পুঁথি - পরিচয়

আষাঢ়ের পুঁথি –

আষাঢ়শেষের দিনটিতে ‘পুঁথি পরিচয়’ করাতে ব’সে হাতে এল দেবাশিস সিংহ লিখিত কবিতা সঙ্কলন ‘শ্রাবণ জাতক’।প্রচ্ছদে ক্ষান্তবর্ষণ ধূসর আঁধারের ডাক। কাগজের নৌকা ভাসানিয়া সুর। খুলে প্রথম পর্বের নামটিই বড় ম’নকাড়া – ‘আপনঝোরা’। সত্যিই তো, এ ত যেন আপনাকেই কাব্যধারায় ঝরিয়ে দেওয়া। তাঁর কবিতার অনুসঙ্গ ধার ক’রেই বলতে হয়, চন্দ্রকলা ‘ যেমন নিশীথের প্রাণ কুরে খায়’ – এই কাব্যধারাও তেমনই নিংড়ে নেয় কবিহৃদয়ের,কবিচেতনার, কবিমানসের সবটুকু। সে জন্যই ‘আপনঝোরা’ নামটা বড় সুপ্রযুক্ত। এ পর্বের কবিতায় কাব্য তার শতরূপে বিকশিত। এমনই লিরিক্যাল যে, ম’নে হয় সত্যিই বোধ হয় চণ্ডীদাসের সঙ্গে জলের পাড়ে ব’সে আছি রজকিনীর প্রতীক্ষায় (‘পোস্টমডার্ন’ কবিতা) নতুবা ধীর পায়ে হেঁটে চলেইছি বুদ্ধের সাহচর্য্যে।।

‘বর্ষার সনেট’দুটি ‘বৃষ্টির সুবাস’এর মতই অতি মনোরম। শ্রীকৃষ্ণ থেকে চণ্ডীদাস হ’য়ে নীলকন্ঠ, ইন্দ্র – সব অনুষঙ্গ একাকার হ’য়ে যায় যেন বর্ষণ আবাহনে। ‘শালিখবতী’ কবিতাটি এক লঘুপদ কিশোরী। শালিখ কি কবির প্রিয় ইমেজ?.. ফিরে ফিরে আসে কবিতায়। ‘কাহ্নপাদ’ কবিতার আবহ শ্রাবণসন্ধ্যার মতই ধূসর।কিন্তু সেই ধূসর আবহ চিরে একখণ্ড বিদ্যুত্তরঙ্গের মত, দেবতার দেবত্বে কবি আঘাত করলেন; তাকে উন্মোচিত করলেন – যা যেমনই আকস্মিক, তেমনই অন্তর্ভেদী।

‘কন্ডাক্টর’,’চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’,’ভারতচন্দ্র’, ‘স্বর্ণচাঁপা গলি’ – কবিতাগুলি বর্ষাবাতাসের স্পর্শের মতই স্নিগ্ধ,স্মৃতিবাহী ও উদাসী। ২৯টি couplet বিশিষ্ট ‘কণিকা ত্রিংশৎ’ এক অন্য ফর্মের কবিতা। এই পর্বে অনেকগুলো কবিতাই অন্ত্যমিলবিশিষ্ট। বেশ কয়েকটি অতি চমৎকার আবৃত্তি উপযোগীও। বাদকুল্লা অঞ্চলের বাসিন্দা দেবাশিস সিংহের কলমে খুব স্বাভাবিকভাবেই এসেছে তাঁর চারপাশ। ‘কালীনারায়ণপুর’ স্টেশন যেমন এসেছে, এসেছে ‘অঞ্জনা নদী’। রবীন্দ্রনাথের, ‘অঞ্জনা নদী তীরে চন্দনী গাঁয়ে’র অঞ্জনা এখন বেগবতী না হলেও ‘ব্রিজবতী’ হ’য়ে কাব্যে ঠাঁই পেল – এইই কি আমাদের কাছে কম রোমাঞ্চের?.. সেই নদীতেই নৌকাযাত্রায় চলেছেন তিনজন। জ্যোতিদাদা গান ধরলেন,আর ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে ‘নতুন বৌঠান’।

‘শ্রাবণ জাতক’ বইটির দ্বিতীয় পর্বের নাম ‘আয়না’।কিন্তু কবিতাগুলি পড়তে পড়তে বারবার বিভ্রম হয়, এ পর্ব্বের নাম বোধ হয় – মায়া। 

ঠাকুরদার আমলে বানানো যে খাটের আনাচে কানাচে খুঁজলে কোথাও মিলতে পারে ঠাকুমার পানের কষ, সেই খাটে বাবার দেহ মার চুলের ঘ্রাণ খুঁজে চলা কবি তৃপ্ত হন তাঁর পরিবার, সন্তানকে একই শয্যায় নিদ্রিত দেখলে। কি নিবিড় মায়াবাঁধনে জড়কাষ্ঠ বেঁধে রেখেছে তাঁদের চারপুরুষকে, এ মায়া ছেয়ে ফেলে কবিমনকে। কোথাও কি সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা প্রাণ পায়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এমন করেই জীবন জুড়ে থাক খাটখানি।(‘খাট’ কবিতা)।

জীবনের প্রতি কবির ভালবাসা লেখনী থেকে ঝ’রে পড়া কালির ফোঁটার মত ভ’রিয়ে ফেলে পাতা।তাই,যদিও তিনি তাঁর নশ্বর দেহের দ্বারা শকুনের তৃপ্ত ভোজের কথা লিখে ফেলেন অবলীলায়, তথাপি ‘আয়ুগাছ’ থেকে খ’সে পড়া দিনের তুলনা দিয়ে গিয়ে পাতার যে পেলব, শব্দহীন,কোমল পতনকে এঁকেছেন তিনি,তাতে যেন জড়িয়ে থাকা লতার মতই মায়া।তাই ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’ এ তিনি একা যান কি করে? পাঠকের মায়া কাটানো কি অতই সহজ। খোলাখুলিই ব’লে দেন – ‘ এ রাতে পাঠক পেলে,তোকে সঙ্গে নেব’।’ভ্যান : চাকদহ’।

এ পর্বের ‘বারপুজো’ আর ‘ঘুড়ি’ কবিতায় মহিলাদের এক নিটোল জগতের ছবি এঁকেছেন দেবাশিষ। তাঁদের মন্দির যাওয়া থেকে খুনসুটি, প্রদীপ জ্বালানো থেকে,জোড়হাত – গতানুগতিক নারীজীবনের তিলার্ধ্ব অবসরে তারা কেমন ক’রে মেলে দেয় নিজেদের, ফুটে ওঠে -সে দিকে বড় আপনজনের মত চোখ মেলেছেন কবি।

‘ঘুড়ি’ কবিতাতেও গতযৌবনা অতীতচারিণীদের ছবি। ‘রমণ ও রান্নাহীন সমস্ত দিবস’ -পংক্তিটিতে কবির অসামান্য সমাজ নীরিক্ষণ পাঠককে চমৎকৃত করে নি:সন্দেহে,কিন্তু প্রশ্ন একটাই জাগে, এই অতীতচারীণী নারীদের মধ্যে কোথাও কোনো কর্ম্মময়ীর ছবি, ‘আপন ভাগ্য জয় করিবার’ অধিকার ও সামর্থ্যসম্পন্নার ছবি পাশাপাশি আঁকা হল না কেন? – এ প্রশ্নটা থেকেই যায়। এ পর্বের শেষ কবিতায় নিজের মুখোমুখি দেবাশিষ সিংহ। তাঁর Alter Ego কে তিনি মেঘ, বৃষ্টি, বাষ্প হ’য়ে যেতে দেন… আর তারপর, ‘অমলকান্তি’র রোদ্দুর হ’তে চাওয়ার সুতীব্র আকাঙ্খা যেন এতগুলো বছর পেরিয়ে চরিতার্থ হয়। টুকরো টুকরো রোদ হ’য়ে ছড়িয়ে পড়েন দেবাশিষ।

তৃতীয় পর্ব ‘ডাকপিওন’- এর ‘নকসিকাঁথা’ কবিতাটিতে, শুরুর দুটি শব্দ ‘পিঁপড়ে পায়ে’র ব্যবহারেই যেন চোখের সামনে গোটা কাঁথা জুড়ে অজস্র রান সেলাইয়ের টেক্সচার মেলে দেয়।তারপর বাকী কবিতা জুড়ে পুরোটাই জীবন বোনার গল্প। শ্যাওলা ধরা ঘাটে কেমন করে নামে একদিন আলতা পা, আর সে কিসসা কেমন ক’রেই বা গাঁথতে থাকে শোলোক বুড়ি কলম ছুঁচের ডগায়, সেই আখর লিখতে লিখতে কবি যেন নিজেই ‘মায়াসাঁতার’ থেকে নিজের সম্বিৎ ফেরান।কিন্তু না, সচেতনভাবে সেই ‘ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন’ আঁকা জগৎ নিছক মায়াজগত নয়; জীবনের এক চরম বাস্তবও সে – সেই বার্তা আজকের শিকড়বিস্মৃত,অনুভবহীন মেকী-আঁকড়ানো,পাঠককে দিতেই যেন ঘাড় ধ’রে তাকে ব’লে যান, “এইখানে তোর আধাআধি জীবনযাপন “।

‘ছবিঅলা’ কবিতায় অনেকগুলো সময়স্তর মিলেমিশে একাকার। যেমন রয়েছে শেষ আশি- নব্বই এর দশকের সাদাকালো টিভিতে সিনেমার গানের অনুষ্ঠান ‘চিত্রমালা’, আর সেই স্মৃতির সাদাকালোয় টান পড়তেই বিষণ্ণ ফটোগ্রাফ চিরে বেরিয়ে আসে যন্ত্রণার সাতচল্লিশ।হারিয়ে যাওয়া, ‘খলবলে’ মাছভরা পুকুর আর গোলাভরা লক্ষ্মীর মতই কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে চিত্রমালার সুতো ছেঁড়া এক একটি সাদাকালো কিম্বা মৃদুরঙীন গান…ভয়ঙ্কর মুঠোফোনের অন্তর্জালীয় সর্বত্রগামী গ্রাসে যেমন গেছে পঞ্চাশ,ষাট,সত্তরের স্নিগ্ধ ছবি, তেমনই সঙ্গে হারিয়েছে আশির জাতকের শৈশব।

জ্ব’রো চেতনা মায়ের ঠাণ্ডা হাতের মত স্নিগ্ধতার সন্ধানেই ছবিঅলাকে ফিরিয়ে আনে স্বপ্নে।পড়তে পড়তে কানে ভাসে,ম’নে আসে
“শুনতে কি চাও তুমি সেই অদ্ভুত বে-সুরো সুর
ফিরে পেতে চাও কি সেই আনচান করা দুপুর
দেখতে কি চাও তুমি সেই খেলনাওয়ালাটাকে”…

অঞ্জনের ‘খেলনাওলা’ আর দেবাশিষের ছবিঅলা তাদের ঝাঁকা আর বাক্স মাথায় নিয়ে কোন অজানা বাঁকে তখন পাড়ি দেয় ফেলে আসা শৈশবের পথ বেয়ে।

‘বিষাদ’ বা ‘বিষণ্ণতা’ এ পর্ব্বের অনেকগুলো কবিতার গায়েই জড়িয়ে রয়েছে মিহি কুয়াশার মত।ছিন্নমূল, সর্বস্ব খোয়ানো ‘মায়ের মামীরা’ আকণ্ঠ বিষাদগাহনে কেবল ছাঁচিপানের রাঙা টুকু সঙ্গী ক’রে ভিটের গপ্পো আঁকড়ে একদিন এমন আরও কত বিষণ্ণদের দলে নিয়ে নিছক গল্প হ’য়ে যান।

‘দ্রোণপর্ব’ এর বিষাদ আর একরকম। বিশেষত শেষবেলায় ‘শালিখ’ এর উল্লেখ যেন জীবনানন্দের বিষাদ অনুষঙ্গ খানিক ছুঁইয়ে যায়।

এই একই জীবনানন্দীয় বিষাদ ফিরে আসে ‘শাদা কুমারীর সিঁথি’ বেয়ে, ‘ছায়া’ কবিতায়। ‘সুগম্ভীর বট থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে যে পথে পড়েছি’ – বড় সুন্দর এই রূপকল্পটি। এরপর যে ‘ম্লান চটি পায়ে’র দিদিমণির কথা কবি বলেন,বাপের যার লক আউট, বিয়ে নিয়ে নানা কথা, ছিছিক্কার.. ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ একবার মেঘ সরিয়ে উঁকি দিয়ে যায় না কি!!?..

‘পেঁপের ফুলের মত সুবিপুল নষ্ট হ’য়ে সেই,
ক্ষণিক পায়ের পরে আমাকেই মেলে দিই রোজ’
সুন্দর মায়াময় মমত্বে হয় এ কবিতা সমাপন| 

 

‘শ্রাবণ জাতক’ এক জাগরণ, নিবিষ্টতা আর স্নিগ্ধতার রেশ রেখে যায় পাঠশেষে।

 

লেখক পরিচিতি – শ্রী দেবাশিষ সিংহ 

Comment here