তিরিশের দশকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতবর্ষের খ্যাতনামা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী শ্রীমতী কৃষ্ণা গাঙ্গুলি। মাত্র পাঁচ- ছয় বছর বয়সে তাঁর গান শুনে সঙ্গীতজ্ঞ মামা শ্রী হরিদাস মুখোপাধ্যায় মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং কৃষ্ণার মা কে বলেছিলেন, “এ তো ডুকরির ভেতর খাসা চাল, ওকে গান শিখিও, দিদি “। মামাবাড়িতে গানের চর্চা ছিল, সেই ঐতিহ্য কে বহন করে মাত্র নয় বছর বয়স থেকে তাঁর শাস্ত্রীয় সংগীতের শিক্ষা শুরু হয়। বড়দাদা শ্রী অরুণ গাঙ্গুলি নিজে সেতার বাজাতেন, তাঁর এবং পরিবারের সকলের উৎসাহে ধীরে ধীরে তিনি সঙ্গীত কে তাঁর জীবনের মুলমন্ত্র হিসেবে গ্রহন করেন। ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভা, অক্লান্ত সাধনা ও গুরুদের স্নেহে ও সাহচর্যে একদিন তিনি ভারতীয় সঙ্গীত জগতের বিশিষ্ঠ এক গায়িকা হয়ে ওঠেন। চল্লিশ, দশকের শেষে ও পঞ্চাশ দশকের শুরুর দিকে তাঁর সমসাময়িক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গায়িকাদের মধ্যে ছিলেন শ্রীমতী মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমতী মালবিকা কাননের মতন প্রতিভাবান শিল্পীরা। কৃষ্ণা গাঙ্গুলি তাঁর নিজের দক্ষতায় সব শিল্পীদের মাঝে শুধু নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন, তা নয়, সেই সময়ের সঙ্গীত জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বিরাজ ক’রেছিলেন।
চল্লিশ, পঞ্চাশ দশকে পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের মতন মহান সঙ্গীতজ্ঞ তাঁর সঙ্গীত পরিচালিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র “রাজলক্ষী ও শ্রীকান্ত” তে কৃষ্ণা গাঙ্গুলি-কে দিয়ে ছবির প্রত্যেকটি গান গাইয়েছিলেন এবং উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত সেই চলচ্চিত্র যেমন সুপার হিট হয়েছিল, তেমনই ছবির প্রতিটি গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়াও শ্রী অনুপম ঘটক, শ্রী শ্যামল মিত্র, শ্রী রথীন বোস এবং সেকালের আরও অনেক বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক তাঁদের পরিচালিত চলচ্চিত্রে গায়িকা হিসেবে কৃষ্ণা গাঙ্গুলি কে বেছে নিয়েছিলেন। শ্রী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে কৃষ্ণা তাঁর প্রথম পুজোর গান রেকর্ড করিয়েছিলেন।
১৯৫৯ সালে শ্রীমতী কৃষ্ণা গাঙ্গুলি, শ্রী অমূল্য দাশগুপ্ত কে বিবাহ করেন এবং তার পরে তিনি কৃষ্ণা দাশগুপ্ত নামে পরিচিতি লাভ করেন। শ্রীমতী দাশগুপ্ত যে শুধু খেয়াল গানেই পারদর্শী ছিলেন তা নয়। তাঁর কন্ঠে ঠুমরী বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। এমনকি বাংলার বেগম আখতার হিসেবে সঙ্গীত জগতের কিছু গুণী মানুষ তাঁকে চিহ্নিত করেছেন। এ ছাড়া ভজন, রাগপ্রধান ও সমসাময়িক আধুনিক গানেও তিনি সমান পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। শ্রীমতী কৃষ্ণার গাওয়া বেশ কটি জনপ্রিয় গান উল্লেখযোগ্য, পন্ডিত নিখিল ঘোষের সুরে ও শ্রী শ্যামল গুপ্তের লেখা গান “কে ভুলালে বারে বারে”। গানটি আকাশবাণীর বিখ্যাত অনুষ্ঠান রম্যগীতি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানে নিয়মিত বাজানো হ’তো ও মানুষের মুখে মুখে খুব জনপ্রিয় হয়। এছাড়া শ্রী অনুপম ঘটকের সুরে একটি গান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য,গানটি ছিল “এই হাসি, এই বাঁশি” ,লিখেছিলেন শ্রী শান্তি ভট্টাচার্য। “রাতেরও গভীরে কে গো” গানটিও তাঁর; এই গানটি লিখেছেন শ্রী সরল গুহ ও সুরকার ছিলেন শ্রী বীরেন ভট্টাচার্য। সবরকম গান তিনি সমান দক্ষতার সাথে গাইতে পারতেন, এটি শ্রীমতী কৃষ্ণা গাঙ্গুলি দাশগুপ্তের এক বিরল প্রতিভা হিসেবে অনেকেই স্বীকার করেছেন।
এছাড়াও বাংলা সঙ্গীতের জগতে তিনি তাঁর অনেক অবদান রেখে গেছেন। তাঁর প্রচার বিমুখতা তাঁকে আজ হয়তো বিস্মৃতির দিকে ঠেলে দিয়েছে , কিন্তু অনেকেই তাঁকে ভুলে যাননি আজও।
শ্রীমতী কৃষ্ণা গাঙ্গুলি দাশগুপ্ত, আমাদের কৃষ্ণাদি। ১৯৭৭ সালে মায়ের হাত ধরে গিয়েছিলাম তাঁর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতে। তিনি স্নেহে যত্নে শিখিয়েছিলেন খেয়াল, ভজন, রাগপ্রধান ইত্যাদি । এখন মনে হয়, কতখানি সৌভাগ্য আমার, যে তাঁর মতন গুরু পেয়েছিলাম। পরে আবার কলকাতায় ফিরে এসে নিয়মিত যেতাম কৃষ্ণাদির কাছে, উনি তখন অসুস্থ, গান প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। আমার কাছে অভিমান করে অনেক কথা বোলেছিলেন। রেডিওতে আর তাঁর গান বাজে না, মানুষ হয়তো ভুলে গেছে। শুনে মর্মাহত হোয়েছিলাম, মন কৃষ্ণাদিকে নিয়ে কিছু করার জন্য আকূল হ’য়ে উঠেছিল। ২০১৩ সালে কৃষ্ণাদি একরকম নিঃশব্দে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। ২০১৮ সালে আমি কৃষ্ণাদিকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানাবার কাজ শুরু করি, আমার পুঁজি বলতে ছিল আমার গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ও অদম্য জেদ। ছবিটির কাজ এখন প্রায় শেষ, তথ্যচিত্রটির নাম রেখেছি “ হারানো সুর”।
অনেকেই তাঁকে ভুলে যাননি আজো, তার প্রমাণ পেলাম ছবি নির্মাণ কালে। কৃষ্ণাদির পরিবারের মানুষদের অনুমতি নিয়ে যেদিন আমি প্রথম পদক্ষেপ ফেলেছিলাম, বুঝতে পারলাম, আমি একা নই, অনেকে আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। প্রত্যেকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তবে সবার নাম আজ এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হ’লো না । একজনের নাম না বললে অপরাধ হবে, সে হোলো আমার ভ্রাতৃ সমান, এই তথ্যচিত্রের ক্যামেরা-ম্যান শ্রী শুভ সেনগুপ্ত।প্রথম থেকে সে আমার পাশে ছিল এবং এখনও আছে।
২০১৮ র সেপ্টেম্বর মাসে ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করেছিলাম শ্রী কবীর সুমন কে, কারন আমি জেনেছিলাম তিনি কৃষ্ণাদির গানের বিশেষ অনুরাগী, বুঝেছিলাম তিনি আমায় ফিরিয়ে দেবেন না। তাঁর অনুমতি নিয়ে আমার তথ্যচিত্রের প্রথম শ্যুটিং হোয়েছিল সুমনের বৈষ্ণবঘাটার বাড়িতে তারিখটি ছিল ১০ই সেপ্টেম্বর, সকালের দিকে। তিনি একজন স্বভাব বক্তা, মোহিত হ’য়ে শুনেছিলাম তাঁর জ্ঞানের ভান্ডারের প্রতিটি কথা। কবীর সুমনের মতে, রবীন্দ্রনাথ, তারপর নজরুল পরবর্তী যুগে, তখন মেয়েরা ঘর থেকে বেরোনো শুরু করেছে, তাদের জীবনযাত্রায় এক পরিবর্তন এসেছে, আধুনিকতা যেমন জীবনযাত্রাতে, তেমনই গানে। গানের স্টাইল, উচ্চারন এ পরিবর্তন আসছে। কৃষ্ণা দি এসেছিলেন সেই সন্ধিক্ষণে । তাঁর গানের মেজাজ, উচ্চারণ, মিষ্ট অথচ বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর, প্রতিটি স্বরের বিন্যাস, তার গানকে আকর্ষনীয় ও সঠিক অর্থে আধুনিক হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছিল। আমার অনুরোধে সেদিন তিনি বিশেষত কৃষ্ণাদির জনপ্রিয় একটি আধুনিক গানের বিশ্লেষণ করেছিলেন।
আজ এই উনবিংশ শতাব্দিতে, কৃষ্ণাদির সমসাময়িক অনেকেই আর আ্মাদের মধ্যে নেই। বিশিষ্ট গায়িকা শ্রীমতী নির্মলা মিশ্র, শ্রীমতী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে সমর্থ হলেন না। কিন্তু যাদের কাছে আমি সবিনয় অনুরোধ করেছি, প্রায় সকলেই আমাকে তাঁদের বক্তব্য ক্যামেরাবন্দী করতে অনুমতি দিয়েছেন। ঈশ্বরের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, আমার শ্রদ্ধেয় গুরুজি পন্ডিত অরুণ ভাদুড়ীর, সামান্য হলেও, কৃষ্ণাদিকে নিয়ে কিছু কথা আমি আমার ছবিতে রাখতে পেরেছি , তার কিছুদিন পরেই তিনি পাড়ি দিয়েছেন অনন্তের পথে । আমি ভাগ্যবতী বিশিষ্ঠ তবলা বাদক পন্ডিত স্বপন চৌধুরী, ওস্তাদ সাবীর খান ও পন্ডিত মল্লার ঘোষ, বিশিষ্ঠ সেতার বাদক পন্ডিত পার্থ বোস, শ্রদ্ধেয় গায়িকা শ্রীমতী হৈমন্তী শুক্লা, সুরকার শ্রদ্ধেয় শ্রী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়,শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী শ্রীমতী এষা বন্ধ্যোপাধ্যায় ও আরো অনেক গুণী শিল্পীর কথা আমি আমার তথ্যচিত্রে রাখতে সক্ষম হয়েছি। পণ্ডিত যশরাজের মতন প্রবাদপ্রতীম শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী যখন কলকাতায় এসেছিলেন ডোভারলেন সঙ্গীত সম্মেলনে সঙ্গীত পরিবেশনা উপলক্ষে, আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে সক্ষম হয়েছি। আমার কাছে এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।
আজ আমরা এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি , সমস্ত পৃথিবী এক ভয়ানক রোগ জীবানুর অত্যাচারে জর্জরিত। অপেক্ষা, কবে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারবো। আমার গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় আমি যে তথ্যচিত্র বানাতে পেরেছি, তা সবার সামনে তুলে ধরতে পারবো। পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা, তিনি পৃথিবীকে এই কঠিন সময়ের হাত থেকে উদ্ধার করুন, রুদ্ধ মানুষ আবার তার গতিশীল জীবন ফিরে পান।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা মানুষ ও সংস্কৃতির,বিশেষত উড়িষ্যার লোকশিল্পের সংস্পর্শলাভ ও তার চর্চ্চা। কৃষ্ণা গাঙ্গুলী দাশগুপ্ত, নারায়ণ রাও যোশী ও পরে পন্ডিত অরুন ভাদুড়ি প্রমূখ বহু গুণী শিল্পীর কাছে ছোট থেকেই রাগপ্রধান ও সবরকম সঙ্গীতশিক্ষা।
ওয়েব ম্যাগাজিনে লেখালেখি ছাড়াও ভারতবর্ষের প্রথম রঙীন আলোকচিত্র শিল্পী শ্রীরামানন্দ সেনগুপ্ত র একমাত্র কন্যা নন্দিনী বর্তমানে তাঁর প্রথম সঙ্গীতগুরু বিদূষী কৃষ্ণা গাঙ্গুলীকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণে রত।
কৃষ্ণা দাসগুপ্ত মহিষাসুরমর্দিনীতেও গেয়েছেন।এ এক উজ্জ্বল উদ্ধার