-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
কলম্বিয়া বলতে প্রথমেই যে দুটো শব্দ মনে আসে তা হল ভালদেরামা ও হিগুইতা। আর তৃতীয় শব্দটি এস্কোবার। তিনজন ফুটবলারের নাম। তাদের ফুটবল উন্মাদনা আসলে ইউরোপীয়দের দান। তার বিনিময়ে বলি দিতে হয়েছে জেনুকে। জেনু কোনও ব্যক্তির নাম নয়, এ এক সভ্যতার নাম যার ব্যাপ্তি ছিল ২০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, ইউরোপীয়রা এখানে আসার আগে। নদীমাতৃক এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল জেনু বা সিনু নদীর উপত্যকায়।
মরোস্কুইলো উপসাগর থেকে কিছুটা দূরে গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা। বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জলসম্পদ রক্ষা ও বণ্টন আর অলঙ্কার তৈরি, এই ছিল জেনুর পাশে গড়ে ওঠা মানুষের প্রধান কাজ। জীবন শেষ হলে অন্তিম শয্যায় দেওয়া হত অসংখ্য অলঙ্কার। স্পেনের লোকজন একথা জানা মাত্রই মরিয়া হয়ে গোরস্থান খুঁজে সেই অলঙ্কার নিয়ে যেতে শুরু করল নিজেদের দেশে। সন্ধান পেল এলডোরাডোর। সোনার বিনিময়ে তারা দিল ইউরোপের রোগ, যা দেখা দিল মহামারী রূপে। বিস্তীর্ণ এলাকা অবহেলে দখল করে চাপিয়ে দিল বিপুল করের বোঝা। অত্যাচারে হারিয়ে যেতে থাকল সভ্যতা, সংস্কৃতি, ভাষা। বদলে যেতে থাকল ধর্ম।
১৭৭৩ সালে তাদের বাঁচার উপায় করে দিলেন স্পেনের রাজা। যে দেশ তাদের নিজের, সেই দেশের ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে বেঁধে দেওয়া হল জেনু সভ্যতার ধারকদের। তারপরে আর পঞ্চাশ বছরও কাটেনি, প্রায় হারিয়েই গেল তাদের ভাষা, চিরতরে। ১৯০৫ সালে তাদের ওই জায়গাটুকু থেকেও সংরক্ষণ কেড়ে নেওয়া হল। শুরু হল লড়াই। ১৯৯০ সালে তারা অধিকার হিসেবে পেল ১০ হাজার একর। আরও পেল। ১৯৯৬ থেকে পরপর তিন বছর কলম্বিয়ার ১০০০ পেসো মুদ্রায় উৎকীর্ণ করা হল একটা দুল, যা জেনু সভ্যতার স্মারক।
জেনু বা জেনিউ। মুদ্রায় হারানো সভ্যতার দ্বিতীয় পর্বে হারিয়ে যাওয়া সেই সভ্যতা আর সেই অলঙ্কারের কথা, যা আমাদের দেশের অনেকেরই অজানা।
মুদ্রায় যে অলঙ্কারের ছবি রয়েছে তা দেখে আদতে ফেলিগ্রি বলে মনে হলেও, সোনার এই অলঙ্কার তৈরি হত আমাদের ডোকরার জিনিস তৈরি করার মতো করে। মানে মোমের অলঙ্কার গড়ে সেটি জমিয়ে ফেলা হত মাটিতে। তাতে গরম সোনা ঢেলে দিলেই মোম গলিয়ে সেই জায়গা দখল করে নিত সোনা। তৈরি হয়ে যেত অলঙ্কারের আদল। মাটি ভেঙে সেটি বের করে আনা হত। তারপরে সেটির বিভিন্ন অংশে সূক্ষ্মভাবে পিটিয়ে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হত। এই অলঙ্কারের সহজলভ্য ছবিটি রয়েছে আমেরিকার টেক্সাসের সান আন্তোনিও মিউজিয়াম অফ আর্টে। কলম্বিয়া তো বটেই, অন্য কয়েকটি দেশের জাদুঘরেও রয়েছে এই সভ্যার সোনার নিদর্শন। এই পদ্ধতিতে সোনার অলঙ্কার আর তৈরি করেন না জেনু নদীর ধারের মানুষজন।
২০১৪ সালে কিংবদন্তীর এলডোরাডোর কথা নতুন করে উঠে আসে যখন কলম্বিয়ার বোগোটা থেকে ২৩টি অনন্য নিদর্শন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দেখানো হয়। সেই তালিকায় ছিল অলঙ্কার, মুখোশ, খেলনার মতো জিনিস – সবই সোনার। সোনা আর সোনা। তাই অনেকে মনে করেন আন্দিজের কোলেই ছিল সেই স্বপ্নের দেশ, সোনার দেশ, এলডোরাডো। শুধু সোনা নয়, প্রাচীন কালে রুপো ও তামার জিনিস তৈরির কৌশলও জানতেন জেনু উপত্যকার বাসিন্দারা।
২০০ খ্রিস্টপূর্ব আগে জেনু উপত্যকার মানুষ খাল কেটে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। তারপরে কোনও প্রায় এগারোশো বছরে অনেকটাই কমে যায় জনঘনত্ব। তবুও বজায় ছিল স্বাতন্ত্র্য। তা গেল আরও সাড়ে আটশো বছরে। আর এখন এই সভ্যতার উত্তরাধিকারী বলা চলে এমন মাত্র দুই থেকে আড়াই লক্ষ মানুষ রয়েছেন। তাঁদের নিজের সংস্কৃতি ও ভাষা হারিয়ে গেছে বলাই যায়। নতুন করে ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে সেই ভাষা, ধাতুর কাজ আর বয়ন। বয়ন কিছুটা হলেও ফিরেছে, তবে তাতে অবশ্য দারিদ্র্য কাটছে একথা হলফ করে বলা যায় না। স্বাচ্ছন্দ্য ফেরা বা ঐতিহ্য উদ্ধার হওয়ার আশু সম্ভাবনা এখনও নেই।
(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)
Feature Image Courtesy: World History Encyclopedia
বেশ ভাল লেখা।