সংস্কৃতি

‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী’ – অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়

শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ছিলো জহুরীর চোখ। তাই তো শান্তিনিকেতনে পড়তে আসা গৌরবর্ণ,সুদর্শন,ছিপছিপে চেহারার অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঠিক চিনেছিলেন।তাঁর ডাকনাম ছিলো তরু।দুটি নামকে মিলিয়ে শৈলজারঞ্জন নামকরণ করলেন অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়।তিনি শুধু শিল্পী ছিলেন না তিনি ছিলেন শিক্ষক ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধক।

তাঁর বাবা ছিলেন শান্তিনিকেতনের ছাত্র এবং মহাত্মা গান্ধীর অনুরাগী।বলা যায় পিতার আগ্রহতেই অশোকতরু শ্রী রবীন্দ্রলাল রায়ের কাছে সঙ্গীতের তালিম নেন।পরবর্তীতে যখন বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনে তিনি ভর্তি হলেন তখন সেখানে ইন্দিরা দেবী,শৈলজারঞ্জন মজুমদার ও অনাদিকুমার দস্তিদারকে পেলেন গুরু হিসেবে।একই ভাবে পন্ডিত ভি.ভি. ওয়াঝেলওয়ার ও পরবর্তীতে সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করলেন।

স্বাধীনতাপ্রাপ্তির প্রায় সমসাময়িক সময় থেকেই অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় আকাশবাণীতে গান গাওয়া শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি আকাশবাণীর নিয়মিত শিল্পী হয়ে ওঠেন।শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া নয় – তিনি যেন সমগ্র রবীন্দ্রজীবনদর্শনকে আত্মস্থ করেছিলেন।রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন তাঁর জীবনদেবতা।

প্রকাশিত হতে লাগলো একের পর এক রেকর্ড।গ্রামাফোন কোম্পানী বা হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত সেইসব রেকর্ড শ্রোতাদের কাছে সমাদৃত হতে শুরু করলো।এর পাশাপাশি মঞ্চে রবীন্দ্রনৃত্যনাট্য পরিবেশনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিলেন।বাল্মীকি প্রতিভায় দস্যু রত্নাকরের ভূমিকা বা ফাল্গুনী নাটকে তাঁর গান ও অভিনয় প্রশংসিত হলো।বহুরূপীর প্রযোজনায় বিখ্যাত নাটক পাগলা ঘোড়াতে অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনা উল্লেখ করার মতো।এইসময় তিনি আর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন।তা হলো এককভাবে মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনা।১৯৬৭ সাল থেকে নিয়মিত ভাবে তিনি এই কাজ করতে শুরু করেছিলেন।তিনি ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা মিলে রবীন্দ্রগান ও কবিতা নির্ভর বিভিন্ন গীতি আলেখ্য যেমন ‘ নীলাঞ্জনছায়া’,’ দিবস ও রজনী’ ‘ রূপান্তরী ‘ ইত্যাদি মঞ্চে পরিবেশন করতেন।যাঁরা সেইসময় সেসব প্রযোজনা দেখেছেন তাঁদের কাছে সেসব বড়ো সুখস্মৃতি।

ব্রহ্মসঙ্গীত ও রবীন্দ্রনাথের হাসির গান সাধারণ শ্রোতার মাঝে জনপ্রিয় করবার ক্ষেত্রে অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবিশেষ অবদান রয়েছে। বিশেষ করে ব্রাহ্মসমাজের নানা অনুষ্ঠানে সংস্কৃত বৈদিক মন্ত্র জলদগম্ভীর কন্ঠে সুর দিয়ে পরিবেশন করে তিনি সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন।রবীন্দ্রনাথের হাসির গান যেমন ‘ ও ভাই কানাই’,’ স্বর্গে তোমায় নিয়ে যাবো উড়িয়ে’,’ কথা কোস নে লো রাই’,’ কত কাল রবে বলো ভারত রে’,’ প্রিয়ে তোমার ঢেঁকি হলে’,’ কাঁটাবন বিহারিণী’ ইত্যাদি গান অশোকতরু অত্যন্ত বৈঠকী মেজাজে পরিবেশন করতেন।সেসব গানের লংপ্লেয়িং রেকর্ড বা ক্যাসেটও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিলো।

রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য।কলকাতার নামী রবীন্দ্রসঙ্গীত সংস্থা দক্ষিণী ও গীতবিতানে গান শিখিয়েছেন দীর্ঘকাল।নিজে গড়ে তুলেছিলেন শ্রুতি সংস্থা।আকাশবাণীতে দীর্ঘদিন পরিচালনা করেছিলেন সঙ্গীতশিক্ষার আসর।শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন আশ্রমিক সংঘর সম্পাদক ছিলেন অশোকতরু।বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন অতিথি অধ্যাপক।

শ্রীলংকার সরকারের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৮১ সালে কলম্বো সফর করেন এবং সেখানকার বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রগানের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন ও গান পরিবেশন করেন।১৯৯২ সালে টরেন্টো ও মিডল্যান্ডে তিনি আমন্ত্রিত হন এবং বিবিসি থেকে তাঁকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয় আকাশবাণীর অডিশান বোর্ড,বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি,রাজ্য সঙ্গীত একাডেমী প্রভৃতি সংস্থার সম্মানীয় সদস্য ছিলেন অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়।সহজ,সরল,আত্মমগ্ন এই শিল্পী ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিলো তাঁর ধ্যান জ্ঞান এবং মনন ও চিন্তনে একাকার।

রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গান যেন অশোকতরুর জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। ‘পিনাকেতে লাগে টংকার’,’ আমরা দূর আকাশের নেশায় মাতাল’,’ সহে না যাতনা’,’ ঝড়ে যায় উড়ে যায়’,’ আজ আসবে শ্যাম গোকুলে ফিরে’,’ আমার নিখিল ভুবন হারালেম’,’ আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’,’ জননীর দ্বারে আজি’,’ বাংলার মাটি বাংলার জল’,’ তোমার বীণায় গান ছিল’,’ লহো লহো তুলে লহো’,’ থাকতে আর তো পারলি নে মা’,’ হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই’,’ ইত্যাদি গান যেন অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে আলাদা মাত্রা যোগ করতো।

আমার সুযোগ হয়েছে বেশ কয়েকবার তাঁর গান সামনে থেকে শোনবার।সামান্য যন্ত্রাণুষঙ্গ সহকারে সঙ্গীত পরিবেশন করে শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দিতেন তিনি।

১৯৩০ সালের ১৫ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন।মাত্র ৬৬ বছর বয়সে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে তাঁর জীবনাবসান হয়।বর্তমানে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের ক্ষেত্রে এসেছে নানা পরিবর্তন।বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে এই গান কে নিয়ে।তবু আজও অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান শুনলে মনে হয় এইজন্যই তো রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের প্রাণের আরাম আত্মার শান্তি।

Comment here