আস্থা ক্রমশঃ আরও কমিয়া আসিতেছে। ১৬ই আগস্ট গড়ের মাঠের সভায় মিঃ সুরাবর্দী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম উপলক্ষ্যে আইন অমান্য সুরু করিবার প্রস্তাব যিনি তুলিয়াছেন, তিনিই প্রদেশের আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী। ইহার কয়েক দিন আগে তিনিই এক বিবৃতিতে ঘোষণা করেন যে কংগ্রেস লীহকে বাদ দিয়া কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করিলে বাংলাদেশ বিদ্রোহ ঘোষণা করিবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কর দেওয়া বন্ধ করিবে। সিন্ধুতে মিঃ গজদারও অনুরূপ বিবৃতি দিয়াছিলেন। কিন্তু মিঃ গজদারের সহিত মিঃ সুরাবর্দীর পার্থক্য এই যে, প্রথমোক্ত ব্যক্তির সহিত গবর্মেন্টের কোন সম্পর্ক নাই, দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রাদেশিক স্বরাষ্ট্র বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান মন্ত্রী। বাংলার প্রধান মন্ত্রীর দ্বৈত রূপের এখানেই শেষ নয়। দাঙ্গার অব্যবহিত পরে তিনি স্বদেশে ও বিদেশে পরস্পর বিরোধী দুই প্রকার বিবৃতি দিয়াছেন। ২২শে আগস্ট তিনি বাংলার জনসাধারণকে উল্লেখ করিয়া বলেন : “প্রথমেই বলিয়া রাখি যে এবার কার (অর্থাৎ ১৬ই আগস্ট তারিখের সংগ্রাম দিবসের) অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে এই বিরাট নগরীকে যে সাঙ্ঘাতিক দুর্গতি ভোগ করিতে হইল তাহার জন্য কাহাকেও দোষের ভাগী করিবার সময় এখনও আসে নাই। কোনও এক ব্যক্তিই—বিশেষ করিয়া গবর্মেন্টের মধ্যে নাই এমন কোনও এক ব্যক্তিই—এই শোচনীয় ব্যাপার সম্বন্ধে পূর্ণ তথ্য অবগত নহে, সুতরাং কি ভাবে এবং কেন এই দাঙ্গা আরম্ভ হইল সে সম্বন্ধে কোনও রায় দিতে পারে না।
“কিন্তু গবর্মেন্ট আর কিবা নাগরিকবর্গ এখন উভয়ের পক্ষেই প্রথম কাজ হইতেছে পারস্পরিক সদ্ভাব এবং আস্থার পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা। আমি এজন্য খুবই খাটিতেছি। আপনারা সকলেই নিশ্চয়ই লক্ষ্য করিয়াছেন যে, স্বস্তির ভাব ফিরিয়া আসার লক্ষণ দেখা যাইতেছে। আমি মাঝে মাঝে শান্তি স্মমেলন ডাকিয়াছি, তাহাতে বিভিন্ন দলের নেতারা যোগ দিয়াছেন, সে সমস্ত সভায় বর্তমান অবস্থার কথা আলোচিত হইয়াছে। আপনারা সকলেই বোধ হয় জানেন যে, গতকল্য সম্মেলনে স্থির হইয়াছে, সকালে শান্তির চেষ্টায় শহর ঘুরিয়া বাড়াইবেন এবং লোককে আহাম্মকের মত গুণ্ডামি, লুঠ ও নরহত্যা হইতে বিরত থাকিতে বলিবেন। ইহাতে যে চমৎকার সাড়া পাওয়া গিয়াছে তাহাতে আমরা বড়ই আপ্যায়িত হইয়াছি।
* * * * *
“এ সম্পর্কে আমি বর্তমানে কিছুই বলিতে চাহি না। কারণ ইহাতে শান্তি স্থাপনে ব্যাঘাত হইতে পারে। প্রকৃত পক্ষে যাহারা শান্তি কামনা করে ও শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করে তাহারা আমার বিরুদ্ধে যত খুশী নালিশ করিতে পারে। শান্তি প্রতিষ্ঠা হইলে আমি সকল নালিশের ঠিক ঠিক উত্তর দিতে এবং আসল ব্যাপার প্রকাশ করিতে পারিব।” ঐ দিনই তিনি বিদেশী সাংবাদিকদের এক সম্মেলন আহ্বান করেন। সেখানে তিনি যাহা কিছু বলেন তাহা ভারতবর্ষের কুত্রাপি প্রকাশিত হইবে না ইহাই ছিল তাঁহার সর্ত। সুতরাং এখনও উহার বিস্তৃত বিবরণ জানা যায় নাই। দোইনিক ভারতের নিউ ইয়র্কস্থ সংবাদদাতা উক্ত বক্তৃতার একখণ্ড নকল প্রএরণ করায় ৩০ শে আগস্ট তারিখের ‘ভারতে’ উহার সারাংশ প্রকাশিত হয়। ঈদের সময় কোন হাঙ্গামা হইবে না এই মত ব্যক্ত করিয়া সুরাবর্দী বলেন :
“ঈদের পূর্বেই শহরের অবস্থা স্বাভাবিক হইয়া যাইবে বলিয়া আমি মনে করি। কিন্তু ভারতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সহিত জড়িত রাজনৈতিক পরিস্থিতির দরুন ঐ শান্তি বেশী দিন টিকেবে বলিয়া আমার মনে হয় না।” তিনি কলিকাতার সাম্প্রতিক হাঙ্গামার জন্য হিন্দুদের উপর দোষারোপ করেন। মিঃ সুরাবর্দী বলেন হিন্দুরাই কলিকাতাস্থিত সাম্প্রদায়িক সংগ্রাম সুরু করিয়াছেন এবং ভারতের এক সম্প্রদায়কে অপর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার জন্য ব্রিটিশ সরকার দায়ী।
‘হিন্দু কংগ্রেস’ নাকি সংগ্রামের জন্য সুযোগ খুঁজিতেছিল এবং সহজেই বুঝা যায় যে, তাহারাই হাঙ্গামা সুরু করিয়াছে। কংগ্রেস নাকি বাংলার মন্ত্রিসভার মুখে চূণ-কালি দিবার জন্য হাঙ্গামা বাধাইয়া বাহিরে ঐ নিন্দাবাদ প্রচারের পক্ষে একটা সুবিধাজনক অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টায় ছিল।
হিন্দু-মুসলমান বিরোধের অন্য ব্রিটিশ সরকারকে দায়ী করিয়া মিঃ সুরাবর্দী বলেন, “ব্রিটিশ সরকার, মন্ত্রিমিশন এবং বড়লাট ভারতীয় স্বাধীনতা সমস্যা স্মপর্কে হিন্দু ও মুসলমানকে লইয়া ইচ্ছাকৃত ভাবে হেলা-ফেলা করায় বিদ্বেষ ভাব বিশেষ বৃদ্ধি পাইয়াছে।”
“ব্রিটিশরা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এমন বিদ্বেষ সৃষ্টি করিয়াছে যে, নূতন পথ বাতলাইবার জন্য তাহাদের এদেশে থাকিতেই হইবে। ব্রিটিশের ভারত ত্যাগের কোন ইচ্ছাই নাই।”
লীগের এই দ্বৈত নীতি সমগ্র দেশের পক্ষে গভীর অকল্যাণের কারণ হইতে বাধ্য, হইয়াছেও তাই। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম উপলক্ষে আইন অমান্য আরম্ভ করিতে হইলে সর্বাগ্রে লীগের উচিত ছিল ব্যবস্থা পরিষদ বর্জন এবং মন্ত্রিত্ব পরিত্যাগ। কিন্তু তাঁহারা প্রথম হইতেই উহার বিপরীত আচরণ করিয়া আসিতেছেন। মন্ত্রীরা নিজেদের কথা ও মতের দ্বারা গুণ্ডাশ্রেণীর মুসলমানদের বুঝিতে দিয়াছেন যে হিন্দুর প্রাণনাশ, হিন্দুর সম্পত্তি লুণ্ঠন প্রভৃতিই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মূল কথা। ইহা বুঝিয়াছি গুণ্ডাশ্রেণীর লোকেরা দাঙ্গা আরম্ভ করিয়াছে। কলিকাতা এবং পূর্ববঙ্গের, বিশেষতঃ ঢাকার ঘটনায় দেখা গিয়াছে মন্ত্রীরা কঠোর হস্তে আইন প্রয়োগ করিয়া গুণ্ডা মুসলমানদের দমন করিতে এখনও অনিচ্ছুক। কলিকাতায় নির্বিচারে প্রমাণ-প্রয়োগের প্রতি লেশমাত্র লক্ষ্য না রাখিয়া অতি নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদেরও অভিযোগ ভদ্র হিন্দুদের পর্যন্ত বেপরোয়া ভাবে গ্রেপ্তার করা হইতেছে, অথচ হিন্দুরা নরহত্যার গুরুতর অভিযোগ করিয়াও অপরাধীর গ্রেপ্তার করাইতে পারিতেছে না। ঢাকায় প্রথমটা দাঙ্গাকারী ও দাঙ্গার সমর্থক মুসলমানদের উপর কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করায় এবং বেশী করিয়া পাইকারী জরিমানা ধার্য করায় দাঙ্গার প্রকোপ অনেকটা কমিয়া আসিতেছিল। সম্প্রতি ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট কলিকাতার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আহূত হইয়া আসিয়াছিলেন। তিনি ফিরিয়া যাওয়ার পর পূর্ব অনুসৃত নীতি পরিবর্তিত হয়। মুসলমানকে আহত করার অভিযোগে যেখানে হিন্দুরদের উপর পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য হয়, হিন্দুর হত্যার অভিযোগে সেখানে মুসলমানদের জরিমানা হয় মাত্র তিন শত টাকা। মুসলমানদের মধ্যে প্রচারকার্য চলিতেছে যে জরিমানার টাকা আদায় হইবে না, বা আদায় হইলেও তাহা ফেরত দেওয়া হইবে। ইহাতেও গুণ্ডাশ্রেণীর দুস্প্রবৃত্তি বাড়িয়া গিয়াছে।
বাংলার বর্তমান মন্ত্রীদের এই যে দ্বৈতনীতি ১৬ই আগস্ট হইতে সুরু হইয়াছে, এখনও তাহা অব্যাহত ভাবেই চলিতেছে। লীগের জন্মাবধি অত পরিষ্কার ভাবে দেখা গিয়াছে যে মুসলমান গুণ্ডারা সরকারের ও পুলিশের সমর্থন না পাইলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কখনও বেশী দিন টেঁকে না। লীগের অন্যায় ও অযৌক্তিক আবদার গগনস্পর্শী হইয়াছে সরকারী সমর্থন লাভের ফলে। গবর্মেন্টের শাসন-যন্ত্র পিছনে থাকে বলিয়াই লীগ দেশের অনিষ্ট করিয়া সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের সহায়তা করিতে পারে। এখনও লীগের অন্তরালে রক্ষণশীল সিভিলিয়ান ও পুলিশ কর্তৃপক্ষ যে ভাবে অকস্মাৎ গণতন্ত্রের প্রতি পরম শ্রদ্ধাবান হইয়া লীগ-মন্ত্রীদের দ্বৈত নীতি এবং তাঁহাদের সকল অন্যায় কার্য সমর্থন করিয়া চলিয়াছেন তাহাতে বুঝিতে কষ্ট হয় না যে লীগকে শিখণ্ডী করিয়া রক্ষণশীল দলের স্তম্ভ-স্বরূপ সিভিলিয়ানতন্ত্র কর্তৃক বিলাতের শ্রমিক দল ও কংগ্রেসের শুভ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দিবার চেষ্টা চলিতেছে। “দাঙ্গার জন্য হিন্দু কংগ্রেস দায়ী” এই ঘৃণ্য মিথ্যার লেশমাত্র প্রমাণ লীগের নেতৃবর্গ কোন কিছুই দিতে পারেন নাই। উচ্চকণ্ঠে মিথ্যার প্রচার যাহাদের মূলনীতি সেই দলের কোনও ধর্মের দোহাই দেওয়া আশ্চর্য। অথচ এই ধর্মের দোহাই এঁদের একমাত্র স্ম্বল।
দাবির উগ্রতা অবাস্তব
মিঃ আনিসুজ্জমান মুসলমান যুবকদিগকে বর্তমান নেতৃত্বের ব্যর্থতা, নেতাদের বিষময় অদূরদর্শিতা ও “অভূতপূর্ব অধর্মাচরণ” লক্ষ্য করিয়া ভবিষ্যতের জন্য নূতন করিয়া গড়িয়া উঠিবার জন্য অনুরোধ জানাইয়াছেন। তিনি বলিতেছেন, “চার্চিলের মন্ত্রণা যে নেতৃত্বের নির্দেশ দেয় সে নেতৃত্ব দূরে নিক্ষেপ করিয়া সমাজকে কোন্ পূতিগন্ধময় স্তরে নামাইয়াছে তাহা চিন্তা করিয়া ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হইতে হইবে। শুধু দশ কোটি মুসলমানের নয়, চল্লিশ কোটি মনুষ্য সন্তানের শোষক সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই, সেই লড়াই-ই প্রকৃত জেহাদ।”
বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই ধরণের চিন্তাশীল ও দূরদর্শী মুসলমানদের লিখিত পত্র প্রকাশিত হইয়াছে। তন্মধ্যে দেরাদুন হইতে লিখিত মিঃ কে.এফ.ইব্রাহিমের পত্রখানি নিম্নে প্রদত্ত হইল। উহা স্টেইসম্যান পত্রে প্রকাশিত হয়।
“আমি লীগারও নই, জাতীয়তাবাদী মুসলমানও নই। আমি নিতান্তই সাধারণ মুসলমান, সত্য কথা বুঝিতে চাই। মুসলমানেরা সমগ্র ভারতের জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ মাত্র ইহা বাস্তব সত্য। সকলকে যাহা দেওয়া হয় তার এক-চতুর্থাংশ পাইলেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আমরা নিজেদের জন্য যে ভাবে প্রাপ্যের অতরিক্ত দাবি করিতেছি, অপরকে কি আমরা তাহাই দিতে পারিব? ক্যাবিনেট মিশনের প্ল্যানের ‘বি’ গ্রুপের শিখদের কি আমরা অন্যত্র যাহা আদায় করিব সেই অনুপাতে সুবিধা দিতে রাজি হইব? যতই সাম্প্রদায়িক দরদ আমার মধ্যে থাকুক না কেন, মিঃ জিন্না যখন প্যারিটির কথা বলেন আমার সমগ্র অন্তরাত্মা তাহা শুনিলে বিদ্রোহী হইয়া উঠে। প্যারিটি আদায় করিয়া মিঃ জিন্না তাঁহার সুর আরও চড়াইয়া সর্বোচ্চ গ্রামে বাঁধিতে গেলেই উহা ছিঁড়িবার সম্ভাবনা বেশী থাকে।”
“সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা তাহাদের ন্যায্য প্রাপ্যের বহুলাংশ স্বেচ্ছায় ছাড়িয়া দেওয়ায় যেখানে সন্তুষ্ট হওয়া উচিত ছিল, লীগ-নেতারা সেখানে সাম্প্রাওদায়িকতার বিষ ছড়াইতে আরম্ভ করিয়াছেন। বড় বড় নেতারা নিশ্চিত আরামে বন্ধ ঘরে বসিয়া হুকুম দিতে পারেন, মরিবার সময় মরে নিরীহ এবং রাজনৈতিক জ্ঞানবর্জ্জিত মুসলমান।”
“কলিকাতার হত্যাকাণ্ডে তাঁহার সম্প্রদায়ের কি দুর্দশা হইয়াছে তাহা জানিয়াও মিঃ জিন্না শিক্ষালাভ করিতে চাহিতেছেন না ইহা কি দুঃখের বিষয় নয়? লীগ-নেতা-দের প্ররোচনায় মুসলমানেরাই সম্ভবতঃ দাঙ্গা সুরু করিয়াছিল, কিন্তু পরে তাহারাই হাজারে হাজারে মরিয়াছে ইহা তো অস্বীকার করিয়া লাভ নাই? ছোড়া নাচাইয়া আমাদের কি লাভ হইয়াছে? লীগ ছুরি মারিতে গেলে বিপক্ষ দলও ছুরি মারিতে পারে এবং হইতেছেও তাই। ইহাতে সারাটা দেশে গৃহযুদ্ধ সুরু হইয়া যাইবে এবং নির্বিরোধী হিন্দু মারমুখো হইয়া আক্রমণ আরম্ভ করিবে। গুণ্ডামির প্ররোচনা বন্ধ করিয়া সাধারণ মানুষকে বাঁচাইবার সময় আসিয়াছে।”
দাঙ্গায় সব মুসলমান যোগদান করেন নাই বহু ঘটনায় তাহা প্রমাণিত হইয়াছে। কিন্তু তাঁহারা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে প্রকাশ্য প্রতিবাদ করিলে এবং সাধারণ মুসলমানকে এই দ্বন্দ্বের বিফলতা ও বিপদ বুঝাইয়া দিতে আগ্রসর হইলে সুফল ফলিতে পারিত, কিন্তু তাহা অনেকে করিতে সাহসী হন নাই। বর্তমান লীগ মন্ত্রীত্ব না ভাঙিলে বাঙালী হিন্দুর যেমন আশঙ্কার কারণ রহিয়াছে, বাঙালী মুসলমানের বিপদের সম্ভাবনাও তেমন কম নয়। সুতরাং এই দলকে অপসারিত করিয়া হিন্দু মুসলমান উভয়ের সমান বিশ্বাসভাজন মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের কার্যে চিন্তাশীল মুসলমানদেরই আগাইয়া আসিতে হইবে। এখনও শুধু মুসলমান বলিয়াই বর্তমান মন্ত্রিসভা ইঁহাদের সমর্থন পাইতে থাকিলে দেশের সকল সম্প্রদায়েরই মঙ্গল সুদূরপরাহত হইবে।
Comment here