সংস্কৃতি

‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী’ – হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

এই লেখার শুরুতেই মনে করতে ইচ্ছা করে একটি ঘটনা।একদিন সন্তোষ সেনগুপ্ত টেলিফোন করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী ও শিক্ষিকা শ্রীমতী মায়া সেনকে। 

– হেমন্ত রেকর্ড করবে তুমি তার ট্রেনিং দেবে।সন্তোষ সেনগুপ্ত বললেন মায়া সেনকে। মায়া সেনের মাথায় বজ্রাঘাত।দেবব্রত বিশ্বাস তখন প্রায় প্রতিদিন মায়া সেনের বাড়িতে আসেন।তিনি শুনে বললেন, – কমু কি?মায়াদি দিব হেমন্তরে ট্রেনিং? আমি যামু শুনতে।হেমন্তকে সে কথা বলতে উনি একটু হাসলেন। এরপর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিশাল গাড়ি করে দেবব্রত বিশ্বাস,মায়া সেন,মায়া সেনের স্বামী ত্রিদিব সেন ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেলেন দমদমে এইচ. এম. ভির রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে। সেবার মায়া সেনের তত্ত্বাবধানে হেমন্ত রেকর্ড করবেন ‘কি গাব আমি কি শুনাব’, ‘ সংসার যবে মন কেড়ে লয়’, এবং আরও দুটি গান।’ সংসার যবে মন কেড়ে লয়’ গানটিতে কিছু কিছু ছোটো ছোটো অলংকরণ ছিলো যা শুনে হেমন্ত মায়া সেনকে বলে উঠলেন, – ও মাস্টারমশাই আমার দ্বারা এ কাজ আসবে না।মায়া সেনকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মাস্টারমশাই বলেই ডাকতেন।মনে রাখতে হবে যে সময়কার ঘটনা এটি তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সমার্থক।মায়া সেন তাঁকে প্রবোধ দিলেন এবং বাচ্ছা ছেলের মতো ঠিকঠাক করে গানটি গাওয়ালেন।হেমন্তর কন্ঠে এই গান অন্যরকম মাত্রা পেলো।

এই পর্বের লেখাটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তথ্যসমৃদ্ধ জীবনী নয়।নয় কিছু সালতারিখের সমাহার।এই পর্বের লেখাতে রবীন্দতসঙ্গীতের বিস্তীর্ণ গগনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নামক উজ্জ্বল নক্ষত্রের চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবার বিভিন্ন দিকই তুলে ধরবার চেষ্টা করবো জানি হেমন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে লেখা খুব সহজ ব্যাপার নয় তবু সামান্য প্রচেষ্টা করতেই পারি। ১৯৪০ সাল।শ্রদ্ধেয় অনাদি দস্তিদারের তত্ত্বাবধানে কলম্বিয়া রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত হলো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড।

গানদুটি ছিল ‘ কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’ এবং ‘ আমার আর হবে না দেরী’।রবীন্দ্রনাথের গানের ভেরী শুনে একটুও দেরী না করে হেমন্ত উপস্থিত হলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের নভোমন্ডলে। আর খুব বেশীদিন তাঁকে অপেক্ষা করতে হলো না ধীরে ধীরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্জগতে অপরিহার্য হয়ে উঠলেন হেমন্ত।কখনো এককভাবে,কখনো দ্বৈতভাবে একের পর এক রবীন্দ্রসসঙ্গীত রেকর্ড করতে লাগলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।পাশাপাশি ছায়াছবিতেই গাইতে লাগলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত।

১৯৪৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি প্রিয় বান্ধবী তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইলেন ‘ পথের শেষ কোথায়’। বাংলা ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার ক্ষেত্রে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের পর যেন আর একটি দিগন্ত খুলে গেলো।এরপর প্রায় ৪০ বছর ধরে বাংলা ছবিতে কখনও নেপথ্যে বা কখনও নায়কের কন্ঠে একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন তিনি।বিশেষ বিশেষ দৃশ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত এক আলাদা মাত্রা পেতো দু -একটি উদাহরণ দেওয়াই যায়।১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি বিভাস -এ পর্দায় উত্তমকুমার গাইছেন ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’ তখন নায়িকা ললিতা চ্যাটার্জির মুখে অনুরাগের ছোঁয়া।আবার ১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নিজের পরিচালিত একমাত্র ছবি অনিন্দিতায় হেমন্ত গাইলেন পঙ্কজকুমার মল্লিকের কন্ঠে মুক্তি ছবিতে ইতিহাস জয়ে যাওয়া সেই বিখ্যাত গান ‘ দিনের শেষে ঘুমের দেশে’।

নায়িকা মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের ওপর ক্যামেরার ফোকাস।উন্মুক্ত প্রকৃতিতে হেমন্তর গলায় এই গান যেন আলাদা মাত্রা পেলো ১৯৭৫ সালের ছবি অগ্নীশ্বর। এই ছবির শেষের দিকে যেখানে অগ্নীশ্বররূপী উত্তমকুমার তাঁর কলকাতার বাড়িতে কলেজজীবনের বন্ধুদের সঙ্গে একত্রে মিলিত হচ্ছেন বা পুরোনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছেন তখন এক পার্শ্বচরিত্র অসীমকুমার গেয়ে উঠলেন ‘ পুরানো সেই দিনের কথা’। যখনই পর্দায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে গানটি আমরা শুনি চোখের জল ধরে রাখতে পারি না।১৯৮০ র এক উল্লেখযোগ্য ছবি ‘দাদার কীর্তি’।ছবির অন্যতম দুটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে নায়ক তাপস পালের কন্ঠে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইলেন দুটি গান ‘ চরণ ধরিতে দিও গো আমারে’ এবং ‘ এই করেছ ভালো নিঠুর হে’।দাদার কীর্তি ছবির কাহিনী পরম্পরার সঙ্গে এই দুটি গান যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।শুধু যে নিজে গেয়েছেন তা নয় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়,আরতি মুখোপাধ্যায়,রুমা গুহঠাকুরতা,সুমিত্রা রায়,অরুন্ধতী হোমচৌধুরী,চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়,শিবাজী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীদের দিয়েও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েছেন ছবির প্রয়োজনে।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধেয় সন্তোষ সেনগুপ্তর পরিচালনায় গ্রামাফোন কোম্পানী থেকে রবীন্দ্রগীতিনাট্যের লং প্লেয়িং রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ‘ বাল্মীকি প্রতিভা’,’ চিত্রাঙ্গদা’,’ চন্ডালিকা ‘,’ শাপমোচন’,’ শ্যামা’ প্রভৃতি গীতিনাট্যের মুখ্য ভূমিকায় তিনি অনন্য।চিত্রাঙ্গদায় অর্জুন,শ্যামায় বজ্রসেন,শাপমোচনে অরুণেশ্বর বা চন্ডালিকায় আনন্দ হেমন্ত ছাড়া ভাবা যায় না।যখন চিত্রাঙ্গদায় অর্জুন বলছেন’ অহো! কি দুঃ সহ স্পর্ধা অর্জুনে কে করে অশ্রদ্ধা’ কিংবা শ্যামার শেষ অংশে বজ্রসেনের সেই অমোঘ উক্তি, ‘ এ জন্মের লাগি তোর পাপমূল্যে কেনা মহাপাপভাগী এজীবন করিলি ধিক্কৃত’ শুনলে আজও যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

অজস্র রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছেন হেমন্ত।’ আজি মর্মর ধ্বনি কেন’ ‘ আমার ভাঙাপথের রাঙা ধূলায়’,’ আর রেখো না আঁধারে’, ‘ আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে’,’ হে ক্ষণিকের অতিথি’,’ আজি শরত তপনে’,’ আমি জ্বালবো না ‘, ‘ বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’,’ মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো’ ‘ এবার অবগুন্ঠন খোলো ‘ ‘ সংসার যবে কেড়ে লয়’,’ মনে রবে কি না রবে আমারে’, ‘ কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না’,’ আসা যাওয়ার পথের ধারে’,’ এ কি সুধারস আনে’,’ এই তো ভালো লেগেছিলো’,’ যদি তারে নাই চিনি গো সেকি’,’ মিলন রাতি পোহালো’, ‘ হে নিরুপমা’,’ প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায়’ – এই গানগুলি যেন হেমন্তর গান হয়েই আমাদের কাছে রয়ে গিয়েছে।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে ছিলো এক স্বতঃ স্ফূর্ত আবেগ যা রবীন্দ্রনাথের গানকে করে তুলতো অর্থবহ।নিরহংকার সহজ সরল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত এই মানুষটি রবীন্দ্রনাথের গানকে মিলন – বিরহ ও সুখে- দুঃ খে গ্রথিত করে প্রত্যেক শ্রোতার কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন।নিজে অকপটে স্বীকার করেছেন, ” বলতে আর কোনও দ্বিধা নেই, জীবনে অনেক গান গেয়েছি, আনন্দও পেয়েছি – কিন্তু রনীন্দ্রনাথের সুরের মধ্যেই আমার প্রাণ সুরের নিঃশ্বাস নিয়েছে। আজও নিচ্ছে’।

রবীন্দ্রনাথের গানকে তিনি ভালোবেসেছিলেন।রবীন্দ্রসঙ্গীত ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাই একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন অনায়াসেই। আজও তাই রবীন্দ্রনাথের গানের আকাশে শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

Comment here