-শ্রীমতী স্বর্ণকুমারী দেবী
পৃথিবী-জাত সকল বস্তুই পরিবর্তন নিয়মের বশবৰ্ত্তী হইয়া জন্ম, জীবন ও মৃত্যু, এই তিন অবস্থা প্রাপ্ত হয়। সকল বস্তুই যে সমান সময়ে এই তিন অবস্থা পায় এমন নহে। আমরা যে সময়কে এক মুহূৰ্ত্ত বলি সেই সময়ের মধ্যেই অনেক কীট পতঙ্গ এই তিন অবস্থা অতিক্রম করে। জন্ম হইতে মৃত্যুর মধ্যবর্ত্তী কালকে জীবন কহা যায়। পৃথিবী-জাত সকল বস্তুই এই নিয়মের অধীন, কিন্তু পৃথিবী নিজে এই নিয়মের অধীন কি না ? পৃথিবীর জীবনের বিষয় আমরা জানি কিন্তু ইহার মৃত্যু হইবে কি না তাহা আমরা জানি না ; আবহমান কাল হইতে পৃথিবীকে আমরা যেরূপ সমভাবে চলিতে দেখিয়া আসিতেছি তাহাতে আপাততঃ মনে হয় পৃথিবী মৃত্যুর আয়ত্তাধীন নহে।
এখন, দেখা যাক পৃথিবীর ন্যায় একটা গ্রহের জীবন ও মৃত্যু বলিলে কি বুঝায়। পৃথিবীর এখনকার অবস্থাই ইহার জীবনের অবস্থা এখন পৃথিবীতে উদ্ভিজ্জ জন্মাইতেছে, নদী বহিতেছে, সমুদ্র তরঙ্গিত হইতেছে; এখন দিনের পর রাত আসিয়া, ঋতুর পর ঋতু আসিয়া, পৃথিবীকে জীবজন্তুর বাসোপযোগী করিয়াছে ; এক কথায়, এখন পৃথিবীতে যাহা হইতেছে তাহাতেই তাহার জীবনের অস্তিত্ব জাজ্জ্বল্যমান। এই অবস্থার অভাবের নামই মৃত্যু। এই অবস্থার অভাব হেতুই চন্দ্রকে আমরা মৃত গ্রহ বলি । *
পৃথিবীর বায়ুর ন্যায় সূক্ষ্ম বস্তু ভেদ করিয়া যাইতে হইলেও তাহাতে বাধা পাইয়া আলোকের তির্য্যগ গতি (Refraction) হয়। কিন্তু চন্দ্র হইতে আলোক আসিবার সময় তাহার তির্য্য গতি হয় না। ইহা হইতেই জানিতে পারা যায় যে চন্দ্রে বায়ু নাই, আর যদিই বা থাকে, তাহা অত্যন্ত লঘু। অত্যন্ত লঘু বায়ুতে জীবজন্তু বাঁচিতে পারে না। বৈজ্ঞানিকেরা বলেন যে চন্দ্রে বায়ু নাই, জলও নাই। আমরা যাহাকে চন্দ্রের কলঙ্ক বলি তাহা প্রকাণ্ড গহ্বর মাত্র, ঐ সকল গহ্বর
* আমাদের দেশের নামকরণ অনুসারে চন্দ্রকে গ্রহ বলা হইল। কিন্তু আসলে, যে সকল জ্যোতিষ্ক সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে তাহাদিগকেই গ্রহ কহে আর যাহারা কোন একটি গ্রহের চতুর্দ্দিকে পরিভ্রমণ করে তাহারা উপগ্রহ। চন্দ্র পৃথিবীর চারিদিকে পরিভ্রমণ করে, সেই নিমিত্ত ইহা প্রকৃত পক্ষে একটি উপগ্রহ।
পূর্ব্বে সমুদ্র ছিল, এখন শুকাইয়া ঐরূপ গহ্বর হইয়াছে। চন্দ্র এঁরূপ মন্দ-গতি যে নিজের চারিদিকে ঘুরিতেই উহার ১৫ দিন লাগে। এই সকল এবং অন্যান্য কারণে Proctor প্রভৃতি জ্যোতির্ব্বেত্তারা বলেন যে চন্দ্রে উদ্ভিজ্জ কিম্বা প্ৰাণী নাই ৷ যে গ্রহের চন্দ্রের মত অবস্থা হয় তাহাকেই মৃত কহা যায় ।
পৃথিবীর মৃত্যু সম্ভব কি না জানিতে হইলে দেখা আবশ্যক, পৃথিবীতে এমন কোন পরিবর্ত্তন হইতেছে কি না যাহাতে তাহার জীবনী শক্তির হানি করে। দেখা আবশ্যক, পৃথিবীর জীবনী শক্তির সঙ্গে এমন কোন প্রতিকূল শক্তি অবিচ্ছেদ্য ভাবে সম্বদ্ধ রহিয়াছে কি না যাহার অনিষ্ট-জনক কাৰ্য্য অলক্ষিত ভাবে পৃথিবীর পরমায়ু হ্রাস করিতেছে। যদি আমরা সেইরূপ প্রতিকূল শক্তি দেখিতে পাই তবে তাহার কার্য্য এখন অতীব সুক্ষ্ম হইলেও তাহা হইতে কালে পৃথিবীরও যে চন্দ্রের মত মৃত দশা হইবে না—এরূপ কে বলিতে পারে ?
গ্রহের জীবনের একটি প্রধান কারণ, বৈষম্য। বৈষম্য না থাকিলে কোন কার্য্যই হইতে পারে না; যদি সমস্ত পৃথিবী সমতল হইত অর্থাৎ পৃথিবীতে কিছু উঁচু নীচু না থাকিত, তাহা হইলে নদী বহিত না : নদীর গতির কারণ মাধ্যাকর্ষণ বটে, কিন্তু উঁচু নীচু না থাকিলে মাধ্যাকর্ষণ জলরাশিকে কোথা হইতে কোথায় টানিয়া আনিত ? উষ্ণতার বৈষম্যই বায়ুর গতির কারণ। যদি সমস্ত বায়ু সমান গরম হইত তাহা হইলে বায়ু বহিত না । বায়ুর কোন একস্থান অধিক উষ্ণ হইলে, তাহা লঘু হইয়া উপরে উঠে এবং তাহাদের পরিত্যক্ত স্থানে চতুষ্পার্শ্বস্থ অপেক্ষাকৃত শীতল বায়ু আসিতে থাকে এইরূপে বায়ু বহে। জলের উষ্ণতার বৈষম্যই সমুদ্রের স্রোতের প্রধান কারণ। সমস্ত সমুদ্রের জল যদি সমান গরম হইত তাহা হইলে জলাশয়ের ন্যায় সমুদ্র নিশ্চল থাকিত। সমুদ্রে স্রোত বহিত না । ঔপসাগরিক স্রোত (Gulf Stream) দ্বারাই ইংলন্ড মনুষ্যের বাসোপযোগী হইয়াছে। যদি ঔপসাগরিক স্রোত হইতে ইংলন্ডের চতুষ্পার্শ্বস্থ সমুদ্র উষ্ণ জল না পাইত তাহা হইলে ইংলন্ড প্রায় মেরুসন্নিহিত দেশের মত শীত প্রধান হইত।* পৃথিবীর কোটি সন্নিহিত প্রদেশে সর্ব্বাপেক্ষা সূর্য্যের উত্তাপ বেশী এ জন্য সেখানকার জল হইতে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক পরিমাণে বাষ্প উঠিতে থাকে; এবং সেই বাষ্পে পরিণত জলরাশির স্থান গ্রহণ করিবার জন্য মেরুর নিকটস্থ শীতল জলের স্রোত বহিতে থাকে।
* ব্যারণ দে লেসেপ যে পানামার যোজকে খাল কাটিবার প্রস্তাব করিয়াছেন, এক খানি আমেরিকা দেশীয় সংবাদ পত্র তাহাতে একটি গূঢ় অভিসন্ধি দেখিয়া বলেন যে, ফ্রান্সের চিরশত্রু ইংলন্ডের অনিষ্ট সাধনের জন্যই এ প্রস্তাব। পানামার খাল কাটা হইলে ইংলন্ডের জীবন রক্ষক ঔপসাগরিক উষ্ণ স্রোত এই নূতন পথে প্রবাহিত হইয়া ইংলন্ডকে বাসের অযোগ্য করিবে। ইহা বোধ করি, কবি রামদাস শর্মার ভারত-উদ্ধারের পাশ্চাত্য সংস্করণ।
এক কথায় বলিতে এই জগতে যদি উষ্ণতার বৈষম্য না থাকিত তাহা হইলে জগতের সমস্ত জীবন-রক্ষণ-কার্য্য একেবারে বন্ধ হইয়া যাইত। অথচ উষ্ণতার একটি বিশেষ গুণ এই দেখিতে পাওয়া যায় যে চতুষ্পার্শ্বে সমান ভাবে বিস্তৃত হইবার দিকে ইহার প্রবণতা। কোন স্থানে কোন একটা অত্যন্ত উষ্ণ বস্তু রাখিলে ক্রমে তাহার উষ্ণতা চারিপাশে সমান ভাবে বিস্তৃত হইতে থাকে । একটা গরম ও একটা শীতল বস্তু এক সঙ্গে রাখিলে কিছুক্ষণ পরে উভয়েরই উষ্ণতা সমান হয়, শীতল বস্তু যতটা উষ্ণতা পায়, উষ্ণ বস্তু ততটা হারায়। ইহাকেই বৈজ্ঞানিকেরা আয়-ব্যয়ের নিয়ম (Law of Exchange) বলেন। এবং সকল প্রকার তেজই (Energy) ক্রমে উষ্ণতায় পরিণত হইবার দিকে উন্মুখ। কাজে কাজেই মনে হয় যে, এমন এক সময় আসিবে যখন সকল প্রকার তেজই উষ্ণতায় পরিণত হইয়া জগৎময় সমভাবে বিস্তৃত হইবে। সে অবস্থায় পৃথিবী যে, কেবল চন্দ্রের ন্যায় মৃত হইবে, তাহা নহে, তাহার প্রলয় হইবে।
প্রলয়ে গ্রহের মৃতদেহের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব পর্যন্ত থাকে না। আমরা জীবন, মৃত্যু কাহাকে বলে দেখিয়াছি; এখন, প্রলয় কাহাকে বলে তাহা সবিস্তারে আলোচিত হইতেছে । সকলেই জানেন যে দুই শক্তির কার্যফলে গ্রহ স্বীয় কক্ষ হইতে বিচ্যুত না হইয়া সূৰ্য্যকে প্রদক্ষিণ করে। প্রথম, সূর্য্যের নিজাভিমুখে আকর্ষণ অথবা কেন্দ্রানুগ শক্তি (Centripetal Force) । দ্বিতীয়, সৌর আকর্ষণ অতিক্রম করিয়া গ্রহের সরল রেখা পথে পলায়নের চেষ্টা অথবা তাহার কেন্দ্রাতিগ শক্তি (Centrifugal Force)। যদি কখনও কোন জ্যোতিষ্কের এমন অবস্থা হয় যে তাহার কেন্দ্রাতিগ শক্তি অতীব অল্প হইয়া পড়ে, তাহা হইলে সূর্য্যের আকর্ষণের প্রভাব বৃদ্ধিহেতু সেই জ্যোতিষ্ক ক্রমে সূর্য্যের উপর গিয়া পড়ে এবং তাহার প্রচণ্ড উত্তাপে তাহা বাষ্পাকারে পরিণত হয়। এইরূপ সূর্য্যের গ্রাসে পতিত হওয়াকেই গ্রহের প্রলয় বলা যাইতে পারে। পৃথিবীতে যখন উত্তাপের সাম্য হইবে, তখন পৃথিবী গতি শক্তিহীন হইয়া পূর্ব্বোক্ত প্রকারে বিনষ্ট হইবে।**
* জ্যোতির্ব্বেত্তারা বলেন ধূমকেতু ও গ্রহ খণ্ড মাঝে মাঝে সূর্য্যের উপর এইরূপে পড়িয়া তাহার চিরন্তন প্রচণ্ড উত্তাপ সমান ভাবে রক্ষা করিতেছে। ** এইরূপে অনেক গুলি গ্রহ উপগ্রহ সূর্য্যের সহিত মিশিয়া গেলে সেই মিশ্রিত পদার্থ সমষ্টির কতক অংশ আঘাত জনিত উত্তাপে বাষ্পাকারে পরিণত হয়; ক্রমে আবার তাহা হইতে নূতন গ্রহ উপগ্রহ সৃষ্টি হইতে পারে। অনেক বৈজ্ঞানিকদিগের মত যে বর্ত্তমান গ্রহ উপগ্রহ এইরূপ জ্বলন্ত বাষ্পরাশি হইতে ক্রমে অভিব্যক্ত হইয়াছে। প্রকৃত পক্ষে, এই মঙ্গলময় ঈশ্বরের রাজ্যে কিছুই একেবারে বিনষ্ট হয় না, রূপান্তরিত হয় মাত্র।
ইহা হইতে স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, একটা জ্যোতিষ্কের জীবন রক্ষণেরপ্রধান কারণ তাহার গতি; কাজেই পৃথিবীর মৃত্যু চিন্তা করিতে গেলে তাহার গতির বিষয় আলোচনা আবশ্যক। যদি আবহমান কালের মধ্যে পৃথিবীর গতির কোন বৈলক্ষণ্য না দেখা গিয়া থাকে তাহা হইলে পৃথিবীর পরিণামের বিষয় এ সূত্র হইতে কিছুই ঠিক করিতে পারা যায় না। কিন্তু বহুকালব্যাপী জ্যোতিষিক অনুসন্ধান দ্বারা বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন যে, পৃথিবীর গতির কিছু লাঘব হইয়াছে। যদিও ইহার মাত্রা চুলের মত বই নয়, তথাপি ইহা হইতে পৃথিবীর গতিহ্রাস সপ্রমাণ হইয়াছে । অতি প্রাচীন কাল অপেক্ষা চন্দ্রের গতি এখন কিছু বৃদ্ধিশীল বলিয়া হঠাৎ মনে হয়। ইংরাজি ভাষায় ইহাকে Secular acceleration of the moon’s mean motion বলে। কিন্তু চন্দ্রের গতি বৃদ্ধি হওয়া অতিশয় অসম্ভব বলিয়া বৈজ্ঞানিকেরা ঠিক করিয়াছেন। চন্দ্রের গতি আসলে বাড়ে নাই, পৃথিবীর গতি হ্রাস হেতু চন্দ্রের গতি বাড়িয়াছে বলিয়া মনে হয়। তাঁহারা বলেন চন্দ্রের গতি বৃদ্ধির কোন কারণই তাঁহারা দেখেন নাই। গতি বৃদ্ধির অর্থই কার্য্যের বৃদ্ধি, ও শক্তি না হইলে কাৰ্য্য হইতে পারে না অতএব চন্দ্রের গতি বৃদ্ধির অর্থই এক নূতন শক্তির আবির্ভাব।
কিন্তু কোথা হইতে এ নূতন শক্তির আবির্ভাব হইবে ? জগতের শক্তি-সমষ্টির কখনও বৃদ্ধি হইতে পারে না ; ইহা জগতে চিরকাল সমান আছে ও থাকিবে । শক্তি রূপান্তরিত হয় মাত্র, তাহার ক্ষয় বৃদ্ধি সম্ভবে না—ইহাকেই বৈজ্ঞানিকেরা শক্তিসংরক্ষণ (Conservation of Energy) কহেন। এরূপ না হইলে প্রাকৃতিক নিয়মাবলী নিত্য সমান ভাবে রক্ষিত হইত না, তাহাতে বৈলক্ষণ্য হইত প্রাকৃতিক নিয়মের নিত্যতার (Uniformity of Natural Laws) উপরেই সমস্ত বিজ্ঞান শাস্ত্র অবস্থিত। এবং যেহেতু চন্দ্রের গতি-বৃদ্ধির কোন কারণ দেখা যায় না, অতএব ইহা নিশ্চয় যে, চন্দ্রের গতি বৃদ্ধি হয় নাই। তবে গতি বৃদ্ধি হইয়াছে বলিয়া মনে হয় কেন ? বৈজ্ঞানিকেরা বলেন, পৃথিবীর গতি হ্রাস হইয়াছে বলিয়া ঐরূপ মনে হয়। কিন্তু এই রূপ কেবল একটা অনুমান কখন কোন একটা মতের ভিত্তি হইতে পারে না। পৃথিবীর গতি হ্রাস করিতে প্রত্যক্ষ পক্ষে যত্নশীল কোন বিশেষ কারণ দেখিতে না পাইলে আমরা উপরি উক্ত যুক্তিকে নিতান্ত আনুমানিক বলিয়া অবহেলা করিতে পারিতাম ; কিন্তু ঐরূপ একটি প্রত্যক্ষ কারণ বৈজ্ঞানিকেরা নির্ধারিত করিতে পারিয়াছেন। সমুদ্রের জলের এক প্রকার গতি আছে যাহাকে আমরা জোয়ার ভাঁটা বলি। এই জোয়ার ভাঁটা পৃথিবীর গতি অপহরণ করিয়া তাহার প্রাণ বিনাশে যত্নশীল। পৃথিবীর স্থলীয় ও জলীয় অংশের উপর চন্দ্রের আকর্ষণের বৈষম্য, (Differential Attraction) এই জোয়ার ভাঁটার প্রধান কারণ*। সূর্য্য এতদূরে অবস্থিত যে তাহার জল ও স্থলের উপর প্রায় সমানই আকর্ষণ, তাহার বৈষম্য অতি কম ; সেই জন্য সূর্য্যের সহিত জোয়ার ভাঁটার গৌণ সম্পর্ক । চন্দ্র জলরাশিকে আকর্ষণ দ্বারা ফাঁপাইয়া তোলে কিন্তু কোথা হইতে সে জলরাশির পার্শ্বগামী গতি হয় ? চন্দ্র ত আর তাহাকে অন্য কোন দিকে গতি দিতে পারে না, এবং বাহিরের কোথা হইতেও গতি পাইবারও সম্ভাবনা নাই। তবে এ গতি কোথা হইতে আসে ? চন্দ্র কর্তৃক উন্নমিত এই জলরাশি পৃথিবীর ঘুরিবার সময় তাহার কঠিন স্থল অংশের সহিত ঘর্ষণে সেই স্থলভাগের গতি লইয়া গতি পায় ৷ এই – কথাটি হৃদয়ঙ্গম করাইবার জন্য একটি সামান্য দৃষ্টান্ত দেখানো যাউক। একটি গোলা চালাইয়া একটি স্থির গোলাকে আঘাত করিলে যেমন সেই গমনশীল গোলার শক্তি পাইয়া স্থির গোলাটি চলিতে থাকে, তেমনি পৃথিবীর ঘূর্ণমান কঠিন অংশের আঘাতে গতি পাইয়া জলরাশি চলিতে থাকে ।
* শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় তৃতীয় ভাগ চারুপাঠের ১২৭ পূঃ “জোয়ার ভাঁটা” শীর্ষক প্রস্তাবে বলিয়াছেন, “চন্দ্র অবশ্যই পৃথিবীর স্থল জল উভয় ভাগই আকর্ষণ করে, কিন্তু স্থল ভাগ কঠিন ও দৃঢ়, এ নিমিত্ত বিচলিত হয় না। জল ভাগ অতিশয় তরল এই জন্য চন্দ্রের আকর্ষণে চলিত ও স্ফীত হয়।” ঐ পুস্তকের ১২১ পূঃ তিনি আবার বলিয়াছেন, “পৃথিবীর কেন্দ্র চন্দ্ৰ কর্তৃক আকৃষ্ট হইয়া চন্দ্রের দিকে উত্থিত হয়” এই দুইটির অর্থ পরস্পর-বিরোধী। বোধ হয় কেবল ভাষা সংক্ষেপ করিবার জন্যই ওরূপ অর্থের বৈপরীত্য হইয়াছে। তবে অক্ষয় বাবু যে বলিয়াছেন যে চন্দ্রের আকর্ষণে জল “চলিত” হয়—ইহা ঠিক নহে। এ বিষয় মূল প্রবন্ধে সবিস্তারে আলোচিত হইয়াছে। আসল কথাটা এই, আকর্ষক ও আকৃষ্ট বস্তুর মধ্যে দূরত্ব বাড়িলে আকর্ষণের প্রভাব হ্রাস হয়, এবং তরল বস্তুর কোন এক অংশ অপর অংশ হইতে সহজেই বিচ্ছিন্ন হয় কিন্তু দৃঢ় বস্তুর সে রকম হয় না। এই কারণে কোন তরল বস্তু আকৃষ্ট হইলে, তাহার উপরিভাগেই আকর্ষণের কার্য আরম্ভ হইয়া সে তরল বস্তুকে সহজে স্ফীত করে, এবং দৃঢ় বস্তু আকৃষ্ট হইলে তাহার কেন্দ্রে আকর্ষণের কার্য্য আরম্ভ হইয়া তাহার সমুদায় অংশকে এক সময়ে সমানভাবে (as a whole) আকর্ষণ করে। কিন্তু জলের উপরিভাগ হইতে পৃথিবীর কেন্দ্রের দূরত্ব প্রায় ৩৫০০ মাইল বলিয়া জল অপেক্ষা স্থল ভাগের উপর চন্দ্রের আকর্ষণের প্রভাব কম হয়, সেই জন্য স্থল অপেক্ষা জলভাগ অধিক স্ফীত হইয়া উঠে। সূর্য্য হইতে পৃথিবীর দূরত্ব এত অধিক যে তাহার তুলনায় ৩৫০০ মাইল কিছুই নহে, কাজেই জল স্থলের উপর সূর্য্যের আকর্ষণের বৈষম্য অতি অল্প। সেই জন্য বাস্তবিক পক্ষে পৃথিবীর উপর সূর্যের আকর্ষণ শক্তি চন্দ্রের অপেক্ষা অধিক হইলেও তাহাতে চন্দ্রের আকর্ষণের মত জলকে স্ফীত করিতে পারে না। চন্দ্র অপেক্ষাকৃত পৃথিবীর অনেক নিকটে অবস্থিত বলিয়া ৩৫০০ মাইলেই তাহার আকর্ষণের অনেক তারতম্য হয়।
পৃথিবী যে জলকে এইরূপ গতি দেয়, পৃথিবী এ শক্তি কোথা হইতে পায় ? সে ত আর অন্য কোন স্থান হইতে নূতন শক্তি পাইয়া জলকে চালাইতে পারে না, নিজের গতিশক্তিরই অংশ দিয়া জলকে চালায়। ইহাতে স্পষ্টই দেখিতে পাওয়া যায় যে, এইরূপে পৃথিবীর গতি শক্তির কিছু লাঘব হয়। পূর্ব্বের দৃষ্টান্তে উল্লিখিত গোলার মধ্যে যদি দুইটিরই সমান ডার ও আয়তন হয়, তাহা হইলে স্থির গোলাকে চালাইতে গিয়া গমনশীল গোলা শীঘ্রই থামিয়া যায় এবং তাহার গতি পাইয়া স্থির গোলা চলিতে থাকে। যদি পৃথিবীর স্থলীয় অংশ ও তাহার সহিত যে জলরাশির ঘর্ষণ হয়, এ দুয়ের ভার সমান হইত তাহা হইলে পৃথিবীর গতিও থামিয়া যাইবার সম্ভাবনা হইত । সমান নহে বলিয়াই তাহার গতির কেবল অল্প মাত্র বেগহ্রাস হয়। এ বিষয়ে আর একটা দৃষ্টান্ত দেখা যাউক। যদি একটি দ্রুতগামী চাকার উপর এক খণ্ড প্রস্তর কোন প্রকারে রাখা যায় তাহা হইলে চাকার গতি পাইয়া সেই প্রস্তর খন্ড দূরে চলিয়া যায়, কিন্তু এই কার্য্যে যতটুকু শক্তি ব্যয়িত হয়, তাহা চাকার গতির হিসাবে খরচ পড়ে। উহাতে দ্রুতগামী ঢাকার কিছু বেগ কমিয়া যায়। সেই রূপ দেখা যায়, পৃথিবীর গতিশক্তি পূর্ব্বোক্ত কারণে কিছু কমিয়া গিয়াছে। এখন, পৃথিবীর নিজের চারিদিকে ঘুরিতে পূর্ব্ব অপেক্ষা অধিক সময় লাগে, কাজে কাজেই দিবসের দৈর্ঘ্য এখন কিছু বাড়িয়াছে। এই জন্যই চন্দ্রের গতির বৃদ্ধি হইয়াছে, অর্থাৎ পূর্ব্বাপেক্ষা অল্প সংখ্যক দিবসে চন্দ্র ঘুরিতেছে মনে হয়।
ইহা ব্যতীত পৃথিবীর গতি-লাঘব হইবার আর একটা কারণ দেখিতে পাওয়া যায়। নানা প্রকার বৈজ্ঞানিক যুক্তি দ্বারা স্থির হইয়াছে যে আকাশের এমন কোন স্থানই নাই যেখানে ঈথর (Ether) না আছে। যদিও ঈথর এত সূক্ষ্ম যে উহা মাধ্যাকর্ষণের অধিকার বহির্ভূত বলিয়া কল্পিত হয় ; তথাপি বৈজ্ঞানিকেরা বলেন যে ঈশ্বরের সহিত ঘর্ষণেও শক্তির হানি হয়; এইরূপ বলিবার কারণ এই যে, একি দ্বারা আবিষ্কৃত একটি ধূমকেতুর কক্ষ ক্রমশই ছোট হইয়া আসিতেছে অর্থাৎ ক্রমশই ঐ ধূমকেতুর কেন্দ্রাতিগ গতি কমিয়া যাইতেছে। ইহার অন্য কোনই কারণ দেখিতে পাওয়া যায় না কাজে কাজেই বৈজ্ঞানিকেরা ঐরূপ বলিতে বাধ্য হইয়াছেন। যদি একটা জ্যোতিক ঈশ্বর ঘর্ষণে শ্লথগতি হইতে পারে তবে অন্যান্য জ্যোতিষ্কই বা কেন সেরূপ না হইবে ? এই কারণ হইতে যদিও অতি অল্পই ফল হইবার সম্ভাবনা তথাপি ইহাও পৃথিবীর মৃত্যুর অন্য কারণের সহায়তা করিতে পারে। এই ত দেখিতে পাওয়া গেল পৃথিবীর গতি কমিবার দিকে উন্মুখ। এই কাৰ্য্য অপ্রতিহত ভাবে চলিলে কালে যে পৃথিবী সূর্য্যে মিশাইয়া যাইবে ইহাই সম্ভাব্য। বলিবার আবশ্যক নাই, এই ঘটনার অনেক পূর্ব্বেই পৃথিবীতে আর জীবের বসতি থাকিবে না, পৃথিবী চন্দ্রের মত হইয়া পড়িবে।
বর্তমান বৈজ্ঞানিকদিগের মতানুসারে পৃথিবীর বিনাশ এক প্রকার নিশ্চিত বলিয়া মনে হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে নূতন সত্যের আবিষ্ক্রিয়া সহকারে এত অধিক বৈজ্ঞানিক মত পরিবর্ত্তিত হইয়াছে যে সে বিষয়ে উদাহরণ সংগ্রহের প্রয়োজন নাই। এখন উপরে সন্নিবেশিত মতগুলি যে কালে পরিবর্তিত কিম্বা পরিত্যক্ত হইবে না—ইহাই বা কে নিশ্চয় বলিতে পারে ? চন্দ্র যে প্রকার মন্দগতি হইয়াছে, তাহাতে বৈজ্ঞানিকদিগের উপরি-উক্ত মতানুসারে পৃথিবীর আগেই তাহার অস্তিত্ব লোপ হইবার সম্ভাবনা। এবং চন্দ্র না থাকিলে জোয়ার ভাঁটার প্রভাব অনেক কমিয়া যাইবে, সুতরাং এ কারণ হইতে পৃথিবীর জীবন হ্রাসের সম্ভাবনাও অনেক কমিয়া যাইবে। কিন্তু পৃথিবীর সহিত চন্দ্রের যে প্রকার সম্পর্ক তাহাতে চন্দ্র না থাকিলে পৃথিবীর যে আবার কত প্রকার অনিষ্ট হইবে তাহা এখানে বলা বাহুল্য ।
(ভারতী, ভাদ্র ১২৮৭)
Comment here