আজ আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে সংকটের যে কালো ছায়া বিশ্বের আকাশে পরিব্যাপ্ত হয়েছে, তার মূলে আছে কমিউনিস্টদের উসকানি। একটু পিছন ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক সেনা অভিযানের পর থেকেই বিগত পাঁচটি দশক ধরে এই পার্বত্য ভূখণ্ডে এক তীব্র অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহন করেছে। একদা কমিউনিস্ট রাশিয়া তার আপন প্রভাব বলয় সৃষ্টির জন্য এই পার্বত্য ভূখণ্ডকে বেছে নিয়েছিল। আজ তার জায়গা দখল করেছে সমমনোভাবাপন্ন চিন। অথচ আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, কমিউনিস্টরাই সব থেকে বেশি সাম্রাজ্যবাদকে গালমন্দ করে আমাদের সামনে ধন্দ তৈরী করে। আসলে ভাবের ঘরে চুরি করার নজিরে এদের জুড়ি মেলা ভার।
একদা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া সারা বিশ্বে ঠাণ্ডা যুদ্ধের বাতাবরন সৃষ্টি করে একটা ত্রাসের পরিবেশ বজায় রেখেছিল। বতর্মানে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর জায়গাটি দখল করেছে কমিউনিস্ট চিন। এই দুই শক্তির অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রভাব বলয় সৃষ্টির বাসনা বিশ্ব ইতিহাসের নিয়ামক শক্তিতে পর্যবসিত হয়েছে। কেননা, অর্থনৈতিক ক্ষমতার নিরিখে এই দুটি দেশ প্রথম দুই স্থানকে কব্জা করে রেখেছে। এশিয়া মহাদেশে অবিসংবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সম্প্রতি চিন উদ্বেল হয়ে উঠেছে। এর অন্য আরেকটি কারণ হোল, ভারত তার দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ‘ধীরে চলো’ নীতিকে পাশ কাটিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ভারতের এই দ্রুত পট পরিবর্তন চিনের অসূয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের অগ্রগতি প্রতিহত না করলে চিনের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়া মুশকিল, এই আতঙ্ক থেকেই ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তীব্র উত্তেজনা বজায় রাখার চিনা কৌশল অনুসৃত হচ্ছে।
এরই ফলশ্রুতিতে সমগ্র বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে নজর রাখলেও তালিবান জবরদখলকারীদের সর্বাগ্রে স্বীকৃতি দিয়ে চিন তার একবগ্গা অবস্থানের কথা ঘোষণা করেছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে চিনের যে ৯০ কিলোমিটার সীমান্ত অঞ্চল রয়েছে, তার পাশেই অবস্থান করছে উইঘুর মুসলমান অধ্যুষিত চিনা প্রদেশ শিনজিয়াং। আপন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দেশে এই মৌলবাদী শক্তিকে ব্যবহার করে নৈরাজ্য সৃষ্টির বাসনা চিনকে প্রলুব্ধ করছে। আর এই কারণেই প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আগ বাড়িয়ে তালিবান নেতা মোল্লা আবদুল ঘানি বরাদরের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এখানেই না থেমে চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র হুয়া চুনয়িং এই জবরদখলকারী সন্ত্রাসী শক্তিকে সকলের আগেই স্বাগত জানিয়েছেন এক উদার ইসলামিক সরকার গঠনের জন্য; যদিও ইসলামিক সরকারের উদারতা এক স্বপ্নগাথা মাত্র। আসলে এতদিন আমেরিকা যে ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল, তার শূণ্য স্থানটি পূরণের জন্য চিন উদগ্রীব। মূখ্য উদ্দেশ্য হোল, ভারতের উপর স্নায়বিক চাপ সৃষ্টি করা।
জাতিসংঘের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী/ East Turkishtan Islamic Movement, যা ‘এটিম’ নামে কুখ্যাত তারা বহু বছর ধরে সীমান্ত এলাকায় তৎপর। আফগানিস্তানের বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকাতেও তাদের তৎপরতা চোখে পড়ে। এই অভ্যন্তরীন সমীকরণ-ও চিন কর্তৃক তালিবানদের সমর্থনের অন্যতম একটি কারণ হিসাবে বিবেচ্য হতে পারে। গ্লোবাল টাইমসের রিপোর্ট অনুসারে, মোল্লা বারাদা ও চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গোপন বৈঠকে তালিবান নেতা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন যে, আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে চিনের বিরুদ্ধে কাউকে কোনও তৎপরতা তালিবানরা চালাতে দেবে না।
এ দেশের তাবৎ কমিউনিস্টরা নিশ্চুপ। এতদিন এঁরাই আফগানিস্তানে মার্কিন হস্তক্ষেপের জন্য কুমীরের কান্নায় ব্যস্ত ছিলেন। একদা তাঁদের ঘোষিত অবস্থান ছিল, “চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান”। কেউ কেউ আশা করছেন কিনা জানা নেই, জনবিচ্ছিন্ন কমিউনিস্টদেরও ভরসাস্থল হয়তো বা তালিবানরাই হয়ে উঠবে। তা না হলে, একদিন যাঁদের আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে কথা না বললে ভাত হজম হোত না, কেন তাঁদের এই মৌনব্রত? নাকি, আফগানিস্তানে চিনের পরোক্ষ মদতদান, এদেশের কমিউনিস্টদের কোন সুপ্ত আশা পূরণের ইঙ্গিতপূর্ণ সংকেত? তবে স্মরণ করাতে পারি, নগর পুড়লে যেমন দেবালয় রক্ষা পায় না, তেমনি কমিউনিস্টদের বর্তমান অবস্থান অচিরেই তাঁদের অতীত ইতিহাসের পাতায় সন্নিবিষ্ট করবে। কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে আজও দেশ আগে, দল পরে।
Picture courtesy: Money Control, NDTV & various others
ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায় – ইতিহাসের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক, বর্তমানে যুক্ত আছেন পুরুলিয়ায় অবস্থিত সিধো-কানো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে।
Comment here