আঙিনা

দেশ – ১

– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়

 

ছোটোবেলায় আমরা গরমের ছুটিতে যেতাম দেশে। আমাদের দেশের নাম বনগ্রাম। ঠিক বনগ্রাম নয়, আরো ভেতরে সুখপুকুর নামে, একটি গন্ডগ্রাম। পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ কিছুই ছিলনা সেসময়।। বনগাঁ লোকালে যেতে হত। শিয়ালদা থেকে। 1971 এ মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বিখ্যাত হয়। টিটি/ চেকার বনগাঁ লোকালের কামরায় ঢুকতে সাহস করত না। 

আমি ষাট দশকের কথা বলছি। আসা যাওয়ার সময় বসার জায়গার অভাব হত না। শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ছাড়ত। উল্টোডাঙা, দমদম ক্যান্টনমেন্ট,দমদম, মধ্যমগ্রাম, বিরাটি, বারাসত, দূ্র্গানগর, গুমা, গোবরডাঙ্গা, মছলন্দপুর, ঠাকুরনগর, চাঁদপাড়া, বনগা। বনগাঁ ইস্টিশনের মনে একটা চাপা দুঃখ বরাবর ছিল, কোনো মেল বা এক্সপ্রেস ট্রেন এখানে আসেনা।

রানাঘাট ইস্টিশনের সাথে কিরকম একটা আত্মীয়তা আছে। সেখানে লালগোলা এক্সপ্রেস থামে। তাই নিয়ে রানাঘাটের কত গব্ব , কত দেমাক। শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে একটা চিন্তা আমাকে ঘিরে ধরত। বড় হলে আমাকেতো সবাইকে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমি কোন ট্রেনে চড়ব সেটা বুঝব কি করে? বাবা বোঝেন কি করে? 

প্রথম দিকের স্টেশন গুলোর মধ্যেকার দূরত্ব কম। শেষের দিককার স্টেশন গুলো ‌‌অনেকটা ব্যবধানে। কোনো শহর বা মফস্বল টাউনে জন বসতি ঘন হয়। তার থেকে দূরত্ব যত বাড়তে থাকে জনঘনত্ব তত কমতে থাকে। তাই স্টেশন গুলির মধ্যে দূরত্ব বেশী হয়। ছোটবেলায় জানতাম না ঠাকুরনগর থেকে বনগাঁ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করতেন। এনারা আগে পূর্ব পাকিস্তানে থাকতেন। ওখানকার শান্তিপ্রিয় মানুষদের অত্যাধিক ভালবাসায় অতিষ্ট হয়ে ওই অঞ্চলে এসে বসবাস করা শুরু করেন। প্রায় দু তিন লাখ মানুষ। এসব কথা তখন জানতাম না।

জানতাম না দক্ষিন কলকাতাটা কাঁটাতার পেরোনো ছিন্নমূল মানুষের আবাসস্থল। কলকাতা থেকে বনগাঁ পর্যন্ত দুধারে নিজের দশ পুরুষের ভিটে মাটি থেকে উৎপাটিত, লুন্ঠিত মানুষজন আবার বস্তি গড়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন। এখন একটা কথা মনে হয় ওনারা একসঙ্গে রুখে দাঁড়াননি কেন ? নাকি তাতে লাভ হত না। শান্তিপ্রিয় লোকেদের ভালবাসার রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

যেমন প্রত্যক্ষ করেছিলেন কাশ্মীরের পন্ডিতরা ১৯৯০ তে, মাত্র ৩০ বছর আগে।
যেমন প্রত্যক্ষ করব আমরা ২০৩১ সালের পর।
তখন হয়ত আমাদের উত্তরপুরুষ আমাদের প্রশ্ন
করতে পারে তোমরা একসাথে রুখে দাঁড়াতে পারনি?
জয়বাংলা থেকে পালিয়ে আসা উচিত হয়নি।

কোথাও লেখা ছিল এবং নেহরু বলে ছিলেন দেশভাগ হলে ওপার থেকে যত হিন্দু এপারে আসবেন প্রায সম সংখ্যক মুসলিম এপার থেকে ওপারে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। নেহরু এই সমসংখ্যার আদান প্রদান ভুলে গেলেন বা তুচ্ছ ব্যাপার মনে রাখার চেস্টা করেন নি। কংগ্রেসের কোন নেতা বা কম্যুনিস্ট পার্টির কোনো নেতা যেমন কাকা ওরফে মুজফ্ফর আহমেদ কখনো মুখ খুলেছেন বলে শুনিনি। বাংলার ভাগ্যাকাশে বহু শতাব্দি ধরে শনি বক্রী হয়ে আছে, সাথে রাহুর পূর্ণ দৃস্টি বিদ্যমান।

বছরে দুবার বা তিনবার দেশে যেতাম। স্কুলের ছুটি পড়লে আমরা , বাবা, মা, আর চার ভাই। আমি মেজ। ট্রেনে দেখা মিলত হরেক কিসিমের হকারের। এটা বোধহয় বাঙালির তৈরী প্রথম আনঅর্গানাইজড Start up….কাঁচের বয়মে চামচ ঠুকে হরেক আকারের, রঙের লবেন্চুষ বিক্রি। কারো গায়ে ঝুলত সেফটিপিন, মেয়েদের মাথার ফিতে, ক্লিপ, চূড়ি, বালা, চেন, না চলা হাত ঘড়ি ,কাঁচি , ছুরি, নানা সাইজের চিরুনী ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। সামনে খোসা ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে শশা কেটে সার্ভ করা। ঝালমুড়ি তো মাস্ট, সাথে থাকত সেদ্ধ ডিম। নানা রকম ঘরে বানানো মিস্টিওয়ালা দের দেখা মিলত। এই সব হকাররা ৯৯% ছিন্নমূল পরিবার থেকে আসতেন, যদি কোনোক্রমে পরিবারকে টিকিয়ে রাখা যায়। পরে এনারা খেলার ময়দানে, সিনেমা হলের সামনে, সার্কাসের টেন্টের সামনে ফেরি করতেন। 

বনগাঁ লোকাল করে অনেক গরীব মানুষ চাল নিয়ে কলকাতায় আসতেন বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে।

শিয়ালদহে ঢোকার আগেই এনারা দমদম, উল্টোডাঙ্গায় নেমে পড়তেন। না হলে পুলিশ ধরলে চালান করতো।

সেসময় খুব খাদ্য সংকট চলছিল। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় চাল পাচার দন্ডনীয় অপরাধ ছিল। সমস্ত কামরা তেই এদের দেখা মিলত। ৯০% ছিল ছিন্নমূল , পূ্র্ব পাকিস্তান থেকে আগত বাস্তুহারা।

বনগাঁ স্টেশনে নেমে প্রথমে মিস্টির দোকানে ঢুকে কচুরী, কাঁচাগোল্লা খেয়ে সাইকেল রিক্সায় ওঠা হোত। ৩টে রিক্সা ঢিকুস ঢিকুস করে বনগাঁ টাউনের বুক চিরে খেলাঘরের মাঠ বাঁদিকে রেখে রায় ব্রীজে ওঠে।

খেলাঘরের মাঠের এক প্রান্তে সেজমাসীমার বিশাল বাড়ী। সেজমেসোমশাই ওখানকার নামকরা ডাক্তার। জমাটি পসার। সেই সময়ের মরুভুমিসম জীবনে সেজমাসীমার বাড়ী ছিল মরুদ্যান। রায় ব্রীজ ছিল সত্যিই রয়াল ব্রীজ। ওর নীচে শুয়ে আছে ইছামতী নদী। এই নদী কে অনেকেই অমর করে রেখেছেন। বিশেষত বিভুতি ভূষন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের লেখায়। ইছামতীর তীরে অনেক সিনেমার স্যুটিং হয়েছে। উল্লেখযোগ্য উত্তম, সন্ধ্যারানী অভিনীত ‘বড়দিদি’।

‘বড়দিদি’ উপন্যাসটি মাসিক পত্রিকা ভারতী তে কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছিল। ভারতী পত্রিকাটির প্রতিস্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়-দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের প্রথম গল্প ভিখারিনী , ভানু সিংহের পদাবলীর কবিতা/ গান গুলো এখানেই ছাপা হয়েছিল। ঠাকুর বাড়ীর অনেকেই এই পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন।

‘বড়দিদি’-র দু একটা কিস্তি প্রকাশিত হতেই বাংজলা পাঠক মহলে হৈচৈ পড়ে গেল। সবার ধারনা হল রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কারো কম্ম নয়। তার ওপর ভারতী তে ছাপা হচ্ছে। লেখা হয়েছিল শেষ কিস্তিতে লেখকের নাম প্রকাশ করা হবে। তবে শেষ কিস্তি অবধি অপেক্ষা করতে হয়নি। তুমুল উৎসাহের মধ্যে জানা গেল বার্মানিবাসী এক নতুন লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এটি লিখছেন। বাংলা সাহিত্যাকাশে আবির্ভাব হল এক নতুন নক্ষত্রের। তাঁকে সাদরে বাংলায় আসার আমন্ত্রণ জানানো হল। তিনি এলেন, দেখলেন, বাঙালি তথা ভারতীয়দের মন জয় করলেন।

সুখপুকুর যেতে ইছামতী নদী পেরোতে হয়।

ইছামতীর ওপর পাশাপাশি দুটো ব্রীজ। একটা ব্রীজ তৈরী করা হয়েছে ‌অনেক গুলো নৌকা (বোট) পাশাপাশি রেখে। নাম বোটের পুল। এটা পুরোনো। পাশের টা রায় ব্রীজ। ইস্পাতের তৈরী। রায় ব্রীজ পেরিয়ে রিক্সা স্ট্যান্ড। স্টেশনের রিক্সা আর যাবে না। আবার তিনটে রিক্সা করা হয়। রায় ব্রীজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতাম ছোট ছোট ছেলেরা ব্রীজের মেন স্ট্রাকচারের ওপর থেকে দলে দলে ইছামতী নদীতে ঝাঁপ বা ডাইভ দিচ্ছে। কোনো জহুরীর চোখে যদি এরা পড়তো ও যথাযথ ট্রেনিং পেত, তাহলে দেশ কিছু ভাল ডাইভার পেত। এদেরও আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হত। তা হয়নি। হওয়ারও ছিল না।

সেইসময় অলিম্পিকে অংশ গ্রহন কারী ফুটবলার দের খালি পায়ে খেলতে হত। ভারত সরকার বাহাদুর বুট দিতে রাজী হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বিদেশী সিগারেট 555 টানতেন। যাই হোক আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ঘাটবাঁওড়।

 

(ক্রমশঃ) – পরের সংখ্যা

 

(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)

Comment here