(পূর্বের সংখ্যার পর)
– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়
আর একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল শিকার। বাড়িতে দুটো দোনলা বন্দুক ও একটি রাইফেল ছিল। পূজোয় বা মেলায় এয়ার গান দিয়ে বেলুন ফাটাতাম না, ঝুলন্ত পয়সায় aim করতাম। রাইফেল দিয়ে দিনের বেলায় ঘুঘু, বালিহাঁস, সারস শিকার করা হত। রাতের বেলায় কাকারা খেয়ে দেয়ে দোনলা বন্দুক, টর্চ, লাঠি হাতে নিয়ে বের হতেন। যখন শিকার করে ফিরতেন, তখন আমরা ঘুমিয়ে কাদা। প্রধানত বুনো খরগোশ শিকার করা হত। আশ পাশের গ্রামের লোকজন খবর দিয়ে যেত কোথায় কোন ক্ষেতে খরগোশের উৎপাত বেড়েছে। সেইসব ক্ষেতে গিয়ে চার সেলের টর্চ থেকে আলো ফেলা হত। খরগোশের চোখে আলো পড়লে খরগোশ আর নড়তে চড়তে পারত না। তখন পাশ থেকে কেউ গুলি ছুঁড়ত। বুনো খরগোশ। দুঃখ করবেন না।
আমের দেশ তো আম খাওয়ার গল্প বলি। আমরা আম খেতাম সামনে দাঁত দিয়ে একটা ফুটো করে, চুষে চুষে খেতাম। হাতে রস লাগত না। দেরাদুনে ১৯৮৬ এ জিটি ট্রেনিংয়ে ( ওনজিসি) ছিলাম, কারো বাড়ি গেলে প্লেটে আমের দুটো চাকলা দিত সাথে চামচ। চামচে করে খাওয়ার জন্য। ঠাকুমা ছাতে আমসত্ব বানাতেন সব নাতি নাতনিদের জন্য। কুলো, নানা থালায়। আমসত্ব খাওয়ার অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে আমার। কদিন আগেও বরুন কলকাতা থেকে পাঠিয়ে দিল। অনেকের ধারণা প্যাঁচা রাতে ডাকেনা। বাড়ির সামনের খানাবেরে আম গাছে রাতে দুটো প্যাঁচা এসে বসত। বেশ রাতে হিস্ হিস্ আওয়াজ করতো। প্রথমে শুনলে মনে হত সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাল করে কান পাতলে বোঝা যেত উঁচু খানাবেরে গাছ থেকে আসছে। টর্চ ফেলে দেখা গেল দুটো প্যাঁচা এসে বসে আছে। আর হিস হিস করে সাপ গুলোকে ডাকছে, শিকার করবে বলে।
৫০ এর দশকে বাঘ দেখতে পাওয়া যেত। কাকারা একটি বাঘ শিকার করেন দোনলা বন্দুক দিয়ে। ঠাকুর্দার ঘরে বাঘছাল টি টাঙানো থাকতো। এখন আছে কিনা জানা নেই। রাতের আকাশ অন্ধকার বা কালো কেন? সহজ উত্তর রাতে সূর্য্য থাকেনা। গ্রামে বিদ্যুৎ নেই ইত্যাদি।
১৬০০ শতাব্দিতে ফিলোসফার দের মনে এই প্রশ্ন এসেছিল। তখন বিজ্ঞান ফিলোসফি এগুলো আলাদা হয়নি। নিউটনের বিখ্যাত বই এর নাম Philosophiae Naturalis Principia Mathematica যদিও বই টা ফিজিক্স আর ম্যাথামেটিক্স র ওপর। ফিলোসফাররা ভাল গণিতজ্ঞ হতেন। Decarte, Bertrand Russel ফিলোসফার হলেও অঙ্ক ভালোই জানতেন। Decarte থেকেই কার্টেসিয়ান কো অর্ডিনেট। তাঁরা গননা করলেন তারা রা যত দূরেই থাকুকনা কেন , তাদের সবার অল্প অল্প আলো summation বা যোগ করলে যা পাওয়া যাবে , তাতে রাতের আকাশ অন্ধকার থাকার কথা নয়। ইউনিভার্স তো অসীম। 400 বছর ধরে এর উত্তর পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক কালে মনে করা হচ্ছে তাহলে কি ইউনিভার্স অসীম নয়? বা অসীম কিন্ত সান্ত। অন্ত আছে। বা Infinite but bound. খুব দুরুহ ব্যাপার স্যাপার। গুগলে এর ওপর অনেক আর্টিকল আছে, পড়ে বোঝা মুসকিল। দেখতে পারেন।
গ্রামে ফিরি।
শীত কালে সবজী দেখার মত। মটরশুঁটি, বেগুন, পেঁপে , নানা রকম শাক আমাদের ক্ষেতেই হত। শীতকালের সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছাড়া বা লেপের তলা থেকে বেরনো খুব কস্টসাধ্য ছিল। তবু সপ্তাহে দু -একদিন উঠতে হত। ভোরে অনেকগুলো মাটির হাঁড়ি করে খেজুর গাছের রস উঠোনে রেখে যেত গাছ কাটিয়েরা। ভোরের কুয়াশায় মনে হত অনেক গুলো মসলিনের শাড়ি যেন পর পর টাঙানো, হাওয়ায দুলছে। সবার জন্য রান্নাঘরের দাওয়ায় কাঁসার গ্লাসে রাখা থাকতো খেজুর রস। আমরা পাটকাঠি ভেঙ্গে স্ট্র বানাতাম আর রস খেতাম। বেলা হয়ে গেলে রস গেঁজিয়ে যায়, তাড়ি হয়ে যায়। রস বেশী এলে জাল দিয়ে দিয়ে পাটালী গুড় বানানো হত। সময় ও পরিশ্রম সাপেক্ষ। কনটিনিউয়াস নাড়তে হয় হাতা দিয়ে।
আগের দিন সন্ধ্যায় খেজুর গাছে হাঁড়ি নিয়ে উঠে , গাছের ওপরের দিকে ছুরি দিয়ে কাটতে হয়। তারপর ওই কাটা অংশে ছোট কঞ্চি গেঁথে দেওয়া হয়। কঞ্চির অপর প্রান্ত হাঁড়ির মুখে থাকে, যাতে গাছ থেকে রস চুঁইয়ে চুঁইয়ে হাঁড়িতে জমা হয়। অমিতাভ বচ্চনের প্রথম দিকের ফিল্ম সওদাগর অনেকেই দেখে থাকবেন। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের রস গল্প অবলম্বনে।
আমি মাঝে মাঝে একা গিয়ে দেশে থাকতাম। দেশ থেকে কলকাতায় কেউ এলে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হত। কলকাতায় শরীর ভাল থাকতো না। পড়াশুনো ঠিকমত হত না। দু তিন সাবজেক্টে ফেল করে পরের ক্লাসে উঠতাম। আমাদের স্কুল ছিল কো এডুকেশন। ছেলে মেয়েরা একসঙ্গে পড়তাম। ক্লাস এইটে আমাদের ক্লাসে (একটাই সেকশনে ) ৫০-৬০ জন ছাত্র ছাত্রী ছিল। সে বছর একজন বিলেত ফেরত মহিলা আমাদের সি আই টি গভর্মেন্ট স্কুলের হেড মিস্ট্রেস নিযুক্ত হলেন। নাম ছিল আনন্দময়ী মজুমদার। উনি সই করতেন গ্লাডিস মজুমদার নামে।
পড়াশুনো একদমই করতাম না। সংসারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ম্যাম এ্যানুয়াল পরীক্ষার আগে নিয়ম করলেন দু সাবজেক্টে ফেল করলে ক্লাস প্রমোশন দেওয়া হবে না। বেসিক্যালি বাঙালি টিচার। ইংলিশ আদব কায়দা চালাতে চেস্টা করতে ব্যস্ত ছিলেন। পরীক্ষা দিয়ে দেশে চলে এসেছিলাম। বাবা কলকাতায় ছিলেন। অফিস।
দেশে আমার রেজাল্ট নিয়ে এলেন। প্রমোশন পেয়েছি। দু সাবজেক্টে ফেল। অঙ্কে ৪৫। কাকারাও দেখলেন। বললেন এক চান্সে বোর্ড পাশ করা মুশকিল। কলকাতা ফিরে স্কুলে ক্লাস নাইনে গিয়ে দেখলাম পুরোনো ক্লাস এইটের ১৩-১৫ জন আছে। আর ক্লাস নাইনের ফেল করা ১০ জন আছে। এইটের আর্ধেকের বেশী ফেল করে ওই ক্লাসে রয়ে গেছে নাহলে টি সি নিয়ে চলে গেছে। যে কোনো স্কুলের স্টুডেন্টদের থেকে প্রাপ্ত ফীস হল রেভেনু আদায়ের উপায়। সেটা এখনকার স্কুল পরিচালক সমিতি রা জানেন। কোনো স্টুডেন্ট একটা সাবজেক্টেও ফেল করলে টিচার কে জবাব দিহি করতে হয়। তাঁরা বুঝেছেন লক্ষ্মী প্রতিষ্ঠিত না হলে সরস্বতীর সাধনা অসম্ভব। আমাদের স্কুল ছিল গভঃ স্পনসরড। তাই রেভেনু নিয়ে মাথা ঘামাতো না।
যাই হোক নতুন ক্লাসে নতুন পরিবেশে পড়াশুনোয় খুব মন দিলাম। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় সেকেন্ড হলাম। আমার কোনো প্রাইভেট টিউটর ছিলনা। এত কথা বললাম এইজন্য যে আমাদের পড়াশুনা কতটা পরিবেশ নির্ভরশীল সেটা বোঝাবার জন্য। পরিবেশ পরিবর্তন করলে একটা খুব সাধারন স্টুডেন্ট অসাধারন হয়ে উঠতে পারে। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রেসিডেন্সী কলেজ, ফিজিক্স অনার্স, এম এস সি, পি এইচডি করে, অল ইন্ডিয়া কম্পিটিশন কম্পিট করে ওনজিসি তে ক্লাস ওয়ান পোস্টে জয়েন করলাম আহমেদাবাদে ১৯৮৫ তে।
(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)
Comment here