শাশ্বত সনাতন

~ আলাপ ~

বাবুলি

* আরোহন *

ঠিক ঘর বললে ভুল হবে। ক্রমশ ভঙ্গুর একটা ছোট্ট আস্তানা বলা যেতে পারে। এদিক-ওদিক ত্রিপল দিয়ে জোড়াতাপ্পি দেওয়া ছাদটুকু। ছোট্ট কুঠুরিটুকুতে ভালো করে পাশ ফেরাও যাবে না হয়ত। তার সাথেই লাগোয়া এক টুকরো মাটির দাওয়া।

বাইরে থেকে বললাম, আমরা আশ্রম থেকে আসছি … ঘরের ভেতরের নীল পাড় সাদা শাড়ির আপাত অন্যমনস্কা কোনো সাড়া দিলেন না। পেছন ফিরে কাকাসনে ব’সে কিছু একটা কাজে আত্মনিমগ্ন। ঈষৎ ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখলেন আমাদের। ঠিক কতখানি দেখলেন তাও বোঝা গেল না। ততক্ষণে বাকি দু’জন গুরুভাইদের ব’লে পাশের বাড়ির উঠোনে এক মায়ের কাছে তখন বলছি ‘আগামী ২৫’শে ডিসেম্বর আমাদের আশ্রমে বাৎসরিক উৎসব …আমন্ত্রণ …

আন্তরিক ভাব বিনিময়ের পালা শেষ হয়ে গেছে অথচ আগের বাড়ির থেকে দু’জন গুরুভাই এখনো ফিরল না! যথারীতি প্রত্যাবর্তন আগের বাড়িতে। আশি ঊর্ধ্ব নীল পাড় সাদা শাড়ির অভিসারিকা নিজের কুটিরের ভেতরের প্রেমের দেবতার কাছে প্রেম নিবেদন সম্পন্ন করেছেন। বাইরে অপেক্ষারত গুরুভাইদের ছোট ছোট রেকাবিতে শসা, কলার প্রসাদ নিবেদন করেছেন। ওরা সানন্দে গ্রহণ করছে। এমন করেই প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষি পুজো ক’রে মা প্রসাদ দিত আমাদের। গ্রীষ্মকালে শসা, কলার সাথে অতিরিক্ত সংযোজন হত আমের টুকরো আর শীতকালে খেজুর গুড়ের সন্দেশ একটা করে।

দুই গুরুভাই’এর সামনে যেতে ওরা আমার দিকে খুব একটা দৃষ্টিনিক্ষেপ করলো না। শুধু আমার দিকে প্রসাদ এগিয়ে দিল ওরা। প্রসাদ গ্রহণ করছি। এক ছটাক মাটির দাওয়া থেকে নেমে আসছেন অভিসারিকা …
‘সে আসবে তো …’ (কিঞ্চিৎ স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে)
‘আসবে তো সে …’
ধীরে ধীরে মুখ তুললেন আমাদের দিকে। আমরাও কিছুটা এগিয়ে গেলাম। বয়সের ভারে খুব ভালো করে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেন না। কিছুটা দাঁড়িয়ে, কিছুটা ব’সে অভিসারিকা যেন আরও উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। আমরা আরও কিছুটা ওনার কাছাকাছি যেতে, হৃদয়ের সমস্ত প্রার্থনা, সবটুকু প্রেম, কোনোদিন শেষ না হওয়া অপেক্ষা এক ক’রে সম্পূর্ণ মুখ তুলে বুকের মধ্যে হাতজোড় ক’রে বললেন,
‘সে আসবে তো …’ বলতে বলতে মনিমুক্তোর মত বহুদিনের নিভৃতে জমানো ফল্গুর গতিধারা উপচে আসছে চোখের নিকষ থেকে। হয়ত হৃদয় গ্রন্থির অকৃত্রিম এক আদি বেদনার বহিঃপ্রকাশ হবে।
বললাম,
আসবে। নিশ্চিত জেনো আসবে।
‘আসবে …!’
অভিসারিকার কন্ঠে তখন বিনম্র আনন্দ। চোখ থেকে ফল্গু তখন ভাঙা ভাঙা গালদুটোতে নতুন কোনো নদীর জন্ম দিচ্ছে।
আরো বললাম,
তুমি এরকম করে ভাবছো কেন! সে তো আছেই। সবসময় আছে তোমার সাথে, তোমার ভেতরে।

অনেক বছর ধ’রে অনেক চেষ্টা, অনেক অপেক্ষা, অনেক প্রার্থনার পর যখন নিশ্চিত ক’রে কোনো নারী জানতে পারেন, এবারে তিনি মা হতে চলেছেন। তখন তার নিভৃতের যে আনন্দ। ঠিক সেইরকম বাঁধনহীন কোনো নদীর মত অবশ্যম্ভাবী স্রোত, আশি পেরোনো অভিসারিকার ভাঙাচোরা চিবুকের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। প্রণামের মুদ্রায় হাতদুটো নিজের কপালে ঠেকিয়ে অযাচিত এক ক্ষিপ্রতায় মাথা ঠেকালেন আমার পায়ে। নমস্কারের ভঙ্গিতে আমিও করজোড়ে হাতদুটো আমার কপালের বিন্দুতে ছোঁয়ালাম। চোখ বন্ধ করে আন্তরিক প্রার্থনা নিবেদন করলাম গুরুমহারাজের কাছে।

অভিসারিকার কন্ঠে তখন শিশুর মতন কান্না। কিছু পরে মুখ তুলতে আমারও নিমীলিত চোখের পাতা খুলে গেল। জড়িয়ে ধরলাম অভিসারিকাকে, আমাকেও গভীর এক বিশ্বাস নিয়ে আলিঙ্গন করলেন। মাথা নিচু করে আরো একবার নমস্কার জানালাম আমার দেখা মীরা’কে।

* অবরোহন *
দোকানের সামনে হরেক রকম পসরা। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, আনাজপাতি, কসমেটিক্স, মুদিখানা, খাতা-পেন সবকিছুই রয়েছে এক দোকানেই। কোনো শপিং মল নয়, পাড়ার মধ্যেই এক দোকান। বাজার হাট দূরে ব’লে এই ব্যবস্থা।
দোকানের ভেতরে দোকানি তখন আয়েস করে প্রেমেরই গান শুনছে। নেপথ্যে উদিত নারায়ণ। বাইরে থেকে বললাম, আশ্রম থেকে এসেছি উৎসবের আমন্ত্রণ জানাতে। মিউজিক সিস্টেমের সাউন্ড যেটুকু কমলো, কাউকে একটু সরে বসতে বললে একটু নড়েচড়ে ব’সে আবার আগের মত বসলে যেমন হয় ঠিক ততটাই কমলো। আমন্ত্রণ সম্পর্কিত আরো কিছু কথা শুনতে শুনতেই হঠাৎ যুবক দোকানী বাইরে বেরিয়ে এলেন।

আমি কিছু দিতে পারবো না।
কিছু দিতেই হবে এমনটা কোনো কথা নেই। আমরা আমন্ত্রণ জানাতে এসেছি। সেটুকু শুনলেই হবে।
না, না আমি এসব কিছু শুনবোও না। কিছু দেবও না।
বেশ, চেষ্টা করবেন ২৫’শে ডিসেম্বরে যাওয়ার …
না, না আমি যাই না।
আলতো হেসে বললাম, আসি।
আসুন …
আমরা তখন দোকানীকে পেছনে ফেলে অন্য বাড়ির দিকে হাঁটছি। বাড়ির সামনে ঢুকতেই পেছন থেকে ঝাঁঝাঁলো স্বরে ভেসে এলো,
ওটা আমারই বাড়ি, ওখানে যাবেন না।
ওর আরো কিছু কথা কিঞ্চিৎ দূরত্ব থেকে তখন কানে ভেসে আসছে,
ইয়ং ছেলে খেটে খাবে তা না আশ্রম দেখাচ্ছে। জীবনে কিছু করতে না পারা সব অলস ছেলেপিলে আশ্রমে গিয়ে বসে আছে …

*মূর্ছনা*

হয়ত বলা যেত অনেকখানি। উত্তর দেওয়া যেত আক্রমনাত্মক। কিন্তু কিচ্ছু বলিনি, বলার আগ্রহটাও আসেনি। স্থান-কাল-পাত্রের সঠিক সমীকরণ হয়ত সেদিন ঘটেনি। শুধু কতগুলো প্রশ্ন এলো ভেতর ভেতর। এই মানুষটা না হয় উচ্চারণ করে এই কথাগুলো বলছে কিন্তু যারা উচ্চারণ না করে বলে যাচ্ছে অবিরাম? কেউ সামনে সামনে খুব ভালোবেসে কথা বলছে, পেছন ফিরলেই ঠিক এই কথাগুলোই তো বলছে! সেই খবর ঘুরতি পথে ঠিক আমার কাছে এসে পৌঁছেও যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ আবার আমার পূর্ব পরিচিত, কেউ খুব নিবিড়। কয়েকজন মুখে কিছু বলছে না, চোখের ভাষা দিয়ে বলছে। কেউ বলছে শব্দ দিয়ে, কেউ বলছে নিঃশব্দে। ঠিক কতগুলো মানুষকে যথাযথ উত্তর দিতে দিতে চলা যায়?

বেশিরভাগ মানুষই আসলে যেটা চায়, তার মতো করে জগৎটা গড়ে উঠুক। সে-ই ঠিক জগৎ ভুল। কেউ স্বীকার করতে চায় না আমরা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে। সেই স্বতন্ত্রতা স্বীকার করে নিয়ে আমিও পথিক, তুমিও পথিক। আমরা কেউ ঠিকও নই আবার ভুলও নই।

শুধু এটুকু বলা চলে। এক আদি জিজ্ঞাসা আমার শ্বাসের দোসর হয়েছে। সেই জিজ্ঞাসা, ‘আমি কে?’
ওই জিজ্ঞাসাই কখনো আমায় নিয়ে যায় মীরার সামনে, কখনো হিরণ্যকশীপুর মুখোমুখি। জিজ্ঞাসা রঙ পাল্টে পাল্টে বলে, কি নাম তোমার? এই রূপ কার? তুমি কি মন? তোমার কাছে বর্তমানের অর্থ কি? তুমিই কি ঈশ্বর?আমি কখনো অস্থির, কখনো প্রাঞ্জল, কখনো বিষাদমাখা, কখনো গম্ভীর। কত রঙ ছুঁয়ে যায় চেতনাকে।

একটু একটু করে ভাঙার রসদ পাই আমি নামক আপাত সত্যের সাথে জুড়ে থাকা মোড়কগুলোকে। কৃতজ্ঞতা জানাই নীল পাড় সাদা শাড়ির মীরা’কে। আবার হিরণ্যকশীপুর রূপান্তর দোকানীকেও। ভালো-খারাপ, সাদা-কালো, ঠিক-ভুল, সুন্দর-বীভৎসতা সবটুকু গ্রহণ করার মত খোলা আকাশ না হ’লে বোধহয় পথিক হওয়া যায় না।

কিছু কবিতা কবি এমনভাবে লেখেন, পাঠক পড়ার পর অনুভব করেন, এ তো আমারই গল্প! আমাকে নিয়েই তো লেখা! আমারই জীবনের দৈনন্দিতার ছন্দ! ঠিক তেমন করে কিছুমাস আগে মহারাজের কাছে কয়েকটা লাইন পেয়েছিলাম। অনুক্ষণ অনুভব করি সেই লাইনগুলো, বিশ্বাস করি এ যেন আমাকে নিয়েই, আমারই জন্য। সেই প্রসাদ নিবেদন করলাম সবার কাছে। যদি লাইনগুলো কোনোভাবে কারোর কাছে মায়ের কোলের মত সম্পূর্ণ নির্ভার কোনো অনুভুতু যোগায়-

“কামড়ে ধরেছি একবিন্দু অন্ধকার
যাতে পালিয়ে না যায় আলো,
যদি কোনোদিন হতে চাও সাদা পাতা
শুষে নিও জগতের কালো।”

Comment here