পুঁথি - পরিচয়

‘কালের মন্দিরা’ – পুস্তক পর্যালোচনা

হিমালয়ের নিরালায়,বছরের কোন এক সময়, খুব স্বল্প মূহুর্তের জন্য ফুটে ওঠা অসম্ভব সুগন্ধী ব্রহ্মকমলে যেমন ঈশ্বরের বাস,তেমনই রোজের দেখা, চেনা,জানা জুঁই, বেলি,গন্ধরাজ,আর বুনোফুলের থোকার মাঝেও যে সেই একই ঈশ্বরের বাস – এই বোধকেই আবারও উপলব্ধিতে আনে যে বই, সে বই হল ‘কালের মন্দিরা’।যন্ত্রশিল্পী শ্রী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সাংস্কৃতিক জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ ও সেই কর্মসংক্রান্ত বিপুল অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ তাঁর আত্মকথন রয়েছে এ বইয়ের অর্ধেক জুড়ে। বাকি অর্ধেক, তাঁর নিজের লেখা ছড়া,কবিতা,গান,নাটক ইত্যাদি, নানা গুণীজনের তাঁর সম্পর্কে ভালবাসার প্রকাশ,বিভিন্ন পত্রিকায় অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কে বেরোনো লেখা ইত্যাদি । তবে এই পুস্তক পর্যালোচনা করতে বসে আমাদের ম’নে হয়েছ যে,তাঁর আত্মকথনটির বাইরে, বাকিগুলো না থাকলেও, এ বইয়ের সম্বন্ধে একই কথা বলা যেত,কারণ একটাই- অভিজিৎ বাবুর জীবন ও যাপন।যে পরিবেশ,পরিমণ্ডলে জন্মেছেন তিনি,বেড়ে উঠেছেন- সেই পার্শ্বিক,সেই শিকড়,সেই ভাবধারা,সেই ভূমি,সেই মাটির প্রতি এতটাই নিষ্ঠ থেকেছেন ,যার প্রেক্ষিতে এক সমৃদ্ধ জীবন তিনি পেয়েছেন।জীবন তাঁকে যা দিয়েছে সেখানে প্রাচুর্য্যের অভাব থাকলেও তা নিয়ে কোনো অভাব,অভিযোগ অনুযোগ পরিবর্তে, তিনি তাকেই আঁকড়ে ধরেছেন পরম মমতায়।দাদার সঙ্গে গিয়ে ‘বাগবাজার সার্বজনীন’ পুজোর অর্ধনির্মিত মণ্ডপে বাঁশের ওপর উঠে ব’সে প্রতিমা তৈরী দেখতে দেখতে তন্ময় হ’য়ে যাওয়া,তারপর বাড়ীর বড়দের ডাকে সেখান থেকে লাফিয়ে নামা, এবং বাড়ীতে এসে মার খাওয়া। পাশের বাড়ীতে সকলে রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান করবে, সেখানে দলে ভিড়ে, গলা মিলিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেওয়া যে,মূল গায়ক গায়িকাদের থেকে এই ছোট ছেলেটা ত হাজারগুণ সুরে গায়!! ইস্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে তাঁর অর্কেষ্ট্রার অনুষ্ঠান মাষ্টারমশাই বাতিল ক’রে দিলে হ’ন্যে হ’য়ে, নাছোড় হ’য়েয়ার এক মাষ্টারমশাইকে ধ’রে একটা হরবোলার প্রোগ্রাম আন্তত রাজী করানো – এ সবটার মধ্যেই যে সরল সবুজ কিশোরের ঐকান্তিকতার ছবি ফুটে ওঠে,তা-ই তাঁকে এগিয়ে দেয়,তাঁর পরবর্তী বহুমুখী শিল্প চর্চ্চার এক জীবনে।

এটাই ত যেন খাঁটি বাঙালী ছেলের শৈশব। প্রাণভ’রে,আকণ্ঠ যে জীবনকে তিনি পান ক’রেছেন। তার প্রতি কোনো খেদ না রেখে।

স্বাধীনতার ঠিক পরে পরেই উত্তর কলকাতার ব’নেদী পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। নিজের পরিবারে গানবাজনার চল থাকায়,আর ছোট থেকেই বাড়ীতে নানান বাদ্যযন্ত্র দেখতে থাকায় কেমন ক’রে যেন সঙ্গীতের একটা বীজ উপ্ত হ’য়ে গিয়েছিল ছোট ছেলেটির ম’নে।পারিবারিক আত্মীয়তার সূত্রে একদিকে অশোক কুমার, একদিকে উত্তম কুমার আবার একদিকে তৎকালীন যাত্রাতারকাদের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁকে যেমন ঋদ্ধ করেছে, অন্যদিকে কোথাও সেই শৈশব অবচেতনেই অর্পণ করেছে এক দায়িত্ববোধ যে এই পরম্পরার সন্তান হ’য়ে এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তোমার কর্তব্য।

পরম্পরার প্রতি যে তিনি সততই শ্রদ্ধাশীল থেকেছেন,তার প্রমাণ পাওয়া যায় তিনি যখন যত্ন ক’রে ক্লাবতুতো দাদা,’ক্ষীরের পুতুল’ নৃত্যনাট্যের নৃত্যপরিচালক শ্রী ধূর্জ্জটী সেন সম্পর্কে জানান যে তাঁর পিতামহ ছিলেন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের চিকিৎসক। পারিপার্শ্বিকের প্রতি তাঁর এই শ্রদ্ধাশীলতাই আমাদের ইতিহাসের নানান টুকরো আলোর সন্ধান দেয়। তাঁর ক্লাবের প্রোডাকশন ‘ক্ষীরের পুতুল’ নৃত্যনাট্যের মূল নির্দেশক শ্রী কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পর্কে ব’লতে গিয়ে উনি জানান,তাঁর পিতা প্রভাতকুমার সম্পর্কে, যিনি বিপ্লবী মহলে ‘জঙলীবাবু’ নামে খ্যাত ছিলেন,এবং সুভাষচন্দ্রের নিয়মিত যাতায়াত ছিল যাঁর কাছে। আমি সত্যিই জানি না, স্বাধীনতা আন্দোলনের যে ইতিহাস আম জনগণকে পড়ানো হয়, তাদের ক জনই বা এই ‘জঙ্গলী’বাবুর কথা জানেন। কিন্তু অভিজিৎ বাবুর এই সরল সহজ স্মৃতিচারণ আমাদের সেই আলোর সন্ধানটুকু দিয়ে গেল। এ প্রসঙ্গে বলতেই হয়, বহু আন্তর্জাতিক মানের শিল্পব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যে নিজেকে,নিজের পরিবারকে বড় করতে কি অবলীলায় সমসাময়িক অন্যান্য তারকাসম গুণীজনদের ছোট করেছেন। কিন্তু অভিজিৎ বাবুর দায় ত কেবল সময়ের প্রতি নিষ্ঠ থাকার, তাই বড় সৎ, সুন্দর এক প্রতিফলন তাঁর এই আত্মকথনে।

একাধারে বহু বাজনায় পারদর্শী এবং শুধু তাইই নয়, নির্মাণ করেছেন নানা বাদ্যযন্ত্র অবলীলায়। দুটো স্ন্যাক্সের টিনকে জুড়ে যখন তিনি বঙ্গ তৈরী করে ফেলেন,বা ছিপি জুড়ে কাঠ- খরতাল,তখন নিরুচ্চারে সেই ঘটনা আমাদের বলতে থাকে অভিজিৎ বাবুর রক্তে মিশে থাকা সৃষ্টিশীলতার কথা,সঙ্গীতের কথা।

সে কারণেই,বাজনা,হরবোলা, মঞ্চসজ্জা, লেখা,গান – সবই যেন তাঁর কাছে অনায়াস ও ঈশ্বরদত্ত। পাড়ার নাটকের সময়ে কালঘাম ছুটিয়ে যিনি বানিয়ে ফেলেন অবন ঠাকুরের দক্ষিণের বারান্দার সেট, ১৯৮৫ সালে প্রথমবার ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ সম্প্রচারের প্রাক্কালে দূরদর্শন অধিকর্তা সেট নির্মাণের জন্য যে তাঁরই শরণাপন্ন হবেন – এ আর আশ্চর্য কি… এই যে মানুষটা মন্দিরা হাতে গানের সঙ্গে বাজাতে বসবেন এখনই,তার আগের মূহুর্ত পর্যন্ত তিনি কিনা মঞ্চ সাজাতে ব্যস্ত!!চমৎকৃত হয়েছেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত শিল্পীরাও।সুচিত্রা মিত্র ত ছন্দেই লিখে ফেলেছেন। আর পবিত্র সরকারের মত শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, এ কালের অভিনেতা তাঁর খুড়তুতো ভাই সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর ছোটবেলার বন্ধু তারক সাহা, রেডিওর দেবাশীষ বসু – কে না বলেছেন তাঁর গুণের কথা!!..

সত্তরোর্ধ বয়সে এসে তিনি যখন কলম ধরেন, তখনও তাঁর লেখনীতে প্রাজ্ঞের জ্ঞান, পরিণত মানুষের অভিজ্ঞতার থেকেও ভরপুর থাকে কিশোরের,যুবার,তরুণের প্রাণোচ্ছ্বলতা। জীবনরসে পূর্ণ এক কিশোর যেন উদ্দাম ছূটে চলেছে তার শৈশবের, কৈশোরে, তারুণ্যের আনন্দময় দিনযাপনের পথ ধ’রে।

ভীমসেন যোশি থেকে শুরু করে কবিতা কৃষ্ণমূর্তি – তাঁর সঙ্গত করা শিল্পীর তালিকায় কে নেই সেটাই প্রশ্ন। চারপাতা ব্যাপী সে নামের আর এখানে অবতারণা করছি না।

বাবাডুগি,গং – প্রভৃতি শিল্পী আবিষ্কৃত বাদ্যযন্ত্রগুলি সাধারণ পাঠকের কাছে নতুন চেনা হ’য়ে আসে। এফেক্টস এর কাজও তিনি কম করেন নি, এবং সে পরিসরেও তাঁর ইনোভেশন ছিল যথেষ্ট – তা সহজেই অনুমেয়। তবে এ প্রসঙ্গে আলোচনা বড়ই কম। এ নিয়ে তাঁর আত্মকথন বা অন্যত্র আলোচনা কিঞ্চিৎ বেশী থাকলে পাঠকের সাধ মিটত।

এ বইয়ের পাওনা কি?… শুধুই কি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক শিল্পীর জীবনী? নাকি আরও কিছু??..

আরও যা,তা হল,অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনী কেন্দ্র করে আমরা স্বাধীনতা উত্তর কলকাতার এক অপূর্ব চিত্র পেয়েছি। সমৃদ্ধ,সংস্কৃতিবান,চরিত্র গঠনে প্রয়াসী, মানবিক এক কলকাতা,যেখানে প্রতিভাবান একটি ছেলেকে বাজাতে দেখে সম্পূর্ণ অনাত্মীয় একজন নিজে থেকে বাদ্যযন্ত্র কিনে দিতে চান, এবং কিনে দেনও যে অর্থের বিনিময়ে, আজকের দিনে তার মূল্য বেশ কয়েক হাজার টাকা। এ বাস্তবতা আজকের কলকাতা কল্পনা করতে পারে??

সবচেয়ে বেশী যা উঠে এসেছে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মকথনে, তা হল সে সময়ের মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের শিল্পনিষ্ঠা। রিহার্সাল ঠিক হচ্ছে না ব’লে কল্যাণবাবুর স্ক্রিপ্ট নিয়ে নেওয়া বা ওদিকে কলেজের প্রিন্সিপালের শো ভাল লাগায় আরও একবার বিশেষ শো করতে বলা। পরিশীলন, আর মার্জিত জীবনযাপনের কলকাতা, বাঙালী হিন্দুর উৎকর্ষ আর দাপটের কলকাতা।

এবার আসি বইটির সার্বিক গঠনে,এবং এ প্রসঙ্গে সম্পাদকের ধন্যবাদ অবশ্যই প্রাপ্য। ‘বাঙালী ডকুমেন্টেশনে একেবারেই অপটূ’, ‘ বাঙালীর ইতিহাস থাকে না – এ সব চিরকালীন বদনামকে এক কথায় নস্যাৎ ক’রে দিতে পারে এ বইয়ের নির্মাণ। অভিজিৎ বাবুর শৈশবে নির্মিত দেবীমূর্তি থেকে শুরু ক’রে আট বা নয়ের দশকে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত অনুষ্ঠান পর্যালোচনা এবং তার মধ্যে অভিজিৎ বাবুর সম্বন্ধে লিখিত অংশবিশেষ কি পরম যত্নে তুলে ধরা হয়েছে।বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে তাঁর ছবিগুলি এক কথায় অমূল্য। সুচিত্রা মিত্রের ছন্দে লেখা আর এক দারুণ প্রাপ্তি।

হার্ডবাউন্ড এই বইটির সেলাই, পাতার কোয়ালিটি যথেষ্টই ভাল। বইটির নাম নির্বাচনের মধ্যেও মুন্সিয়না আছে।প্রচ্ছদ সুন্দর।

আশা রাখব, পরবর্তী প্রকাশে অভিজিৎ বাবুর আত্মকথন যেন আরও বিস্তৃতভাবে থাকে।

প্রাসঙ্গিকতায় আগামীতে, নব্য প্রজন্মের কাছে কালজয়ী হ’য়ে উঠুক ‘কালের মন্দিরা’।

Comment here