(পূর্বের সংখ্যার পর)
– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়
ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের প্রভাবে সরস্বতী নদী ভূগর্ভে নিমজ্জিত হয়। সেইসাথে এই সভ্যতা তার উৎকর্ষতা হারায় ও কালক্রমে বিলীন হয়। আমিশ কল্পনা করেছেন সরস্বতী নদীর জল ব্যবহার করে সেযুগের আয়ুর্বেদাচার্যগণ দীর্ঘায়ু হওয়ার ঔষধ বানাবার কৌশল জানতেন। যেমন বেনারসের গঙ্গার জলেই বেনারসী শাড়ী তৈরী হয়। বাংলার গঙ্গা জলে বেনারসী শাড়ী হয়না। তাইতো বিখ্যাত ডিজাইনার সব্যসাচী মুখার্জি বেনারস থেকে ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজল আনান। আগের পর্বে লিখেছিলাম আর্কিওলজিক্যাল স্যোসাইটির তদানিন্তন ডাইরেক্টর জেনারেল রাখালদাস বাবুর সব রিপোর্ট চেপে দিয়ে পরে আবিস্কারকের কৃতিত্ব দাবী করেন। এর কারণ ইংরেজ রা নিজেদের ভারতীয়দের থেকে অনেক উন্নত ভাবত। ঠিক একই ভাবে গণিতে বিশেষ পারদর্শী রাধানাথ শিকদার (১৮০১) , যিনি প্রথম হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা মেপেছিলেন, সেই কৃতিত্ব তদানিন্তন সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ডাইরেক্টর জেনারেল এভারেস্ট নিজের নামে ওই শৃঙ্গের নাম রাখেন ও কৃতিত্ব আত্মসাৎ করেন।..শুধু তাই নয়। সিন্ধু সভ্যতার অস্তিত্ব স্বীকার করা মানে ৬০০০-৭০০০ বছর আগে ভারতভূমিতে উন্নত নগর কেন্দ্রীক সভ্যতার অস্তিত্ব স্বীকার করা।
কিন্তু পাশ্চাত্য পন্ডিতরা বলেছেন ৩০০০ বছর আগে আর্যরা আসার আগে ভারত সভ্যতার আলো দেখেনি। মহামতি বা মহামূ্র্খ মার্কস একই কথা বলে বসলেন। যিনি কোনদিন ভারতে আসেননি। বাইবেলের আজগুবি থিয়োরী বা গল্প গুলো ধূলিস্যাত হয়ে পড়ে। মহা সংকট। ইতিমধ্যেই ডারউইনের থিয়োরি অফ ইভোলিউশন এসে বাইবেলের দূর্গে জব্বর আঘাত হেনেছে। পরে কোন পর্বে ডারউইনের আবিস্কার নিয়ে লিখব। এই প্রসঙ্গে প্রফেসর নীল ওকের নাম করা যেতে পারে। উনি এ্যাস্ট্রোনমির নানা ঘটনা বিশ্লেষন করে ( কম্পিউটারের সাহায্যে) সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে (রাফলি) সিন্ধু সভ্যতা ৭০০০ বছর আগের,মহাভারত ১৪০০০ বছর আগের,রামায়ণ ২১০০০ বছর প্রাচীন। পরে মনে থাকলে লিখব এই থিয়োরী নিয়ে।
ইউরোপিয়ানরা যারা শূন্য বা জীরোর ব্যবহার জানত না, তারা নাকি উন্নত সভ্য জাতি! ওদের হাস্যকর রোমান হরফ নিয়ে পরে বলব। সিন্ধু সভ্যতার একটি বিশেষ রহস্য হল সিন্ধুলিপি। এটি পাঠোদ্ধার করা যায়নি, যদিও অন্যান্য অনেক প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছে। তবে প্রচুর রিসার্চ চলছে লিপি উদ্ধারের। মোটামোটা দামী বই ও পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে একটি কম্পুটার সায়েন্সের বাঙালি মেয়ে বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায় সিন্ধু লিপি উদ্ধারের ওপর একটি পেপার লিখে হৈ চৈ ফেলেছিল। বিখ্যাত জার্নাল নেচারে পেপারটি প্রকাশিত হয়েছিল। অনেক সফট ওয়ার আছে প্যাটার্ণ রেকগনিশনের ওপর। উনি সিন্ধু লিপির প্যাটার্ন কম্পুটারে ফেলে মর্মোদ্ধারের উপায় বলেছেন। অনেকেই এইভাবে চেষ্টা করেছেন বা করছেন। ঐক্যমতে আসা যায়নি এখনো।
ফিরে আসি আবার বনগাঁ টাউনে। বনগাঁ একসময় বিখ্যাত ছিল চিরুনী শিল্পের জন্য। সারা দেশে যশুরে কাঁকই খুব বিখ্যাত ছিল। বনগাঁয় ৩০০র বেশী চিরুনী কারখানা তৈরী হয়েছিল। লগ্নি বেশী লাগত না। সেই মিশরীয় সভ্যতা থেকে সৌন্দর্য রক্ষায় চিরুনীর ব্যবহার ছিল। পাথরের চিরুনী, হাড়ের চিরুনী, শিংএর, কাঠের চিরুনী বিভিন্ন যুগে ব্যবহৃত হত। বাংলায় এক সময় সান্ধ্যস্নান সেরে মহিলাগন বাড়ির ছাতে বসে আকাশ কে মুকুর করে অলস কেশচর্চা ও সেইসাথে সংবাদ আদান প্রদান করতেন। অবিভক্ত বাংলায় যশোহর জেলায় চিরুনী শিল্পের প্রচলন হয়েছিল। পরে ভারত ভাগের পর এপার বাংলায় বনগাঁয় এই শিল্প প্রসার লাভ করে।
১৯০১ সালে কিরণ দত্ত ও আরো কয়েক জন জাপানি টেকনোলজি ব্যবহার করে সেলুলয়েড থেকে নানা ডিজাইনের সুগন্ধি চিরুনী তৈরী করে সারা ভারতে ছড়িয়ে দিতেন। খুব দক্ষতার প্রয়োজন। প্রধানত কুটির শিল্প। বনগাঁর ঘরে ঘরে তৈরী হত, অল্প মূলধন লাগত। পেট্রোকেমিক্যাল বিজয় রথে করে নানা রকম সস্তার চায়না মেড নাইলনের ব্রাশ ও প্লাস্টিক চিরুনীর সাথে প্রতিযোগিতায় সেলুলয়েডের চিরুনী পিছু হটল। তার ওপর মড়ার ঘা এল জি এস টির নাম ধরে। বনগাঁর কুটির শিল্প এখন আই সি ইউ তে।
ফিরে আসি আমার শ্যামলিমাময় দেশের বাড়ির আশপাশে। ঘাটবাঁওড় থেকে কাঁচা রাস্তা ধরে আসার সময় দুটো সাঁকো, কাছাড়িবাড়ি স্কুল ছাড়িয়ে আরো অনেকটা পথ হাঁটলে ফুলফুলে আমগাছটি চোখে পড়ত। ওই গাছ থেকে শুরু হত আমাদের আম বাগান। বাড়ি অবধি এর বিস্তৃতি। কত রকমের আম গাছ। জামথলি, বেলথলি, কেলো,মধু কুলকুলে, ভূতোবোম্বাই, টুরটুরে, খানাবেড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো সব আঁটির আম। বাড়িতে ওঠার চওড়া, ঘাসে ঢাকা ঢালু মেঠো রাস্তার দুপাশে কয়েকটা ফজলি, বোম্বাই গাছ আছে। ফজলি আম আষাঢ, শ্রাবণ মাসে পাকে। বিশাল আকারের হয়। আর আছে বিশাল বড় খানাবেড়ে গাছ। আম মাঝারি আকারের। খুব মিস্টি। বাগানে আম গাছের মাঝে মাঝে আছে লিচু, জাম, বেল, কয়েতবেল, কামরাঙা প্রভৃতি। দুটো জামরুল গাছে জামরুল হত দু রকমের। একটায় ছোট ছোট লালচে রঙের। অন্যটায় বড় বড় কৃস্টাল জল রঙের। খুব মিস্টি। এখনকার ছেলেমেয়েরা জানলই না সবুজ কামরাঙা নুন দিয়ে কেমন খেতে বা কয়েতবেল নুন তেল দিয়ে মাখলে তার স্বাদ কেমন। চকাস চকাস করে খেতে হয়।
বাড়ির চার পাশ , পায়ে চলার রাস্তার দুধারে বা আমবাগান বা আশপাশে প্রচুর ঝোপঝাড়। নানা ধরনের গুল্ম, পেত্নীঝুপো, আড়শ্যাওড়া, সেকুল গাছ, ভাটুগাছে ভর্তি। আড়শ্যাওড়া গাছের ডাল গ্রামবাসীরা দাঁতন হিসেবে ব্যবহার করে অর্থাৎ সকালে দাঁত মাজে। টুথপেস্ট আসার আগে ব্যবহৃত হত। শহরে লোকে কয়লার ছাই ব্যবহার করত মাজন হিসেবে। কলকাতায় বিভিন্ন বাজারে আড়শ্যাওড়ার ডাল ছোট ছোট করে কেটে বিক্রি হয়। আমাজন বা ফ্লিপকার্ট যেদিন থেকে মার্কেটিং করবে সেদিন থেকে শহর টাউনের বাবু বিবিরা অর্ডার দেওয়ার জন্য হামলে পড়বে। নিমের গুণ সাহেবরা বলার পর আমরা কদর করি। আয়ুর্বেদ ভারতবর্ষের আবিস্কার। যেকোনো ফলের গাছে চড়ে ফল পাড়া পরিশ্রম সাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সেকুল গাছের ডাল ভেঙ্গে বা কেটে তৈরী করা হত এঁড়ো। ডেঢ় থেকে দু ফুট লম্বা। এঁড়ো ছুঁড়ে মগ ডাল থেকেও পাকা হলুদ আম পাড়া হত। অনেক দিনের প্রাকটিস ও Aim এর প্রয়োজন। কখনো কখনো আম পড়ত না, বরং এঁড়ো গাছে আটকে থাকত।
(ক্রমশঃ)
(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)
Comment here